কেমন এখন করোনার এই প্রাণঘাতী চরিত্র
খালি চোখে দেখা যায় না জীবাণুদের, এতটাই ক্ষুদ্র তারা। অসংখ্য জীবাণুর মধ্যেই আমাদের বসবাস। তারপরও, সেই অণু পরিমাণ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আমাদের জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বদলে দিয়েছে পরিচিত পৃথিবীকে।
ভাইরাসের হুমকি মানব সভ্যতা আগেও মোকাবিলা করেছে, মহামারি এসেছে প্রতি শতাব্দীতে। কিন্তু, তাতে পুরো পৃথিবী ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করতে বাধ্য হয়নি। শীতকালীন ফ্লু প্রতিবছরই হানা দিত। তার জন্য কখনো শাটডাউনের কথা শোনা যায়নি।
নতুন করোনাভাইরাস ফ্লু সৃষ্টিকারী জীবণুর মতোই ইনফ্লুয়েঞ্জা সৃষ্টিকারী অণুপ্রাণ, যা আমাদের ফুসফুসকে সরাসরি আক্রান্ত করে। কিন্তু, কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে হুমকি এত মারাত্মক? জৈবিক গঠনের কোন ভিন্নতার কারণে এটি আমাদের শরীর এবং জীবনের জন্য নতুনতর হুমকি?- এসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন।
ধোঁকা দেওয়ার পারদর্শিতা:
সংক্রমণের প্রথম স্তরে জীবাণুটি আমাদের শরীরকে বোকা বানাতে পারে। করোনাভাইরাস ফুসফুস এবং শ্বাসযন্ত্রে অবাধে চলাচল করলেও, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মনে করে; সবকিছু ঠিকঠাক'ই তো চলছে!
''জীবাণুটি প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। নাসারন্ধ্রে সংক্রমণের আস্তানা গড়ে তোলার পরও, সুস্থ আছেন এমন অনুভূতি আপনার হতে পারে,'' বলছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল লেহনার।
সাধারণত কোনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলেই, মানবদেহের কোষগুলো ইন্টারফেরন নামে এক ধরনের রাসায়নিক মুক্ত করে। শরীরের সুস্থ অংশ এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি যা এক ধরনের বিপদ সংকেত এবং একইসঙ্গে সাহায্য প্রার্থনা।
এখানেই করোনাভাইরাসের আশ্চর্য ক্ষমতা। ধোঁকা দেওয়ার পদ্ধতিটিও চমৎকার। শরীরের কোষীয় রাসায়নিক ত্যাগ বন্ধ করার ক্ষমতা আছে এ ভাইরাসের।
লেহনার জানান, 'এত পারদর্শিতার সঙ্গে সার্স কোভ-২ জীবাণু কাজটি করে, যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না- যে তিনি আসলে অসুস্থ।'
গবেষণাগারে মানব কোষের নমুনায় করোনাভাইরাস যুক্ত করে দেখা যায়, সংক্রমনের ফলে তারা যে আক্রান্ত এমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। অথচ সঙ্গেসঙ্গেই করা পরীক্ষায় জীবাণুর মাতাত্মক উপস্থিতি ধরা পড়ে।
'ভাইরাসটি যেভাবে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বোকা বানায়- এটি তার অন্যতম একটি প্রক্রিয়া'- বলে জানিয়েছেন লেহনার।
আকস্মিক হামলাকারী ঘাতক:
সংক্রমণের একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। ওই অবস্থা সৃষ্টির একদিন আগেই অবশ্য শরীরে জীবাণুর সংখ্যা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়। এরপরও, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো জরুরি অবস্থা তৈরিতে কোভিড-১৯ এক সপ্তাহ সময় নেয়।
লেহনারের মতে, জীবাণু বিবর্তনের এ এক বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। আশ্রয়গ্রহণকারীর শরীরে দীর্ঘসময় অবস্থান করা এবং সেখানে বংশবিস্তারের সুযোগ এতে অনেকগুণ বাড়ে। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থতা বুঝতে অনেকটা সময় নেন। তিনি বিছানায় পড়ে না থেকে স্বাভাবিক চলাচল বজায় রাখেন। এতে ভাইরাসের জন্য সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করার সক্ষমতা বাড়ে।
তিনি বলেন, জীবাণুটি যেন এক বিপজ্জনক গাড়িচালক, যে মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে পরবর্তী শিকারের সন্ধান করতে থাকে। আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, মৃত্যুঝুঁকিও থাকে- কিন্তু তা নিয়ে খ্যাপাটে চালকের মতোই পরোয়া করেনা করোনাভাইরাস।
''আপনার জীবন-মরণ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। কারণ, এটি 'হিট অ্যান্ড রান' গাড়িচালকের মতোই বিপথগামী আততায়ী,'' লেহনার যোগ করেন।
ইতোপূর্বে, ২০০২ সালে করোনাগোত্রের আরেক জীবাণু সার্স ভাইরাস হানা দিয়েছিল। তার তুলনায় নতুন ভাইরাসের ঘাতক এ বৈশিষ্ট্য অনেক আলাদা। সার্সে সবচেয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কয়েক দিনের মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন, ফলে সহজেই তাদের 'বিচ্ছিন্ন' রেখে চিকিৎসা দেওয়া যেত।
জীবাণু এত নতুন যে আমাদের শরীর মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়:
শেষবার মহামারির কথা কবে শুনেছেন মনে করতে পারেন কী? প্রশ্নটা সহজ নয়। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু'র এইচ১এন১ ভাইরাস ঘিরে মহামারির আশঙ্কা করা হয়েছিল বিশ্বজুড়ে।
তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণার মতো প্রাণঘাতী এটি হয়ে উঠতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কারণ, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দেহে জীবাণুটি প্রতিরোধের কিছুটা সক্ষমতা ছিল। কারণ, সোয়াইন ফ্লু;র জীবাণুর বংশক্রমের সঙ্গে অতীতে সংক্রমণ ছড়ানো অন্য করোনাভাইরাসের অনেক মিল ছিল। ফলে বয়স্কদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটাও অনেক আগেই গড়ে ওঠে।
সর্দি-কাশির মতো উপসর্গ সৃষ্টিকারী চারটি করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানে মানুষ। ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ট্রেসই হাস্সল বলেন, ''অতিমারি সৃষ্টিকারী জীবাণুটি একদম নতুন, তাই আমাদের শরীর এর আক্রমণ মোকাবিলায় মোটেই প্রস্তুত নয়।''
সার্স কোভ-২ একারণেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য বড় এক ধাক্কা বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অতীত থেকে এমন সংক্রমণের পর কী হয়েছিল- সে সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। হাজার হাজার বছর ধরে আটলান্টিকের ওপাড়ে দুই আমেরিকা মহাদেশের মানুষ গুটিবসন্তের শিকার হয়নি কখনও। ১৪ শতকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদিরা এ জীবাণু তাদের সঙ্গে করে নিয়ে যায় নতুন দুনিয়ায়। এর ফলে কোনো প্রকার প্রতিরোধ সক্ষমতাহীন স্থানীয় অধিবাসীরা দলে দলে মারা পড়েছিল। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাদের অনেক বড় জনপদ।
আমাদের শরীরে অপরিচিত জীবাণুরা সবসময় এক বড় হুমকি। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এমন জীবাণু শনাক্ত করতেও অনেক সময় নেয়। এবং শনাক্ত করা গেলেও অধিকাংশ সময় কার্যকর প্রতিরোধ গড়েও ওঠে না।
- সূত্র: বিবিসি