সংক্রমণ এড়াতে ছয় ফুট দূরত্বের তত্ত্বটি সেকেলে, নতুন ট্র্যাফিক লাইট পদ্ধতি আবিষ্কার মার্কিন বিজ্ঞানীদের
১৮ শতকের শেষদিকে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ফ্লুগে প্রথম অনুমান করেন, সংক্রমিত রোগী থেকে নিরপদ দূরত্ব বজায় রাখলে তাতে সুস্থ ব্যক্তি জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষতিকর সংক্রামক জীবাণু নিয়ন্ত্রণের এ ধারণা তখনও নেহাৎ তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য, সে আমলের বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট দূরত্বে কাচের প্লেট রেখে বাতাসে হাঁচি-কাশির জীবাণু কতদূর যেতে পারে, সে সম্পর্কে কিছু প্রায়োগিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা লদ্ধ প্রমাণও জোগাড় করেন।
কিন্তু, তা যথেষ্ট ছিল না বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের মাপকাঠিতে। ফ্লুগের দেওয়া তত্ত্বটি প্রথম প্রমাণিত হয় আরো চার দশক পরে, উচ্চ-গতির আলোকচিত্র ধারণ প্রযুক্তি বিকাশের ফলে।
১৯৪০ এর দশকের প্রথমদিকে এ প্রযুক্তি সাহায্যে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, কিভাবে মানুষের হাঁচির কণা বাতাসে ছড়ায়। ক্যামেরার প্রায় ৩০ হাজার ফ্রেম রেটে ধারণ করা এ চিত্র প্রমাণিত করে, ফ্লুগেই সঠিক ছিলেন। আমরা যখন হাঁচি বা কাশি দেই তখন তীব্রতার উপর ভিত্তি করে নাক বা মুখ নিঃসৃত তরল কণা তিন থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
মতবাদটি যেভাবে বিশ্বাসে পূর্ণতা পেল:
৪০-এর দশকের জীববিজ্ঞান এবং জীবাণু সম্পর্কে জানাশোনা সঙ্গত কারণেই বর্তমানের তুলনায় অনেক সীমিত ছিল। তখনকার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন আমাদের নাক-মুখ নিঃসৃত সংক্রামক জীবাণু ছয় ফুটের বেশি দূরত্ব পর্যন্ত ছড়াতে পারে না।
এনিয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল প্রস্তরফলকে লেখা আদেশনামা হিসেবে গ্রহণ করার কথাও তারা বলেননি। মহামারির সময়ে ঠিক এ পরিমাণ দূরত্ব বজায় রাখলেই সংক্রমণ মুক্ত থাকা সম্ভব হবে কিনা- তা নিয়ে তখনও সন্দেহ ছিল তাদের অনেকের মনে।
তারপরও, দেখা গেল মহামারির আপৎকালে ৩ থেকে ৬ ফুটের এ বিধি মেনে চলা খুবই সহজ। আর চলমান মহামারিতেও এ নিয়মটি সুস্থ মানুষকে সংক্রমিতদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখবে, বলে আশা করছেন প্রায় সকল দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
৮০ বছর পুরোনো ৬ফুট দূরত্বের এ বিধির ব্যাপারে- অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ জলীয় কণার বাতাসে বিস্তার বিষয়ক বা এরোসল বিজ্ঞানী লিডিয়া মরাওস্কা বলেন, ''মতবাদটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্যে রূপ নিয়েছে। সকল মতবাদই সম্প্রসারণশীল। নানা দেশের কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষও এতে আস্থা স্থাপন করেছে। এ অবস্থায় তাদের চিন্তাধারা সহজে পরিবর্তন করাটা সম্ভব নয়।''
তবে মাসের পর মাস ধরে করোনাভাইরাসের মহামারি চলতে থাকায় এখন মরাওস্কা এবং তার সহকর্মী বিজ্ঞানীরা ছয় ফুট দূরত্বের এ বিধিটির অসারত্ব খণ্ডন করতে চাইছেন। এ লক্ষ্যে এরোসল বিজ্ঞানীরা প্রযুক্তিবিদ এবং প্রকৌশলীদের সাহায্যে কাজও করে চলেছেন।
বাতাসে করোনাভাইরাসের প্রকৃত বিস্তার পরিধি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করাটাই এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। পাশাপাশি অব্যাহত সংক্রমণের মধ্যেও মানুষের সুরক্ষিত চলাচলের নতুন ও অধিকতর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পদ্ধতি চালু করতে চান তারা।
এসব বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, সব সময় ছয় ফুট দূরত্ব মানলেই শতভাগ সুরক্ষিত থাকা যাবে- এমনটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বরং দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা কিভাবে চলাফেরা করব, সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কিছুটা কম সতর্কতা অবলম্বন করা যেতে পারে, আবার প্রয়োজনে সঙ্গে সঙ্গেই সতর্কতা পালনের প্রস্তুতিটাও রাখতে হবে।
বিজ্ঞানের নতুন প্রস্তাবনা:
গত মঙ্গলবার মানুষ যেন নতুন আঙ্গিকে নিজেদের স্বাভাবিক চলচলের পাশাপাশি সুরক্ষিত থাকতে পারে, এ উদ্দেশ্যে বিপজ্জনক মাত্রার জনসমাগম নিয়ে সতর্ক থাকার একটি ট্র্যাফিক লাইট চার্ট আবিষ্কার করেছেন অক্সফোর্ড এবং এমআইটি'র বিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, এই তালিকা অনুসরণ করলে জন-সমাগমের স্থানেও নিরাপদে থাকা যাবে ছয় ফুটের বিধান না মেনে। আবার, ঝুঁকি কম থাকলে জীবনকে আগের মতোই পূর্ণভাবে উপভোগ করার সুযোগ মিলবে।
এমআইটির ফ্লুইড ডায়নামিক্স অব ডিজিসেস ট্রান্সমিশন ল্যাবের অধ্যাপক লিডিয়া বোরোইবা'র নেতৃত্বে পরিস্থিতি অনুসারে নিরাপদ দূরত্বে থাকার এ নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিএমজি জার্নালে সেটি প্রকাশের পর মার্কিন গণমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডারকে এক সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
''নতুন করে লদ্ধ জ্ঞান এবং সহজেই পাওয়া যায় এমন (তত্ত্বীয়) উপকরণের সাহায্যে, আমরা জটিল বৈজ্ঞানিক তথ্যকে সরলভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি। আশা করছি, কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সামাজিক নেতৃবৃন্দ, বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এর সম্পর্কে মানুষকে জানাবেন। কেউ যদি বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চান বা করতে চান বারবি কিউ পার্টি- তার জন্য আমাদের নতুন গবেষণা উপকরণ এক বড় সুসংবাদ। এর সাহায্যে তারা সঠিক সতর্কতার পদক্ষেপ নিতে পারবেন। আবার কর্তৃপক্ষ পাবেন, কার্যকর বিধি-নিষেধ আরোপে সহায়তা।''
''আমরা মানুষকে নানা ধরনের পরিবেশে নিরাপদ থাকার সহযোগী তথ্য দিতে চাই। কখন সতর্ক থাকতে হবে, আর কখন তার দরকার নেই- সে সম্পর্কে জানতে পারবেন তারা'' বলেন বোরোইবা।
বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত উপকরণের সাহায্যে একজন ব্যক্তি কোনো নির্দিষ্ট একটি জনসমাগম স্থলের ঝুঁকি পরিমাপ করতে পারবেন। এর বাইরে ভিড়ে মানুষের সংখ্যা ঘনত্ব এবং তারা কী করছেন, সেই অনুসারে সতর্ক থাকা যাবে।
করোনাভাইরাস কোনো এক নিয়মে মেনে ছড়ায় না, তাই আমাদেরও বিকল্প সম্পর্কে জানতে হবে:
মরাওস্কার মতো প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিসূক্ষ্ম জলীয় কণার বাষ্পীয় ফোটা ৩ ফুট নাকি ১০ ফুট দূরে থাকা ব্যক্তিকে সংক্রমিত করবে, সে পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা করার কোনো মানে নেই। বরং ঠিক কী পরিমাণ জীবাণু আপনার দেহে প্রবেশ করতে পারে, তা নিয়ে জানতে হবে। জীবাণুটি কীভাবে এতদূরে এলো তা নিয়ে ভেবে লাভ হবে না।
''সংক্রমণ ছড়ানোর তিনটি মাধ্যম আছে। আর সব কয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। শুধু দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদ থাকা যাবে না।''
সংক্রমণের এ তিনটি মাধ্যম হলো; আক্রান্ত ব্যক্তি, বস্তুতল এবং বাতাস।
মরাওস্কা আরো বলেন, ''একইসঙ্গে তিনটি মাধ্যমে জীবাণু থাকতে পারে। একারণে তাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করাটাও খুব জটিল।''
যেখানে মানুষজন একটু উৎফুল্ল বা কোনো কারণে একটু বেশি উত্তেজিত; আবদ্ধস্থানে এমন লোকেদের ভিড় আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাছাড়া, বাতাসের মুক্ত প্রবাহ থাকা চাই। বদ্ধ পরিবেশে এ সুযোগ অনেকটাই কম থাকে।
বোরোইবা এবং তা সহ-লেখকরা বিএমজি'তে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে লিখেছেন, ''জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া, গান গাওয়া, কাশি দেওয়া লোকেদের ভিড় এড়ানো উচিৎ। একইভাবে, প্রশ্বাসের ফলে উৎপন্ন উষ্ণ এবং বাষ্পভরা গ্যাসীয় পরিবেশে ফুসফুস নির্গত সূক্ষ্ম জলকণার পরিমাণ বেশি থাকে।''
এমন পরিবেশ থেকে ২০-৩০ ফুট দূরে থাকলেও সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকা যাবে না, বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
ঠিক একারণেই পশ্চিমা বিশ্বে মাংস প্রক্রিয়াজাত করার কারখানাগুলো সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য কুখ্যাতি লাভ করেছে। কারণ, অধিক সংখ্যায় কর্মীর উপস্থিতি, বাতাস চলাচলের যথেষ্ট সুবিধা না থাকা, গাদাগাদি কাজের পরিবেশ, চিৎকার চেঁচামেচির মতো নেপথ্য পরিবেশ এবং মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক না হওয়ার মতো নিয়ম- এ শিল্পটিতে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য দায়ি। উদাহরণস্বরূপ এ শিল্পেরই উদাহরণ দিয়েছেন নিবন্ধটির লেখকরা।
একই ধরনের ঝুঁকি থাকে- শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনা বাড়ায় এমন অন্য কিছু স্থানের পরিবেশে। যার মধ্যে ব্যয়ামাগার, পানশালা, গির্জা এবং নাইটক্লাব অন্যতম।
পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক না হলে; আমরা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত থাকতেও পারব না:
প্রকৌশলী, জীবাণু বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা সকলেই নতুন করোনাভাইরাসের হুমকি মাথায় রেখেই কীভাবে স্বাভাবিক ও নিরাপদ জীবন-যাপন করা যায়, তা অনুসন্ধানের উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
বোরোইবা বলেন, ট্র্যাফিক লাইট কিভাবে কাজ করে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই তা জানেন।ঠিক একারণেই আমাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিটি এ ধরনের লাল,হলুদ আর সবুজ সংকেত যুক্ত। যা সাধারণ মানুষকে নির্দিষ্ট স্থান বা ভিড়ের ঝুঁকি সম্পর্কে জানাতে পারে। মহামারির মাঝে এ ব্যবস্থা আমাদের একত্রিত হওয়া, মেলামেশা বা সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করবে। সেই অনুসারে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে দূরত্বের চাইতে বেশি খেয়াল রাখতে হবে পরিবেশের উপর।
''পরিবর্তিত সময় আর পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তা না করতে পারলে আমরা সব সময় বেশি নিরাপদেও থাকতে পারব না। শুধু ছয় ফুট দূরত্ব মানা বা মাস্ক পড়া আপনাকে খুব সামান্যই রক্ষা করতে পারে'' তিনি যোগ করেন।
- সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- অনুবাদ: নূর মাজিদ