পদ্মারপাড়ে ৪০ মিনিট
অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে বিশ্বব্যাপী সবকিছু সচল হতে শুরু করলেও মহামারী করোনা ভাইরাসের থাবায় থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। এখনও প্রতিদিন শত শত মানুষ এই মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের এই ভয়াল সময়ে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরেকটা বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে তা হল প্রতিদিন নিয়ম করে অন্ততপক্ষে চল্লিশ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা। আর মহামারীর এই সময়ে শরীরকে সতেজ ও সুস্থ রাখতে নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে হাঁটাহাঁটি করছেন উজ্জীবন পদ্মারপাড় রাজশাহীর সংগঠনের সদস্যরা। লকডাউনের সময়েও তারা ভোরে হাঁটাহাঁটি বন্ধ রাখেননি। এখন পর্যন্ত এই সংগঠনের ৭০ সদস্যদের কেউই করোনায় আক্রান্ত হননি।
খুব ভোরে দিনের আলো ফোটার পর রাজশাহী মহানগরীর সিমলা পার্ক এলাকা দিয়ে কেউ যাতায়াত করলে দেখতে পাবেন একদল বয়স্ক লোক সমস্বরে 'হা হা', 'হো হো' করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন। প্রথমে বুঝতেই পারবেন না আসলে এটা হাসির আওয়াজ। তবে কিছুক্ষণ পরখ করলে বা তাদের কারো সাথে কথা বললে বুঝবেন এটা আসলে মুখের এক ধরনের ব্যায়াম।
সংগঠনের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেল, শুধু এই মুখের ব্যায়াম না, প্রতিদিন ভোরে সবাই সিমলা পার্কে একত্রিত হয়ে নানা ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করেন। গত প্রায় ২০ বছর ধরে তারা প্রতিদিন ভোরে সিমলা পার্কে একত্রিত হয়ে ৪০ মিনিট ধরে ব্যায়াম করছেন। ব্যায়ামের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতন বিষয়ক নানা ধরনের ক্যাম্পেইনের আয়োজন করেন তারা।
সংগঠনের সদস্যরা জানান, প্রতিদিন ভোর ৬টা ২৫ মিনিটে সবাই একত্রিত হন পদ্মারপাড়ের সিমলা পার্কে। ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় ব্যায়াম। চলে ৭টা ১০ মিনিট পর্যন্ত। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে কেউ আছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, কেউ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, কেউ চিকিৎসক, কেউ আইনজীবী। বাদ নেই তরুণরাও।
গত শুক্রবার (২৮ আগস্ট) সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে যখন এই প্রতিবেদক সিমলা পার্কে পৌঁছান ততক্ষণে উজ্জীবন পদ্মারপাড় রাজশাহীর সদস্যরা শুরু করে দিয়েছেন তাদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। উজ্জীবন পদ্মারপাড় লোগো সংবলিত সাদা টি-শার্ট তারা নানা ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করছেন। ব্যায়াম শেষে সবাই মিলে চা চক্র শেষে সকাল ৮ টার দিকে তারা মহানগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী ও রিকশাচালকসহ সাধারণ মানুষদের মধ্যে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেন।
উজ্জীবন পদ্মারপাড় রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন মুক্তিযোদ্ধা একেএম জাহাঙ্গীর রতন। তিনি গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সত্তর বছর বয়স্ক এই গেরিলা যোদ্ধা বলেন, খুব অল্প বয়স থেকেই শারীরিক ফিটনেসের বিষয়ে যত্নশীল ছিলাম। ৭১ মুক্তিযুক্ত চলাকালীন সময়ে প্রাপ্ত গেরিলা প্রশিক্ষণ তা বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে কাজে দিছে। আমি সবসময়ই ভোরে উঠে হাঁটাহাঁটি, বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ব্যায়াম করতাম। ২০০০ সালের দিকে মনে হলো, একা একা শারীরিক ব্যায়াম না করে সবাই মিলে করলেই তো পারি। তারপরই আসলে উজ্জীবন পদ্মারপাড় সংগঠনটি আমরা গড়ে তুলি। শুরুতে পাঁচ/ছয়জন মিলে শুরু করলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। শারীরিক ব্যায়ামের পাশাপাশি আমরা স্বাস্থ্য সচেতনমূলক নানা ধরনের কর্মসূচিও পালন করি। এছাড়া সংগঠনের পক্ষ থেকে দাতব্য বিভিন্ন কাজে আমরা সহায়তা করি।'
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল জানান, সংগঠনের সব সদস্যরা আমরা পরিবারের মতোন হয়ে গেছি। ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে, সিমলা পার্কে এসে পদ্মার পাড়ের সতেজ বাতাস না নিলে আমাদের দিনটা ভালো কাটে না। আমরা আমাদের সংগঠনের মূলমন্ত্র ঠিক করেছি 'নিয়মিত হাঁটুন, সুস্থ থাকুন'। আমরা সবাইকে নিয়েই আসলে সুস্থ থাকতে চাই। সুস্থ থাকলেই না দেশের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে।
সংগঠনের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেল, বেশিরভাগ সদস্যই উজ্জীবন পদ্মার পাড় সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছেন স্ব-ইচ্ছায় ভোরে তাদের কর্মকাণ্ড পরখ করে। তাদের একজন হচ্ছেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউট রাজশাহীর উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহবুবুর রহমান।
তিনি জানান, ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি শেষ করে এসে তিনি এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। তার মতে, ভোরে পদ্মারপাড়ে উজ্জীবিত হতেই এই সংগঠনের সাথে যুক্ত। কারণ শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা আমরা সবাই জানি। প্রধানত শরীরকে সুস্থ ও মনকে চাঙ্গা রাখতেই এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করছি। এখন শারীরিকভাবে বেশ সুস্থ আছি আমি।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ জানান, তিনি ২০১৩ সালে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। প্রধান প্রশিক্ষকের অনুপস্থিতিতে তিনিই প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
আব্দুল লতিফ জানান, এমনিতেই প্রতিদিন ভোরে উঠে হাঁটাহাঁটি আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আগে একাই হাঁটতে বের হতাম। উজ্জীবন পদ্মারপাড়ের সাথে যুক্ত হওয়ার তা বেড়েছে। একা একা হাঁটলে মাঝে মাঝে অলসতা কাজ করে। অথচ অনেকে মিলে সেই কাজটি করলে তখন অলসতা তেমন পাত্তা পায়না। যেহেতু আমার স্কাউটিং করার অভ্যাস ছিলো স্কুলজীবন থেকে সেটাই এখানে কাজে লাগছে।
২০০৭ সাল থেকে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে কর্মরত আব্দুল কুদ্দুস। তিনি জানান, ভোরে ঘুম থেকে উঠে সিমলা পার্কে এসে এক্সারসাইজ না করলে দিনটাই বৃথা হয়ে যায়। এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই অভ্যাস আমাদের শরীর ও মনের জন্য উপকারীই বয়ে আনে।