নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও গোপনে জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী লবিতে টাকা দিচ্ছে জ্বালানি জায়ান্টেরা
পৃথিবীব্যাপী অতিমারির প্রকোপের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বনাশা বাস্তব হুমকির কথাটা ভুলে গেছেন সিংহভাগ মানুষ। চিরায়ত আবহাওয়া ও মৌসুমি চক্রের স্থায়ী এবং প্রলয়ঙ্করী এ বদল আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ইতোমধ্যেই পরিবর্তন আনছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে; সংঘাত আর অস্থিরতার নতুন ক্ষেত্র।
চলতি বছরের গোঁড়ার দিকেই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আরোপিত বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের জন্য তদ্বির করা কিছু প্রভাবশালী শিল্পজোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি- বিপি এবং শেল। এসব শিল্পজোট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ি।
ব্রিটিশ পেট্রোলিয়া- বিপি এবং রয়্যাল-ডাচ শেল কার্বন নিঃসরণ নিয়ে বাণিজ্যিক স্বচ্ছতার অঙ্গীকার করে। এর আওতায় পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিকারী গ্যাসের নিঃসরণ, আগামী কয়েক দশকের ভেতর শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলেছে কোম্পানি দুটি।
গতবছর আয়ের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় ও চতুর্থ কোম্পানির স্থানে ছিল বিপি এবং শেল। জ্বালানিখাতের জায়ান্ট দুটি এখনও সংশ্লিষ্ট শিল্পের আটটি লবি গ্রুপের সদস্য। এসব জোট অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবসা বৃদ্ধিতে তদ্বির করে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম হাফিংটন পোস্টের এক সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে আসে। সেখানে জানানো হয়, প্রভাবশালী মহলে জোটগুলির তব্দির প্রক্রিয়া এত গোপনীয় যে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না।
তবে ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি ও বিদ্যমান কিছু প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, এ আটটি শিল্পজোটে অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য সংস্থা যোগ দিয়েছে। প্রতিনিয়তই তার ফরে এদের কলেবর বাড়ছে। নতুন শক্তিতে ভর করে তারা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর যেকোনো উদ্যোগকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে।
অবশ্য বিপি এবং শেল জানায়, আলোচিত শিল্পোজোট সমূহে সংস্কার করা হবে, এমন আশাতেই তারা সেখানে যোগ দিয়েছিল। ইতোমধ্যেই, জোট সদস্যপদ নিয়ে তারা একটি পর্যালোচনা শুরুর কথাও জানায়। তবে বিপি এবং শেল তারা মোট কতগুলো এমন গোপনীয় শিল্পজোটের সদস্য তার তালিকা প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায়।
এব্যাপারে বিপি'র বিবৃতিতে বলা হয়, ''জোট সদস্য হিসেবে কোথাও যদি আমাদের সঙ্গে অন্যদের মতের অমিল হয়; তাহলে নিজেদের নীতি অনুসারে আমরা সকলকে প্রভাবিত করে যৌথ সংস্কার আনার চেষ্টা চালিয়ে যাব। তবে এধরনের কাজে অনেক সময় লাগে।''
সংস্থাটি আরও জানায়, ''জোটের অন্যদের সমঝোতায় রাজি করাতে ব্যর্থ হলে, আমরা জনসম্মুখে সেসব মতবিরোধের বিষয় প্রকাশ করব। পাশাপাশি, বড় ধরণের মতভেদ দেখা দিলে এবং আলোচিত জোট তা নিরসনের উদ্যোগ না নিলে- আমরা তার সদস্যপদ ত্যাগ করব।''
শেলের একজন মুখপাত্র বলেন, আমাদের আগামী পর্যালোচনায় সংশ্লিষ্ট সকল শিল্প সংস্থার সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরা হবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমরা যে অঙ্গিকার করেছি, তারা সেটা মেনে চলছে কিনা-আমরা তা খতিয়ে দেখব।''
এসময় তিনি আরও জানান, ''কিছু শিল্পজোট তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের অঙ্গীকারের কারণে বিনিয়োগকারী এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া, এসব জোট এমন কিছু দেশে ব্যবসা করে যেখানকার জ্বালানি বাজার অত্যন্ত আকর্ষণীয়।''
এই দুটি কারণেই শেল জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর বিরুদ্ধে কাজ করা আলোচিত আটটি জোটে যোগ দিয়েছে, এমন ইঙ্গিত দেন তিনি।
তবে হাফিংটন পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, ইতোপূর্বে দেওয়া কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতির মতো এটাও এক ফাঁপা বুলি। জ্বালানি জায়ান্ট দুটি জেনেশুনেই এসব শিল্পজোটে অর্থ দিচ্ছে- যাতে তারা নানা দেশের সরকার এবং সংস্থায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবসা প্রসারে সাহায্য করে।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রে বিপি এবং শেল উভয়েই অ্যালায়েন্স অব ওয়েস্টার্ন এনার্জি কনস্যিউমারস-এর মতো জোটের সদস্য। এই জোটটি ইতোপূর্বে অরিগন রাজ্যের কার্বন নিঃসরণের উপর মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগটি নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়। তারা টেক্সাস ওয়েল আন্ড গ্যাস অ্যাসোসিয়েশনের-ও সদস্য। এই সংস্থাটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী রাজ্যে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ রুখে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ, মিথেন আমাদের বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক একটি গ্যাস।
সদস্য হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় দুটি বৃহৎ জোটকে অর্থায়ন করে বিপি এবং শেল। এরা হচ্ছে; অস্ট্রেলিয়ান পেট্রোলিয়াম প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং বিজনেস কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়া। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে নিঃসরণ কমানোর যে প্রতিশ্রুতি অস্ট্রেলিয়া করেছে, তা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে এদুটি জোটের লবিং।
এছাড়াও, শেল কুইন্সল্যান্ড রিসোর্স কাউন্সিলের গোপন সদস্য। এই জোটটি পৃথিবীর বৃহত্তম কয়লা খনি স্থাপনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদের নিয়ে গবেষণা করা ব্যক্তিত্ব এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুবার্ট ব্রলে জানান, ''জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবসায় এ দ্বিচারিতা এখন প্রতিষ্ঠিত কৌশল। তারা দুই দিকেই থাকতে চাইছে। জনগণের কাছে সামাজিক দায়িত্ব পালন নিয়ে তাদের আন্তরিকতা তুলে ধরার জন্যেই শূন্য নিঃসরণের অঙ্গীকার। আসলে তারা নিজেদের বাণিজ্যিক অবস্থা পরিবর্তন করতে চায় না।''
- সূত্র: হাফিংটন পোস্ট