এশিয়ার পুরো এক প্রজন্মের স্বপ্ন কেড়েছে কোভিড-১৯
কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে ইতিবাচক চিত্র দেখা গেছে এশিয়ার দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিতে, যার কল্যাণে পিতামাতার চাইতেও উন্নত জীবন-যাপন এবং বেশি আয়ের সুযোগ পান তাদের সন্তানেরা।
উন্নতির সেই ধারাতে চিড় ধরায় কোভিড। বিপুল সংখ্যক এশীয় তরুণ এখন চাকরি হারাচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ ১৫-২৪ বছর বয়সী এশিয়ার বিকাশমান এসব অর্থনীতির বাসিন্দা।
অতিমারিতে তরুণদের চাকরি হারানোর গতিও অবিশ্বাস্য। আগের প্রজন্মের চাইতেও অনেক দ্রুত কাজের জায়গা থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন তারা।
এর প্রধান কারণ; প্রায় অর্ধেক তরুণের কর্মস্থল যে চারটি খাত, সেগুলো মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। খাতগুলো হলো; পাইকারি এবং খুচরা ব্যবসা, উৎপাদন, বাণিজ্যিক সেবা, আবাসন ও আতিথয়তা এবং খাদ্য পরিবেশন।
তাই কর্মজীবনে প্রবেশ করা নতুন প্রজন্মের জনগোষ্ঠীই পড়ছেন বেকারত্বের অন্ধকূপে।
এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বেকার হচ্ছেন অপেক্ষাকৃত নিম্ন পদে কাজ করা তরুণীরা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সাম্প্রতিক এক যৌথ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায়। সেখানে বেকার এ প্রজন্মকে 'লকডাউন জেনারেশন' বলে উল্লেখ করে তাদের আর্থ-সামাজিক পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
স্বাবলম্বী জীবন গড়ার স্বপ্ন যাদের ভেঙ্গেছে, তাদেরই একজন হলেন ব্যাংককের ২৬ বছরের তরুণী পাভিসা কেতুপানইয়া। বাবার মতোই বাণিজ্যিক বিমানের পাইলট হওয়ার লক্ষ্য ছিল তার। সেই সনদও অর্জন করেন নিজ প্রচেষ্টায়। কিন্তু, মহামারির আকস্মিক আঘাত সেই স্বপ্ন চুরমার করে দেয়।
পাভিসা বলেন, ''পাইলট হওয়ার সনদ পেয়ে অনেক আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম ভালো আয় এবং জীবনমান অর্জনে এটা আমার স্বপ্নের চাকরি হবে।''
কিন্তু, মহামারির কারণে বিদ্যমান কর্মীদেরই ছাটাই করেছে বিশ্বের অনেক এয়ারলাইন্স। বাণিজ্যিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কঠিন এ সময়ে নতুন কর্মী নিয়োগ তাদের কাছে এমুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই পাইলটের চাকরি পাননি পাভিসা। বাধ্য হয়ে কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য নির্ভর করছেন তার নিজের শখ ভুরু সৌন্দর্য বর্ধনের কাজের উপর।
'পাইলট হলে যে অর্থ আয় করতাম এখন তার থেকে অনেক কম আয় করি। তবে সম্পূর্ণ আয়শূন্য থাকার চাইতে কিছু উপার্জন করা ভালো,' তিনি বলছিলেন।
বিপর্যয়ের অগ্রভাগে তরুণ কর্মীরা:
পূর্ণবয়স্কদের চাইতে মহামারিতে বিপর্যয়ের শিকার খাতে তরুণ কর্মীদের সংখ্যাই বেশি, বলে জানিয়েছে আইএলও। সংস্থাটি ১৫-২৪ বছর বয়সীদের তরুণ এবং ২৫ বা তার বেশি বয়সী কর্মীদের পূর্ণবয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এশীয় অর্থনীতিগুলোর প্রায় সব কয়টিতেই তরুণদের কর্মসংস্থানে ভাটা দেখা দিয়েছে। চলতি বছর একারণে আলোচিত অঞ্চলের ১৩টি দেশে প্রায় দেড় কোটি কিশোর ও তরুণ বেকার হয়ে পড়বে, বলে জানিয়েছে এডিবি ও আইএলও প্রতিবেদন।
বৈশ্বিক সঙ্কট:
তরুণদের কর্মসংস্থান বৈশ্বিক সঙ্কট হয়ে উঠলেও, এশীয় বিকাশমান অর্থনীতিগুলো প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অপেরক্ষাকৃত তরুণদের আয় ও ব্যয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ছিল ভোক্তা চাহিদা বাড়ার আরেক নিয়ামক। উদ্দীপ্ত সেই চক্র এখন হুমকির মুখে। সার্বিক বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও যা ক্ষতিকর।
কারণ, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতির মোট প্রবৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশ অর্জনে অবদান রাখে। এই অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোও ১৯৬০ সালের পর এই প্রথম চলতি অর্থবছরে সঙ্কোচনে পড়ছে।
এই পূর্বানুমান নয়া দিল্লির বাসিন্দা ১৭ বছরের নাভিশা আলীর মতো তরুণীদের আশার আলো কেড়ে নিয়েছে। গত ছয় মাস ধরে গতানুগতিক একটি চাকরি পাওয়ার আশায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরেছেন তিনি। মহামারির আগে তিনি একটি ছোট পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। মহামারির পর থেকেই বেকারত্ব তার সঙ্গী হয়েছে।
নাভিশার চাকরি ছিল তার পরিবারের শেষ ভরসার স্থল। বছর তিনেক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা পঙ্গু হয়ে পড়লে, তখন স্কুলের পাঠ চুকিয়ে সংসারে দু'পয়সা যোগান দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
পোশাক কারখানায় কাজ করে মাসে সাড়ে হাজার ভারতীয় রুপি বা ৭৫ মার্কিন ডলার আয় করতেন। যৎসামান্য এ আয়ের পুরোটাই ব্যয় হতো; তার বাবা- মা আর চার ছোট ভাইবোনের সংসারে।
এখন নাভিশার আয় নেই। তার ১৬ এবং ১৪ বছরের দুই বোনও এখন বিদ্যালয় ছেড়ে কাজের সন্ধান করছে।
নাভিশার চোখেমুখে তাই শোকের রেখা। তিনি বলেন, ''ওরা আমার কাছে সেলাইয়ের কাজ শিখছে। পোশাক কারখানায় কাজ করে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা দিয়েই ওদের প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা করছি।''
দারিদ্র্যের নতুন জাল:
কোভিড-১৯ এর ধাক্কা নতুন এক শ্রেণির দরিদ্র তৈরি করছে; সমগ্র পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বিশ্বব্যাংক জানায়, একারণে অত্র অঞ্চলের তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়বে।
এব্যাপারে সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবার ও জনসংখ্যা গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ওয়েই-জুন জিন ইয়ং সতর্ক করে বলেন, এই সঙ্কটের কারণে অভিভাবকদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে এমন প্রভাব পড়বে, যা আগের কোনো কর্মসংস্থান সঙ্কটের সময় দেখা যায়নি।
একথার মধ্যে দিয়ে তিনি সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং অপরাধ প্রবণতার দিকে তাদের ঝুঁকে পড়ার বিপদ সম্পর্কেও ইঙ্গিত দেন।
''এবার সবদিক থেকেই অবস্থার অনেক অবনতির আশঙ্কা করছি। কারণ, নানাদিক থেকে একসঙ্গে সব বিপদ ধেয়ে আসছে। তাছাড়া, বিপদ দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে, যার কারণে তরুণদের পরিণতিও মারাত্মক হতে বাধ্য,'' তিনি যোগ করেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- অনুবাদ: নূর মাজিদ