গাছে চড়ে অনলাইন ক্লাস: পাহাড় চূড়ায় দুই বোনের অন্য লড়াই
পড়াশোনা করার জন্য কী কসরতই-না করতে হয় এল সালভাদরের দুই তরুণী বোনকে! তারা প্রতিদিন একটা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠেন, তারপর সেখানে থাকা এক জলপাই গাছে চড়ে বসেন মোবাইলের সিগন্যাল পাওয়ার জন্য। এভাবেই অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ নিতে হচ্ছে তাদের।
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশটিতে মার্চ মাসে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে শুধু এই দু'বোনকে নয়, প্রান্তিক অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষকে এ রকম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এল সালভাদরের গুয়াতেমালা সীমান্তবর্তী এল তাইগ্রে অঞ্চলে মোবাইল ফোনের সিগন্যাল পাওয়া খুব দুরূহ। তাই মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস করতে বেশ ভুগছেন ওই তল্লাটের শিক্ষার্থীরা।
'আমরা যারা প্রান্তিক অঞ্চলে থাকি, আমাদের জন্য পড়াশোনা করা সবচেয়ে কষ্টের কাজ। এখানে কোনো ইন্টারনেট সংযোগ নেই,' এএফপিকে বলছিলেন ২২ বছর বয়সী, গণিতের ছাত্রী মাতিলদে।
তিনি আর তার ১৯ বছর বয়সী বোন, পরিসংখ্যানের ছাত্রী মারলেনে একসঙ্গে এভাবে তাই গাছে চড়ে ক্লাস করেন।
১০ ভাই-বোনের মধ্যে এই সপ্তম ও অষ্টমজন তাদের পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় ইউনিভার্সিটি অব এল সালভেদর থেকে স্নাতক পাস করার স্বপ্ন নিয়ে এভাবেই লড়ে যাচ্ছেন।
এল তাইগ্রে পাহাড়ে টহলের সময় মাতিলদেকে এভাবে ক্লাস করতে দেখেন স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা কাস্ত্রো রুইজ। তারপরই এই দু'বোনের এমন মর্মস্পর্শী গল্প সবার সামনে আসে।
চলতিপথে পাহাড় চূড়ার জলপাই গাছে বসা এক তরুণীকে দেখে 'আমার প্রথমেই ভাবনা এলো, নিশ্চয়ই ওর কিছু একটা হয়েছে,' এএফপিকে বলেন রুইজ। তিনি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই যা জবাব পেলেন, একদম শিউরে ওঠলেন: 'আমি স্রেফ পড়তে চাই।'
এমন 'ইতিবাচক গল্পে' বিস্ময়-বিমুগ্ধ ওই পুলিশ কর্মকর্তা একটি ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন। সেই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য এই বর্ষা মৌসুমে ওই দুই বোনকে সাপের ছোবল এড়িয়ে, প্রায় এক কিলোমিটার পিচ্ছিল পথ হেঁটে আসতে হয়।
তারা সঙ্গে একটি ফোল্ডেবল টেবিল ও চেয়ার নিয়ে আসেন; আর বৃষ্টির সময় মাথায় ধরে রাখেন ছাতা।
'এখানে এলেই একটুখানি সিগন্যাল পাওয়া যায়; মাঝে মধ্যে অবশ্য তা-ও পাই না,' গাছের চূড়ায় বসেই বলছিলেন মারলেনে। গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার কিংবা এমন ঝোপঝাড়ে ভরা লকলকে ঘাসের আড়ালে থাকা 'বিষাক্ত প্রাণী'র আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয় যে তার করে, সে কথাও অকপটে স্বীকার করলেন।
পড়াশোনার বাইরে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এই বোনেরা রুটি বিক্রি করে তাদের বাবাকে সাহায্য করেন। তার বাবা পেশায় কৃষক।
এদিকে, দেশটির রাজধানী সান সালভাদর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমের এলাকা- ওজো দে আগুয়ার অধিবাসী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এরিক পালাসিয়াসকেও মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে পাথরে আকীর্ণ এক পর্বতের চূড়ায় উঠতে হয়।
'এখানে আসি, কারণ, খেয়াল করেছি, এখানে এলে একটু পরিষ্কার সিগন্যাল পাওয়া যায়,' বলছিলেন বেসরকারি হোসে মাতিয়াস দেলগাদো বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশনস বিভাগে পড়ুয়া ২০ বছর বয়সী পালাসিয়াস।
তিনটা ইটের ওপর বসে, মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হয় তাকে। তাতেও স্বস্তি নেই; কেননা, মশার মারাত্মক উৎপাত।
তিনি ঠিক করেছেন ওই অঞ্চলের অন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদনপত্র পাঠাবেন, যেন ওখানে ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়।
এল সালভাদরকে লম্বালম্বিভাবে প্রায় দুই ভাগ করে দিয়েছে অসংখ্য আগ্নেয়গিরি; আর এ কারণে মোবাইল ফোনের সিগন্যাল পেতে বিঘ্ন ঘটে।
ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটাসের তথ্যমতে, দেশটির ৬৬ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ৬০ শতাংশ।
এদিকে, বুধবার ইউনিসেফ প্রকাশিত এক তথ্যসূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারিতে সারা পৃথিবীতে ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে অক্ষম।
- সূত্র: এএফপি