ছাত্র আন্দোলনে নিরব থাকায় দুঃখ প্রকাশ সাকিবের
গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটারই। রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু যে দুজনের কাছ থেকে সবার প্রত্যাশা ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান ছিলেন নিরব ভূমিকায়। এ কারণে সেই সময়ে চরম সমালোচিত হন এই দুই ক্রিকেটার। এ দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থী হিসেবে গত জানুয়ারিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নিরব ভূমিকা পালনের জন্য আন্দোলন শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর দুঃখ প্রকাশ করেন মাশরাফি, মেনে নেন ব্যর্থতা। সাবেক এই অধিনায়ক তুলে ধরেন নিজের রাজনৈতিক অবস্থানও। এবার সাকিবও সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বুধবার নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক থেকে এ নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার।
ভারত সফরে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব। শেষ টি-টোয়েন্টি খেলে ফেলার কথা জানালেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঘরের মাটিতে শেষ টেস্ট খেলার আগ্রহ প্রকাশ প্রকাশ করেন তিনি। হত্যা মামলায় আসামী হওয়ায় দেশে ফিরে খেলতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চান তিনি। নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়তে পারার নিশ্চয়তাও চান সাকিব। কিন্তু বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বক্তব্যে সাকিবের দেশের মাটি থেকে বিদায় নেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
বিসিবি সভাপতি জানান, সাকিবকে এককভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য বিসিবির নেই। কদিন পরে ক্রীড়া উপদেষ্টা জানান, ফ্যাসিস্ট সরকারের সংসদ সদস্য হওয়ায় সাকিবের বিরুদ্ধে জনমনে তৈরি হওয়া ক্ষোভের বিপরীতে তার নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চাওয়ার ব্যাপারটি অবান্তর। একই সঙ্গে সাকিবকে রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কারের আহ্বান জানান তিনি। যদিও কদিন পর তাকে দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানান আসিফ মাহমুদ।
এর কদিন পরে রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করাসহ দুঃখ প্রকাশ করলেন সাকিব। আন্দোলনের দুই মাস পর দেওয়া পোস্টে বাংলাদেশ অলরাউন্ডার লিখেছেন, 'আসসালামু আলাইকুম, আমার দেশের প্রতিটি মানুষের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা। আমার প্রতি আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসা আমাকে আজকের এই সাকিব আল হাসান হিসেবে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত করেছে। শুরুতেই আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সে সকল আত্মত্যাগকারী ছাত্রদের, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন।'
'তাদের প্রতি এবং তাদের পরিবারের প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা। যদিও স্বজনহারা একটি পরিবারের ত্যাগকে কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ করা সম্ভব না। সন্তান হারানো কিংবা ভাই হারানোর বেদনা কোন কিছুতেই পূরণযোগ্য নয়। এই সংকটকালীন সময়টাতে আমার সরব উপস্থিতি না থাকায় আপনারা যারা ব্যথিত হয়েছেন বা কষ্ট পেয়েছেন, তাদের অনুভূতির জায়গাটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং এ জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এভাবে মনঃক্ষুণ্ন হতাম।' লিখেছেন তিনি।
রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরে সাকিব লিখেছেন, 'আমি খুবই স্বল্প সময়ের জন্য মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলাম। আমার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়াটা ছিল মূলত আমার জন্মস্থান অর্থাৎ আমার মাগুরার মানুষের উন্নয়নের জন্য সুযোগ পাওয়া। আপনারা জানেন যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট কোন দায়িত্ব ছাড়া নিজের এলাকার উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখাটা একটু কঠিন। আর আমার এই এলাকার উন্নয়ন করতে চাওয়া আমাকে সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী করে। যাইহোক, দিনশেষে আমার পরিচয় আমি একজন বাংলাদেশের ক্রিকেটার। আমি যখন যেখানে যে অবস্থাতেই থেকেছি অন্তর থেকে ক্রিকেটাকেই ধারণ করেছি।'
ভক্ত-সমর্থকদের সমর্থনের বিষয়টি উল্লেখ করে সাকিব লিখেছেন, 'এই ক্রিকেটকে ধারণ করে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের সম্মান অর্জন করার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন আপনারা। আপনাদের ভালোবাসা এবং সমর্থন আমাকে আজকের সাকিব আল হাসান বানিয়েছে। আমি যখন দেশের জন্য ক্রিকেটের মাঠে ব্যাট ধরেছি, তখন আমার সাথে ব্যাট ধরেছেন আপনারা সবাই। গ্যালারি থেকে আপনাদের চিৎকার, আপনাদের সমর্থন আমাকে ভালো খেলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ক্রিকেট ম্যাচের দিন চায়ের দোকানে টেলিভিশনের সামনে উপচে পড়া ভিড় আমাকে শক্তি যুগিয়েছে। আমি জিতলে, আপনারা সবাই জিতেছেন। আমি হেরে গেলে, হেরে গেছেন আপনারা সবাই।'
দেশের মাটিতে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলার কথা জানিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, 'আপনারা জানেন, খুব শিগগিরই আমি আমার শেষ ম্যাচটি খেলতে যাচ্ছি। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আজকের সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠা পর্যন্ত এই পুরো জার্নিটাকে ড্রাইভ করেছেন আপনারা। এই ক্রিকেটের এই গোটা গল্পটা আপনাদের হাতেই লেখা! তাই আমার শেষ ম্যাচে, এই গল্পের শেষ অধ্যায়ে, আমি আপনাদেরকে পাশে চাই।'
'আমি আপনাদের সবাইকে সাথে নিয়ে বিদায় নিতে চাই। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর হাতে হাত রাখতে চাই, যাদের হাতের তালি আমার ভালো খেলতে বাধ্য করেছে। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর চোখে চোখ রাখতে চাই, আমার ভালো খেলায় যাদের চোখ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। আবার আমার খারাপ খেলায় যাদের চোখ ছলছল করেছে। আমি আশা করি, শুধু আশা না বিশ্বাস করি, এই বিদায় বেলায় আপনারা সবাই আমার সাথে থাকবেন। সবাই সাথে থেকে সেই গল্পের ইতি টানবেন, যে গল্পের নায়ক আমি নই, আপনারা।' যোগ করেন সাকিব।