ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চিকিৎসা সেবা অন্তর্ভুক্ত করে নতুন স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইনের উদ্যোগ
প্রথমবারের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চিকিৎসা সেবা অন্তর্ভুক্ত করে নতুন স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন–২০২৪ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এর ফলে নিবন্ধন ছাড়া কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চিকিৎসা সেবা বা পরামর্শ দেওয়া যাবে না।
একইসঙ্গে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে স্বাস্থ্য নিবন্ধন, পরিচালনা, তদারকি, মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে ফিও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে নতুন খসড়া আইনে।
ইতোমধ্যে আইনের খসড়া প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমে ১৯৮২ সালে প্রণয়ন করা 'দ্য মেডিকেল প্র্যাক্টিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যবোরেটরিজ অর্ডিনেন্স' বাতিল করা হবে।
তবে স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার ছাড়া এ ধরনের আইন গ্রহণযোগ্য ও বাস্তব সম্মত হবে না বলে মনে করেন বিশষজ্ঞারা।
ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিক্স (আইএইচই) এর অধ্যাপক ও দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ডা. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, প্রস্তাবিত আইনে বেশ কিছু ভালো দিক আছে। আবার কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতাও আছে; অনেক কিছু সুনিদিষ্টভাবে বলা হয়নি।
প্রস্তাবিত এই আইনকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, "আইনের কিছু ধারা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কারণ আইনটি জন্মগত ত্রুটি নিয়ে হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে এই আইন থেকে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না।"
তিনি আরও, "প্রস্তাবিত আইনে কিছু বিষয়ে অসম্পূর্ণতা রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যামন চ্যালেঞ্জগুলো এবং সেই অনুযায়ী সংস্কারের বিষয়গুলো এখানে উঠে আসেনি।"
এর আগে, গত ১১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আইনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
কী আছে প্রস্তাবিত আইনে?
স্বাস্থ্য সেবার অভিযোগ গ্রহণ ও নিস্পত্তির লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় 'স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষা কমিটি' নামে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনটিতে। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন হলে, তার প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষা কমিটি-তে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ঘটনার বিষয়ে ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ বা গ্রহণ করা হলে বা কোনো কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনা রেকর্ড করা হলে— উক্ত ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও উক্ত অপরাধ বা ক্ষতি সংশ্লিষ্ট মামলা বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে।
এছাড়া সরকার বিভিন্ন সময়ে গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রদত্ত সেবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ফি ও রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ চার্জ বা মূল্য বা ফি পৃথকভাবে নির্ধারণ করবে।
স্বাস্থ্যসেবার ফি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আদায়যোগ্য চার্জ বা মূল্য বা ফি-এর তালিকা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা চেম্বারের দৃশ্যমান স্থানে রাখার কথা বলে হয়েছে আইনে।
প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়েছে, রোগীর ব্যবস্থাপত্রে সুস্পষ্টভাবে জেনেরিক ওষুধের নাম বড় বড় অক্ষরে লিখতে হবে।
সরকারি বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিরত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে সেবা প্রদানের জন্য নিয়োজিত করলে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অনধিক ৫ লাখ টাকা এবং ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে আইনে।
এছাড়া, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির প্রতি হুমকি প্রদান, ভীতিপ্রদর্শন, দায়িত্ব পালনে বাধাদান, আঘাত করাসহ যেকোনো ধরনের অনিষ্ট সাধন বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি সাধন, বিনষ্ট, ধ্বংস বা উক্তরূপ সম্পত্তি দখল গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ২ বছর কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বলেও এতে উল্রেখ করা হয়েছে।
আইনে বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কোনো চিকিৎসকের ফি, রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গ্রহণ বা প্রদান করলে— সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ন্যূনতম ৩ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা ১ বছরের কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
খসড়া আইনের বিরোধী মতামত
এদিকে, গত বোরবার প্রস্তাবিত আইন নিয়ে এক অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্টার বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের আগে স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করা উচিত হবে না।
তারা মনে করেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই আইনের খসড়ায় অনেক জটিলতা, অসংগতি এবং অগ্রহণযোগ্য ধারা রয়েছে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের পর এই আইনকে আরও সুসংগঠিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলা ভবনে 'স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন–২০২৪ প্রণয়নকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ' নিয়ে পর্যালোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্ম বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের আয়োজনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় ঢাবির স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ খসড়া আইনে উল্লিখিত ধারার বিশদ ভুল ও অস্পষ্টতা তুলে ধরেন। এ আইনের নানান দুর্বলতা ও সমাধানে করণীয় উঠে আসে তার আলোচনায়।
প্রস্তাবিত খসড়াটি পূর্ণাঙ্গ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, "হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য সেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং রোগী উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে এমন আইন প্রণয়নে জোর দিতে হবে। বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবগুলোকে এক জায়গায় করা হয়েছে। পর্যালোচনা ছাড়াই এটি প্রস্তুত করা হয়েছে।"
"এছাড়া আইনে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আলাদা করা হয়েছে। হাসপাতালের সংজ্ঞায়ও বিভ্রান্তি রয়েছে— যা কোনোভাবেই কাম্য না," বলেন তিনি।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, "খসড়া প্রস্তাবনায় বহু ফাঁক-ফোকর রয়েছে। এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা ও সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হয়নি। এই আইন বাস্তবায়ন হলে চিকিৎসক ও রোগী কোনো পক্ষই উপকৃত হবেন না।"
তিনি বলেন, "স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষার নামে সবগুলো আইনেই কেবল চিকিৎসকদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। রোগীর সুরক্ষার কথা সবগুলো আইনে নেই। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে আদালত সরাসরি আমলে নেবে না। চিকিৎসকদের নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে তাদের পাঠানো প্রতিবেদন পেলে আইন অনুযায়ী আদালত তখন তা আমলে নেবে কি-না, তা দেখবে। চিকিৎসকদের সুরক্ষার পাশাপাশি রোগীদেরও সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।"
চিকিৎসক ডা.আব্দুন নূর তুষার বলেন, "আমরা যে খসড়া নিয়ে আলোচনা করছি, তা স্বৈরাচারের আমলে তৈরি করা। আমি এখানে অন্তত ৪০টি ভুল ও হাস্যকর বিষয় দেখাতে পারব। যারা এটি করেছেন, তারা কোনো গবেষণা করেননি। এটি একটি আবর্জনা। এটি নিয়ে আলোচনা করা মানে আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করা।"
হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ রাব্বী বলেন, "এখানে কাউকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। এটি একটি দায়–সারা কাজ। এখানে মোবাইল কোর্টের বিষয়টি আনা হয়েছে, যা যুক্তিযুক্ত নয়।"
"প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী বলা যায়, হাসপাতালে দালালি থাকতে পারবে না। আবার একইসঙ্গে বিদেশি হাসাপাতালের এজেন্ট নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে," যোগ করেন তিনি।