মৃত্যুর মিছিল
২৬.
লিসার টেক্সটের জবাব দেয়ার পরপরই ফের জেএফকের ফিরতি ফ্লাইটে ওঠার সময় হলো। আরও একবার ফার্স্টক্লাসে টিকেট আপগ্রেড করার পেছনে পয়সা খসল তারিকের।
পাস্তা নিয়ে খাবার সেরে পানীয় গলায় ঢালল তারিক। এয়ার হোস্টেসের কাছে একটা উষ্ণ তোয়ালে চাইল। একথায় ওর দিকে ফিরে তাকাল আনিকা। 'তোমার কাঁধের কয়েকটা জায়গা মোছা হয়নি,' ওকে বলল তারিক। 'হাজার হোক ভয়ানক একটা ঘটনার পর তোমার দক্ষতার ব্যাপারে লিসা ভুল ভেবে বসুক, চাই না।'
'ভয়ানক ঘটনা ছিল কিনা তুমি জানলে কিভাবে?' জানতে চাইল আনিকা। 'আমাকে যারা আটকে ছিল তাদেও কারও নাকের ঘা থেকে রক্তও তো ঝরতে পারে। আমি হয়তো তাকে স্রেফ সাহায্য করতে গিয়েছিলাম।'
'হ্যাঁ, তুমি তো বরাবরই পরোপকারী! এবার, থুতনিটা একটু উঁচু করো, হ্যাঁ, ডানে ঘোরো।'
ওর কথামতোই করল আনিকা। ওর চোয়ালের কিনারে মর্চে রঙ দুটো রক্তের দাগ দেখতে পেল তারিক। ঠিক ওর সরু, নাজুক কাঁধের উপরে। আলগোছে শুকনো রক্ত মুছে দিল ও। মসৃণ, নিখুত ওর ত্বক।
ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল আনিকা।
'বিশ্বাস করো বা না করো,' বলল তারিক, 'মনে হচ্ছে আঁচড় খেয়েছ।'
'সত্যি?'
'সত্যি।'
কিছুটা পরিহাস, কিছুটা আমন্ত্রণ মেশানো হাসল আনিকা। 'এ ব্যাপারে কি করবে ভাবছ?'
'ভাবছি ওজায়গাটায় চুমু দিয়ে ভালো করে দিই,' বলল ও।
আস্তে করে ডান হাতে দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ওকে আস্তে নিজের দিকে টানল তারিক। ওর গাল, চোয়ালরেখা আর কাঁধে চুমু খেল। স্বাদু একটা মুহূর্তের জন্যে ওর কাঁধে মুখ দাবিয়ে রেখে ঠোঁটের দিকে এগোল মুখ বাড়াল।
হয়তো টানা কয়েকটা দিন দৌড়ের উপর থেকে, গুলি পিছু ধাওয়া করে ফেরায় ওকে স্পর্শ করার নিখাদ পুলকের কারণেই অনুভূতিটুকু মাদকতাময় হয়ে উঠেছিল। এক মুহূর্তের জন্যে সরে এলো ও, ওর ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে আনিকা বলল, 'দাঁড়াও।'
'কেন?'
ওর নাকে একটা খোঁচা দিল সে। 'তোমার ধারণা কয়েকটা দাগ বাদ দিয়ে গেছি আমি, না? নিজের ঘাড় দেখা উচিত ছিল তোমার। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে আরও তোয়ালে দিতে বলো। উপকারের প্রতিদান দিচ্ছি আমি।'
তোয়ালের অপেক্ষায় থাকার অবসরে মনে মনে তারিক ভাবল: নিয়ম-কানুনের গুল্লি মারি। সার্বিয়ার পুরো ঘটনা আনিকা জানতে চাইলে বলে দেবে ও।
এখুনি বলবে।
আইলের দিক থেকে আনিকার দিকে সরে এসে বসল ও। 'অ্যাই, শোনো-'
চুপ করে গেল ও।
গুটিশুটি হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে আনিকা।
ওকে আর বিরক্ত করল না ও, একটা বই বের করে পড়তে শুরু করল।
জেএফকে'র রানওয়ে ফোর এল-টুয়েন্টি টু আর-এর পেভমেন্টের সাথে বোয়িং ৭৬৭-এর চাকার তীব্র ঘর্ষণের আওয়াজে নড়ে উঠল আনিকা, জেগে উঠল ঘুম থেকে। চোখ রগড়াল।
'পৌঁছে গেছি,' ওকে বলল তারিক।
হাই তুলল আনিকা। 'তো...আমি ঘুমোনোর সময় কিছু হয়েছে?' জানতে চাইল।
'তোমাকে জোর করে পুলকের সবচেয়ে উঁচু স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সাধারণ মেয়েদের যার কথা জানা নেই।'
আবার হাই তুলল আনিকা। 'অথচ পুরো সময় ঘুমিয়ে ছিলাম। আহা বেচারা।'
ট্যাক্সিং শুরু করেছে এয়ারক্র্যাফট । 'তারিক,' বলল ও, 'কিছু মনে করো না, সবার আগে কিন্তু মিশন। ঠিক আছে?'
ওর হাতে চাপ দিল তারিক, পাল্টা চাপ দিল আনিকাও। অন্তত এইটুকুর অস্তিত্ব আছে।
'হ্যাঁ, আগে মিশন,' বলল তারিক।
২৭.
আবার নিউ রচেলের উপশহরে ওয়াল্টার ও লিসা কুপারের চমৎকার বাড়ি। অশুভ, খারাপ কিছু ঘটার একধরনের ছাপ পরিবেশে। আগের মতোই মনে হচ্ছে জায়গাটা; প্রফুল্ল, অতিথিপরায়ণ একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে লিসা, কিন্তু পেরে উঠছে না।
ওর চোখজোড়া ফুলে আছে, প্রচুর কান্নাকাটি করেছে কিংবা ঘটে যাওয়া কিছুর কথা ভাবছে, কিন্তু সেটার চেহারা তার পছন্দ হচ্ছে না। জিন্স আর বেঢপ সাইজের ধূসর সুইট শার্ট পরে আছে ও, শার্টের বুকে এনওয়াই জায়ান্টস-এর প্রতীক। লিভিং রুম হয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সে। অল্প বয়সী দুটো মেয়ে কাউচে বসে টেলিভিশনে কার্টুন ছবি দেখছে।
'স্টেসি, আন্না?' ওদের উদ্দেশ্যে বলল সে। 'কিছুক্ষণের জন্যে মেহমানদের নিয়ে উপরে যাচ্ছি আমি। তোমরা নিচেই থেকো, কেমন?'
বিড়বিড় করে একটা কিছু বলল মেয়েরা, কিন্তু টেলিভিশনের নাচুনে ড্রাগনের উপর থেকে নজর সরল না। উপরে উঠে এলো তারিক-আনিকা। ওদের বাম দিকের মাস্টার বেডরুমে নিয়ে এলো লিসা। খাটের কিনারায় বসে বলল,' বেশিক্ষণ লাগবে না।'
'তোমার যত সময় লাগে নিতে পারো,' ওকে বলল আনিকা।
মাথা দুলিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াল লিসা। এরুনি কান্নায় ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 'জ্যাক মিল্টন এসেছিল এখানে।'
চুপ থাকল তারিক। আনিকাও কিছু বলল না।
অবশেষে নীরবতা ভাঙতেই তারিক জানতে চাইল, 'তোমার স্বামী কোথায়?'
'জর্দানে, রিফিউজি ক্যাম্পের শুটিং করছে।'
'ঠিক আছে,' বলল আনিকা।
লম্বা দম নিল লিসা, বিছানার চাদরের নিচ থেকে এক টুকরো কাপড় বের করল। কালো সিল্কের ব্লাউজ। ছেঁড়া। হাতের মুঠিতে ওটা দলা পাকাল লিসা, কোলে রাখল।
'সে...বলেছে আমি সহযোগিতা না করলে আমার স্বামীর জন্যে পরিস্থিতি যারপরনাই খারাপ করে তুলবে।'
'তোমার স্বামী না ওর নেটওয়ার্কে কাজ করে?' জানতে চাইল তারিক। 'নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই?'
'না,' বলল লিসা। 'ওয়াল্টার স্বাধীন কন্ট্রাক্টর, জ্যাক মিল্টনের প্রডাকশন কোম্পানিতেই কাজ করে। ও ওর মতো।'
একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল তারিক, কিন্তু কোমর দিয়ে ঠেলা দিল আনিকা। 'বিশ্বস্ততার এই প্রতিদান,' বলল ও।
'হ্যা,' বলল লিসা।
ছেঁড়া ব্লাউজটা মেঝেতে ফেলল লিসা। 'তোমরা...জ্যাককে হন্যে হয়ে খুঁজছ কেন?'
'আমাদের এক বন্ধুকে মারাত্মক আহত করেছে সে, ওই বন্ধুর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের হত্যা করেছে,' বলল আনিকা।
'তার মানে...তোমরা ওর দেখা পেলে খারাপ কিছু ঘটবে তার কপালে?'
'সেরকমই ইচ্ছা আমাদের,' বলল তারিক।
ব্ল্উাজটা মেঝেয় ফেলে এক লাথিতে খাটের নিচে, চোখের আড়ালে পাঠাল ওটাকে লিসা। 'তাহলে তোমাদের সূত্র দিচ্ছি আমি। আগামীকাল রাতে ম্যানহাটানের একটা দামী রেস্তরাঁয় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হবে। প্রতি বছর জ্যাকই এর আয়োজন করে। তোমরা জ্যাককে চাও? ওখানে চলে যাও তাহলে।' এক টুকরো কাগজে তথ্যটুকু টুকে দিল সে।
কাগজটা নিল তারিক, বিদায় নিতে আনিকা আর ও উঠে পড়ল।
ওরা দরজার কাছে পৌঁছানোর আগমুহূর্তে ফের লিসার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। 'ওহ, ওর দেখা হলে...'
মনোযোগ দিয়ে শুনতে ঘুরে দাঁড়াল তারিক।
'আমি চাই ভীষণ যন্ত্রণা পোহাক সে,' বলল লিসা। 'ভালো রকম যন্ত্রণা।'
'সেটাই করতে যাচ্ছি আমরা,' বলল তারিক।
২৮.
পরদিন রাত। আনিকাসহ আবার জিএমসি ইউকোনে চেপে নতুন গড়ে ওঠা অফিস বিল্ডিং আর দামী দোকানপাটের সারির সামনে এসে বেআইনিভাবে পার্ক করে বসে আছে তারিক। এগুলোর একটাতেই ডাবল গ্লাস ডোর রয়েছে -- অন্ধকার --ওটার মাথার উপর গোলাপি নিয়ন সাইন বলছে: 'জাঁ-পল'।
'জায়গাটা রীতিমতো এক্সক্লুসিভ, ভেতরে ঢুকতে চাইলে তোমাকে নাম পরিচয়, পটভূমি, ক্রেডিটকার্ড রিপোর্ট জানাতে হবে,' বলল আনিকা। 'তারপরই ফোন করে দাওয়াত দেবে ওরা।'
'আমি তো ভেবেছিলাম নিজেকে জনগণের লোক বলেছিল জ্যাক,' বলল তারিক।
'সে তাই,' বলল আনিকা। 'কিন্তু কি ধরনের জনগণ সেটা বলেনি।'
আগেরবার ম্যানহাটানে থাকতে যেমন হয়েছিল, আবহাওয়া মেঘলা, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কিন্তু বাইরে অন্ধকার। ফলে দালানগুলোর উপরের তলার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একের পর একে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়িগুলো। ছাতা মাথায় লোকজন হেঁটে যাচ্ছে।
ঘড়ি দেখল আনিকা। 'আমাদের শিকারের এখন ওখানেই থাকার কথা, হয়তো দ্বিতীয় দফা মার্টিনি গলায় ঢেলে রাতের প্রথম বিবাহিতা নারীকে পটানোর চেষ্টা করছে।'
প্রচ- শব্দে হর্ন বাজিয়ে সাঁই করে একটা ট্যাক্সিক্যাব পাশ দিয়ে চলে গেল, আরেকটু হলেই একজোড়া দম্পতিকে চাপা দিত।
'জেএফকে-তে ফিরে আসার সময়...' বলতে গেল তারিক।
'মনে নেই, সবার আগে মিশন?'
'ওহ, মনে আছে,' বলল তারিক। 'কিন্তু আমি ফিরতি ফ্লাইটের কথা বলছিলাম। তোমাকে একটা কিছু বলতে চেয়েছিলাম।'
'কি?'
'আমার গত মিশনের ব্যাপারটা।'
ওর দিকে তাকিয়ে রইল আনিকা। 'এখন? এখন ভালো মানুষ হয়ে সব বলে দিতে চাও? কেন?'
'কারণ...কারণ, আমি বলতে চাই। নিয়মের গুল্লি মারো।'
'তুমি খুব খারাপ ছেলে,' কিন্তু যখন সে বলল, 'বলো না', সন্ধ্যার সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল সেটা।
'বুঝলাম না?' জানতে চাইল তারিক। 'এর আগে দুবার আমাকে জোর করেছ, আমিও দুবার তোমাকে জোর করেছি। এখন একটা গুফি ল্যাব্রাডরের রিট্রিভারের মতো গড়াগড়ি খেয়ে সবকিছু উজাড় করে দিতে চাইছি আর তুমি বলছ না?'
'ঠিক,' বলল ও। 'এটা সময় নয়। মিশন আগে, তারিক। ওখানে গিয়ে তোমার কাজ সেরে এসো। তুমি রেডি?'
'হ্যাঁ।'
'গুড।'
এখন তর্ক বা কথা বলার সময় নেই।
ঠিকই বলেছে আনিকা।
ইউকোনের দরজা মেলে ধরল তারিক। অন্ধকার এবং বৃষ্টিতে পা রাখল।
২৯.
জাঁ পল রেস্তরাঁর বিলাসবহুল, জাঁকাল জগতে পা রাখার মুহূর্তে হঠাৎ জর্জিয়ার পাইন গাছের নিচে বসে ঠাণ্ডা এমআরই আর সীমের বীচি খাওয়ার ফাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে নামার আগে ওদের স্পেশাল অপারেশনস ইন্সট্রাক্টও সবসময় গুরুত্বপূর্ণ একটা কথাবলত, মনে পড়ে গেল সেটা: আত্মবিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস।
'মনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে জায়গামতো আছ ভাব দেখাতে পারলেই স্রেফ একটা জক সট্র্যাপ গায়ে চাপিয়েই গ্র্যান্ড জেনারেল টার্মিনাল ধরে বেরিয়ে যেতে পারবে। কেউ চোখের পাতাও কাঁপাবে না,' বলেছিল সে।
বেশ, এই মুহূর্তে অবশ্য ওর সবসেরা স্যুটই পরে আছে তারিক, মুখের ফুটে আছে চওড়া মোহনীয় হাসি। ভেতরে ঢুকেই মেইত্রে ডি' স্টেশনের সামনে পড়ল ও। মাথা দুলিয়ে ফিসফিস করে তাকে বলল, 'আমি এনএনএন থেকে আসছি। জ্যাক মিল্টনের সাথে দেখা করব।'
লোকটার মাথায় রূপালি চুল, মচমচে সান্ধ্য পোশাক পরনে। 'দয়া করে একটু অপেক্ষা করবে, প্লিজ,' বলল সে। কিন্তু আগেই আত্মবিশ্বাসের সাথে তাকে পাশ কাটিয়ে পা বাড়িয়েছে তারিক।
ছোট ছোট টেবিল, শাদা টেবিল ক্লথ আর সুবেশী লোকজনভরা ছোটখাটো একটা ডাইনিং রুমে হাজির হলো ও। দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদ পাঠক আর দুজন এনবিএ খেলোয়াড়কে চিনতে পারল। আত্মবিশ্বাসের সাথেই আগে বাড়ল ও, জানে কোথায় যাচ্ছে। আনিকার তরফে ত্বরিৎ কয়েকটা কাজের সুবাদেই সেটা সম্ভব হয়েছে। জাঁ-পলের ফ্লোর প্ল্যানের যোগান দিয়েছে ও।
দিকচিহ্নহীন হলওয়ে ধরে আগে বেড়ে মদের বোতলের শেল্ফগুলো পাশ কাটাল। ও। ওক কাঠের একটা দরজা খুলে সোজা জ্যাক মিল্টনের খাস কামরায় ঢুকে পড়ল। কাঠের প্যানেলিং করা কামরা। ১৮০০ দশকের হাডসন রিভার স্টাইলে আঁকা তেল রঙ ছবি টানানো চারপাশের দেয়ালে।
'জ্যাক!' হাঁক ছাড়ল ও। সোজা তার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চৌকো টেবিলটা শাদা কাপড়ে ঢাকা। ওটার এক প্রান্তে বসেছে জ্যাক। আরও জনাসাতেক লোক আছে টেবিলে: চারজন নারী, তিনজন পুরুষ। টেবিলের দুপাশে ওর ডানদিকে বসা লোকদুটোকে চট করে মেপে নিল ও। পরনে ভালো জামাকাপড় থাকলেও ওরা যেন তাতে স্বাস্তি বোধ করছে পারছে না। যেন ফোটোশুটের জন্যে ট্রেনিং পাওয়া একজোড়া ডোবারম্যান পিনশারকে জোর করে ব্যালে স্কার্ট পরানো হয়েছে। মেয়েগুলোর বয়স বিশের কোঠার শুরুর দিকে হবে। শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা পোশাক ওদেও পরনে। অন্য লোকটা একটু বয়স্ক, সম্ভবত জ্যাকের উকিল কিংবা ব্যবসার ম্যানেজার হবে।
টেবিলের উপর মুখ খোলা মদের বোতল। ওর দিকে ফিরে হাসছে জ্যাক। সযত্নে ছাঁটা তার চুল-দাড়ি। শাদা টার্টলনেকসহ গাঢ় নীল স্যুট পরেছে, ১৯৬০ দশকের রেট্রো হিপ চিত্র পরিচালকের মতো লাগছে।
'তুমিই বোধ হয় আমার সাথে দেখা করতে খেপে থাকা নির্বোধটা,' বলল সে। 'দুঃখিত, আমার কাছে এখন সই দেওয়ার মতো কিছু নেই।'
মেয়েরা আর বয়স্ক লোকটা হেসে উঠল। কিন্তু পেশল লোক দুটো চুপচাপ।
'জ্যাক,' বলল তারিক, 'এখন তোমার মাশুল উসুলের সময় হয়েছে।'
'কি?' ধমকে উঠল জ্যাক। 'এত লোকের সামনে আমাকে গুলি করবে নাকি?'
তার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেছে। অতিথিদের চোখেমুখে কেবল স্তব্ধ ভাব। চোখমুখ তীক্ষ হয়ে উঠল দুই দেহরক্ষীর। ওদের দুজনের ডান হাতই পিছলে স্যুটের পকেটে সেঁধিয়ে গেছে।
এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকল তারিক, তারপর দুই কদম ডানে সবচেয়ে কাছের দেহরক্ষীর দিকে সরে এলো।
'জ্যাক...' বলল ও, 'কি জানো। ঠিকই আন্দাজ করেছ। তোমার সন্ধ্যা আর ডিনারে বাগড়া দেয়ার জন্যে দুঃখিত। ' ধীরে ধীরে আরও ডানে সরছে। 'সত্যি তোমার সাথে দেখা না পারছিলাম না। সারাক্ষণ টিভিতে তোমার চেহারা দেখি, তাছাড়া চাইলেই তো আর বিখ্যাত লোকজনের নাগাল মেলে না!'
পরক্ষণে বিনা আভাসে কাছের দেহরক্ষীর মাথার পেছনে গায়ের জোরে রদ্দা হানল ও। নিমেষে উল্টে পড়ল লোকটা। একই সাথে অন্য হাতে একটা মদের বোতল জাপ্টে ধরে অপর গার্ডের মাথায় ভাঙল। বোতলের আঘাত ঠেকাতে লোকটা হাত তুলেছিল, নিমেষে টেবিলে উল্টোদিকে এসে সোজা তার মুখে জোরালো একটা ঘুসি বসিয়ে দিল ও।
একবার।
দুবার।
জমে গেল সে।
হট্টগোল।
তরুণীরা চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। বয়স্ক লোকটা সামনে ছুট লাগাল, যেন নিশানা ছোট করে আনার চেষ্টা করছে। টেবিলের সামনের দিকে এগিয়ে গেল তারিক। কথা বলতে শুরু করল জ্যাক। বিনা বাক্যব্যয়ে ওর গালে পটাপট কয়েকটা চড় কষল ও। তারপর তার ডান হাত চেপে ধরে টান মেরে চেয়ার থেকে তুলে ফেলল।
বিহ্বলকারী আকস্মিক শক্তিই আসল চাবিকাঠি। এরা দামী রেস্তরাঁয় ছিল-নিরাপদ, উষ্ণ এবং হুষ্টপুষ্ট -- ওদের কপালে খারাপ কিছু ঘটতে পারে কল্পনাই করেনি। এমনকি ঘটনা ঘটার সময়ও -- যেমন এখন ঘটছে -- বুঝে উঠতে পারছে না। তাল পাচ্ছে না। পরিষ্কার করে কিছু ভাবতেও পারছে না।
অতীতে যেমন বক্স কাটার নিয়েই লোকে বিমান ছিনতাই করে ফেলত।
'আরে, আরে,' বলে উঠল জ্যাক। 'আরে --'
কিন্তু বাদ সাধল তারিক। 'মুখ একদম বন্ধ,' বলল ও। জ্যাকের ডানহাতটা মুচড়ে উপরে তুলে দিয়ে বুড়ো আঙুল ধরে বগল তলায় চেপে ধরল ও। তারপর দ্রুত জাঁ পলের বাইরে নিয়ে আসতে শুরু করল তাকে।
পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে জ্যাকের। যন্ত্রণায় চোখে জল এসে গেছে। ওদের মহলে 'কাম অ্যালং' নামে পরিচিত পুরোনো পুলিসি কায়দা কাজে লাগাচ্ছে তারিক, লোকটার ডানহাত এবং কাঁধে অসহ্য যন্ত্রণা ছড়িয়ে দিচ্ছে, তারিক যা বলছে তাই করতে বাধ্য করছে তাকে: জাঁ পল থেকে দ্রুত সরে পড়া।
জ্যাককে প্রায় বুকের সাথে ঠেসে ধরে মেইন ডাইনিং রুম হয়ে বেরিয়ে এলো ও। ডান বাহু আর কাঁধে ছড়িয়ে পড়া যন্ত্রণাই তাকে সামলে রাখার বেলায় কাজ দিচ্ছে। চোখে তুলে তাকাল অন্য মেহমানরা। ওদের মনের বিভ্রান্তি বুঝতে পারছে তারিক। কি হচ্ছে? জ্যাককে কি গ্রেপ্তার করা হলো? কোনো উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে সে?
এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: আমরা এখন কি করব?'
মেইত্রে ডি স্টেশনকে পাশ কাটাল ও। যা ঘটবে বলে জানত সেটাই ঘটল।
অর্থাৎ কিছুই না।
ম্যানহাটানের অন্যতম বিলাসি রেস্তরাঁ, কয়েক সেকেন্ডেই সব চুকে গেল। কেউই টেবিলে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেল না। জীবনে এমন খাবার মিলবে না, জানে।
বৃষ্টির ভেতর বেরিয়ে এলো ওরা। রাস্তা লোকারণ্যে। এখন বেশ স্বস্তি বোধ করছে তারিক।
ভালোভাবেই শুরু হয়েছে রাতটা।
কিন্তু পরক্ষণে সব গোল পাকিয়ে গেল।
সাইডওয়াকের কিনারে এসে দাঁড়াল ও। শেভিটা এখানেই পার্ক করা ছিল।
কিন্তু আনিকা চলে গেছে।
চাবি রয়ে গেছে ওর কাছে।
৩০.
কিছু একটা আন্দাজ করে যন্ত্রণা উপেক্ষা করে কথা বলে উঠল জ্যাক, 'ব্যাপার কি, বন্ধু? তোমার গাড়ি খোয়া গেছে? ফেলে চলে গেছে তোমাকে?'
'তুমি আদৌ আমার বন্ধু নও,' বলল তারিক।
ওকে ঠেলতে ঠেলতে আগে বাড়ল তারিক। জ্যাক এখন যন্ত্রণায় রীতিমতো তারস্বরে গোঙাচ্ছে। 'আমাকে ছেড়ে দাও,' বলল সে। 'এখানেই, তাহলে আর পুলিসে খবর দেব না। কোনও ঝামেলা করব না। খোদা, লাগছে!'
'চোপ রাও, জ্যাক। এটা আমার রিমোট স্ট্যান্ড-আপ, তোমার নয়।'
বৃষ্টিতে জোর কদমে চলতে থাকা লোকজনের ভেতর দিয়ে ওকে নিয়ে এগোতে লাগল ও, নিউ ইয়র্কের লোকজনের স্বাভাবিক অভ্যাস চালু থাকায় খুশি হলো ও। চোখ নামিয়ে রেখেছে ওরা, কোনোদিকে কারো নজর নেই। কিছুতেই কারো কিছু এসে যায় না। এটাই ওর পক্ষে কাজ করছে। এনওয়াইপিডির একটা গাড়ি কিংবা সিকিউরিটি গার্ডের কোনো দালান পাশ কাটাতে হলেই সব গুবলেট হয়ে যাবে।
অন্য উপায়...
চট জলদি ভিন্ন কোনো উপায় বের করতে হবে।
ক্যাবগুলো পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই বৃষ্টির ভেতর খালি ক্যাব পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কি করা যায়? ভাবছে ও।
পাওয়া গেছে।
সেভেন্থ অ্যাভিনিউ এবং ওয়েস্ট ফিফটি সেভেন্থের মোড়ে একটা কালো লেক্সাস এলএস বেআইনিভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এঞ্জিন চালু রয়েছে ওটার। দরজা খুলে জ্যাককে এক ধাক্কায় ভেতরে পাঠিয়ে নিজে ঢুকল তারপর। দড়াম করে আটকে দিল দরজাটা। শাদা শার্ট, কালো টাই পরা এক হিস্পানিক লোক স্টিয়ারিং হুইলের পেছন থেকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। বলল, 'তুমি মিস্টার ট্রিমেন, আমার যাত্রী?'
ড্রাইভারের সিটের দিকে এক তাড়া নোট ঠেলে দিল ও। 'আমি তারচেয়েও ভালো,' বলল, 'আমি মিস্টার গ্র্যান্ট আর এ হচ্ছে মিস্টার ফ্র্যাঙ্কলিন।'
ওর দিকে ঠেলে দেওয়া টাকার পরিমাণ দেখে চওড়া হাসি দিল ড্রাইভার। 'পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। তা কোথায় যেতে হবে?'
'স্রেফ চালাতে থাকো। পরে আরও টাকার সাথে বলছি সেটা,' বলল ও।
এতক্ষণে কষ্টকর বাঁধন থেকে রেহাই পেয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল জ্যাক। কিন্তু ড্রাইভারের মনোযোগ অন্যদিকে থাকায় জ্যাককে টু-হ্যান্ড চোকে জাপ্টে ধরল ও, সাবধানে তিন সেকেন্ড কেটে যেতে দিল -- এক হাজার এক, এক হাজার দুই, এক হাজার তিনÑঅবশেষে চেতনা হারাল বেচারা। ব্যাটার মগজের কোনো ক্ষতি হবে না, মনে মনে আশা করল তারিক।
চোখ তুলে রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকাল ড্রাইভার।
'সব ঠিকঠাক তো?' জানতে চাইল সে।
'গলায় বেশি মাল ঢেলে ফেলেছিল, বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছে,' বলল ও।
'বমি করবে না তো আবার?'
'মনে হয় না।'
'আমিও তাই আশা করি,' বলল ড্রাইভার।
- (চলবে)