ছবির গল্প: ইথিওপিয়ান করোনাযোদ্ধাদের জবানবন্দি
পূর্ব আফ্রিকান দেশ ইথিওপিয়ায় প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত হয় ১৩ মার্চ; ৪৮ বছর বয়সী এক জাপানি নাগরিকের শরীরে। তার মতো এমন শারীরিক অবস্থার দেখা কখনো না পাওয়ায় চিকিৎসকরা ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে পারছিলেন না কী করবেন। তবু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে হলো দেশটির সম্মুখ যোদ্ধাদের।
চিকিৎসক, নার্স, পরিচারক, নিরাপত্তাকর্মী, গাড়ি চালক- সবাই এগিয়ে এলেন এই যুদ্ধে। নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিজেদের গৃহবাস, নিজেদের মর্যাদা, এমনকি নিজেদের জীবনের ঝুঁকিও তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে ওঠল।
প্রিয় পাঠক, আসুন, এমন কিছু সম্মুখ যোদ্ধার ছবি দেখা ও কথা পড়া যাক:
আপসনামা
আমি ডা. কালকিদান। জাপান থেকে আসা প্রথম কোভিড-১৯ পজিটিড রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার প্রথম দায়িত্বটি আমার কাঁধেই চেপেছিল।
আচমকাই ঘটেছিল এটা। আমরা আসলে এমন রোগীর প্রত্যাশা করিনি। সুযোগ-সুবিধা প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছিল আমাদের। পোশাক বদলেরও সময় পাইনি আমি। হাসপাতালে এসেছিলাম নিয়মিত দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে। (কোভিড-১৯ রোগীর কথা শুনে) আঁতকে ওঠলাম। সবসময়ই নিজেকে বলি, ভয় পাওয়া চলবে না; তবু নিজের জীবনকে আমার কতটা ভালোবাসা উচিত- সেই কথা ভাবলাম।
ওই রোগীর রক্ত নেওয়ার দরকার ছিলই আমাদের। তার মানে, তাকে আমাদের স্পর্শ করতে হয়েছে। লোকটি নিরন্তর কাঁশছিলেন আর বলছিলেন, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওই অবস্থায় তাকে ছেড়ে যেতে অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। আমি তার ফুসফুস ও হৃপিণ্ডের শব্দ শুনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তা করার উপায় ছিল না।
আমি স্রেফ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
বন্ধুদের বললাম, আমি বোধহয় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। মাকে এ কথা বলতে পারিনি। শুধু বোনকে বললাম।
জীবনের সব অনুতাপ ও ভুল আপনার কাছে এভাবে খুব দ্রুত ধরা দেবে। নৈরাশ্য ও উৎকণ্ঠায় আমি অতীতে ভুগেছিলাম। এই ঘটনা আমাকে সেই পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে নিলো। ভীষণ মুষড়ে পড়লাম আমি।
বলছি না (চিকিৎসা দিতে গিয়ে) আমাদেরকে বেপরোয়া হতে হবে; তবে আমার ধারণা, আমাদের কিছুটা আস্থা রাখা দরকার। আমার মনে হয় না, আমাদের অত বেশি ভড়কে যাওয়ার দরকার ছিল। আমার ধারণা, শুরুতে আমরা খুবই অতিরঞ্জন করেছি। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের পাশে ঈশ্বরও রয়েছেন; তাই না? আমার মনে হয় না, আমাদের এত বেশি মানসিক চাপ নেওয়ার কিছু রয়েছে। আমার ধারণা, আতঙ্কের কারণে আমরা অনেক বেশি আপস করে ফেলেছি।
বন্ধুর ঘৃণা
আমার নাম পুলোস সাইদ। গোরে শহরের এলেবাবর অঞ্চলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
আমি বিবাহিত; এক পুত্র ও দুই যমজ কন্যার পিতা। আমাদের দেশে যখন করোনাভাইরাস মহামারি এলো, সে সময়ে কোতেবে হাসপাতালে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে পাঁচ মাস কাজ করেছি।
ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতিকালে সেখানে লোকবলের ব্যাপক সংকট ছিল; এ কারণে জীবাণুনাশক স্প্রেয়ারের দায়িত্বও নিতে বলা হলো আমাকে। আমি এতটুকুও দ্বিধা করিনি। যতবারই কাজটি করি, মনে হয় যেন ভাইরাসটিকে নির্মূল করছি; আর তাই ভীষণ গর্ব হয় আমার।
তবে এ কাজের দাম আমাকে চুকাতে হয়েছে। দুপুরের খাবারের সময় যে বন্ধুরা সচরাচর আমার সঙ্গে বসতেন, তারা আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। তারা আমাকে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে মিনতি করলেন, যেন তাদের ধারে-কাছে যাওয়ার চেষ্টা না করি। এই ঘটনায় আমার মন ভেঙে গেছে ঠিকই, তবে এই কাজের উদ্দেশ্য আমি খুঁজে পেয়েছি।
এই যজ্ঞ কবে যে শেষ হবে, তর সইছে না; কেননা, তাহলে আমি আমার সন্তানদের দেখতে পাব।
নীল বেদনা
আমার নাম মাকেদা। এখন পর্যন্ত আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনটি হলো, যেদিন আমরা আমাদের প্রথম রোগীকে হারিয়েছি।
মায়েরা তাদের সন্তানদের দূরে রাখছেন; এই (কোভিড-১৯-এর) কারণে পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; মরার পর কবর পাবেন- সেই নিশ্চয়তা কারও নেই।
আমরা আমাদের আনন্দের অনুভূতি হারিয়ে ফেলছি। যেদিন থেকে আমি করোনাভাইরাসের কথা ভাবছি, সেদিন থেকেই চিন্তা হচ্ছে আমার পরিবার ও ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিয়ে।
ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, এ হাসপাতালে মা কিংবা বন্ধুরা আমার পাশে এসে বসবেন, এই নিশ্চয়তা আমাকে কেউ দিতে পারবে না। এ খুবই বেদনার অনুভূতি।
খুব সম্ভবত জীবনের প্রথমবার নিজের দেশকে নিয়ে ভাবছি আমি। তবে যতক্ষণ বেঁচে আছি, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাব; কেননা, আমার এখানে থাকার একটা উদ্দেশ্য রয়েছে।
জীবনে ফেরা
আমি ডা. রেডিয়েট। একদিন চিকিৎসকদের সঙ্গে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন ও রোগী হস্তান্তরের দায়িত্ব সামলানো শেষে আমরা জানতে পারলাম, রোগীরা আমাদের সাহায্য চাইছেন। আমার তখন ছুটি। অ্যাপ্রোন প্রায় খুলে ফেলেছি। তবু ছুটে গেলাম রোগীদের কাছে। টের পেলাম, আতো তেসফায়ে নামের রোগীটির শরীরে পালস নেই, হৃৎস্পন্দন নেই, রেডিয়াল পালসও নেই।
আমি তার জন্য শয্যা ঠিক করলাম। তারপর শুরু করলাম সিপিআর (বুকে চাপ দিয়ে দম ফেরানোর শেষ চেষ্টা)। ব্যাপারটি ইমার্জেন্সি ছিল বলে, বাঁচানো সম্ভব রোগীকে আমাদের সিপিআর করারই ছিল। তখনো আমার পরনে পুরো সুরক্ষা সামগ্রী ছিল; তাই সিপিআর করা আমার জন্য অসুবিধার ছিল না।
আমরা দুই চক্রে চেস্ট কমপ্রেশন করলাম এবং তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলাম। আমাদের সৌভাগ্য, রোগীদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনার শব্দ আমরা শুনতে পেয়েছিলাম।
দায়িত্ববোধ
আমার নাম ডেমোজ। করোনাভাইরাসের আগে ইকা হাসপাতালে কাজ করতাম। তিন বাচ্চা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকি।
আমার উচ্চ রক্তচাপ; তবু কাজ করা থামাতে পারব না। আমাকে এই দায়িত্ব স্বয়ং ঈশ্বর দিয়েছেন। এটি (করোনাভাইরাস) শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এমন চাপের মধ্যে ফেলে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন তিনি। আমরা (কাজ ফেলে) কোথাও যাব না।
মৃত্যুভয়হীন
আমি ওয়ার্কনে হোরা। দুই সন্তানের পিতা। ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া যুদ্ধে লড়াই করেছি। এখন 'জাতীয় দায়িত্ব' পালন করছি একজন স্প্রেয়ার ও হাসপাতালের প্রহরী হিসেবে।
এই মহামারিতে প্রাণ হারানোদের কবর দেওয়ায়ও আমি হাত লাগাই।
যখন কাজটি শুরু করেছি, মোটেও ভয় লাগেনি। জীবাণুনাশক স্প্রে করা কোনো ব্যাপারই না। আমি তো গুলি নিয়ে যুদ্ধ করে আসা লোক। তাই আমার কোনো মৃত্যুভয় নেই।
- দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ