একজন ‘ফূর্তিবাজ’ রাজপুত্রের অকালমৃত্যু, কিছু অমীমাংসিত রহস্য
লন্ডনের ব্রমলি অঞ্চলের চার্চিল থিয়েটারে সারিবদ্ধ জনসমাগম- এমন দৃশ্য এর আগে দেখা যায়নি। কার পার্কিংয়ে একের পর এক ধেয়ে আসছে তাগড়া লিমুজিন গাড়ি। বোঝায় যায়, কোনো রাজকীয় আয়োজন রয়েছে ওই থিয়েটারে।
ঘটনাটি ২০০৮ সালের বড়দিনের দিনকয়েক আগের। ব্রুনাইয়ের রাজপুত্র আজিমের বয়স তখন ২৬, থাকেন লন্ডনে। নিজের প্রিয় পুতুলনাচ শো 'সিন্ডারেলা' দেখাতে ছোট ভাই-বোনদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। এ কারণেই এমন এলাহি আয়োজন!
আর এর মাধ্যমেই ব্রুনাইয়ের চরম ধনী সুলতান হাসান-আল বলকিয়াহের দ্বিতীয় পুত্রের পার্টিপ্রেম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে রূপকথার 'প্রিন্স চার্মিং'য়ের মতো ফূর্তির জীবন কাটাতে ভালোবাসা রাজপুত্র আবদুল আজিম লন্ডন ও হলিউড তারকাদের ভিড়ে দিনযাপন করলেও তার জীবনে 'হ্যাপি এন্ডিং' বা সুখের সমাপ্তি আসেনি।
এ সপ্তাহের ঘোষণা করা হয়, দীর্ঘ রোগভোগের পর ৩৮ বছর বয়সে মারা গেছেন অবিবাহিত ওই রাজপুত্র।
সূত্রমতে, শনিবার (২৪ অক্টোবর) নিজ দেশেই মারা গেছেন আজিম। সেদিনই রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানকে তাকে দাফন করা হয়।
তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পরিবার-পরিজন হাজির থাকলেও এক সময় যাদের 'বন্ধু' হিসেবে গণ্য করতেন, সেই তারকাদের কাউকে দেখা যায়নি।
সেই 'বন্ধু'দের মধ্যে অভিনেত্রী রাকেল ওয়েলচ ও সুপারমডেল নাওমি ক্যাম্পবেল থেকে শুরু করে গায়িকা মারিয়া ক্যারি ও 'বেওয়াচ'তারকা পামেলা অ্যান্ডারসনও ছিলেন। এদের মধ্যে আজিমের ৩০তম জন্মদিনের পার্টিতে পামেলা তো গানও শুনিয়েছেন!
সাবেক 'বিগ ব্রাদার' প্রতিযোগী ও প্রয়াত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব জেড গুডির সঙ্গেও একটা সময় বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল আজিমের।
তিনি এমনই 'ফূর্তি'র দুনিয়ায় জীবন কাটাতেন, যেটির প্রতি ইসলামি রক্ষণশীল দেশের শাসকগোষ্ঠী হিসেবে তার পরিবারের সমর্থন বা অনুমোদন ছিল না।
এই তো, গত বছরই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাহায্যে সুরক্ষিত ওই তেলসমৃদ্ধ দেশে সমকামের শাস্তি হিসেবে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান করা হয়েছিল। তবে এর প্রতিবাদে দেশটির সঙ্গে ব্যবসায় বয়কটের ডাক পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে দেওয়া হলে সেই বিধান প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন সুলতান।
বলে রাখা ভালো, এ ধরনের বিধান রাজপুত্র আজিমের জন্যও ছিল অস্বস্তিকর; কেননা বেশ কিছু সমকামী বন্ধু ছিল তার। ধনী ওই ইসলামি রাজপরিবারের সদস্যরা ওই বিধানের উল্টো জীবনযাপনে যে অভ্যস্ত, আজিম ছিলেন তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
অবশ্য তার চাচা ও সুলতানের ছোটভাই- রাজপুত্র জেফ্রি বহুকাল ধরেই পরিবারে 'প্লেবয়' হিসেবে খ্যাত। সময়ের ব্যবধানে জেফ্রি যেখানে অপেক্ষাকৃত 'শালীন' জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, পরের প্রজন্ম সেখানে পৃথিবী চষে বেড়ানোর পথে সদা-আগুয়ান। এই যেমন, রাজপুত্র আজিম পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে।
ধারণা করা হয়, নিজের ছোটভাইয়ের সঙ্গ থেকে দূরে রাখতেই আজিমকে লন্ডনে বড় করেছেন সুলতান। সেই প্রচেষ্টা যে খুব একটা কাজে দেয়নি, বলাই বাহুল্য। মাত্র এক সপ্তাহ পড়াশোনা করে রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট ছেড়ে দিয়েছিলেন আজিম। পরিবারের আশা ছিল, পড়াশোনায় বড় ভাইয়ের অনুসারী হবেন তিনি। কিন্তু সেই আশায় গুঁড়েবালি দিয়ে 'উন্মত্ত' জীবন বেছে নেন তিনি।
বলে রাখা ভালো, সুলতানের বড় ছেলে ও ব্রুনাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স বিল্লাহ অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজে ইসলামিক স্টাডিজে পড়াশোনা শেষ করেছেন।
অন্যদিকে, ফিল্ম প্রডিউসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন আজিম। এ কারণে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের নাম গর্বের সঙ্গে আজিম বলকিয়াহ বলে জাহির করতেন।
কোনো কোনো চলচ্চিত্রের আংশিক প্রযোজনাও করেছেন তিনি। এরমধ্যে রয়েছে হিলারি সোয়াঙ্ক অভিনীত 'ইউ আর নট ইউ' চলচ্চিত্র।
এরপর অস্কার ওয়াইল্ডকে ঘিরে রুপার্ট এভারেটের লেখা এবং এমিলি ওয়াটসন ও কলিন ফার্থ অভিনীত সমকামী প্রেমের কাহিনির চলচ্চিত্র 'দ্য হ্যাপি প্রিন্স'-এর নির্বাহী প্রযোজক ছিলেন এই ব্রুনাই রাজপুত্র।
স্টুডিও সিস্টেমের বাইরে, নিজের সম্পদ ও অবস্থান ব্যবহার করে, ব্রিটেন ও অন্যত্র বেশকিছু ভালো কাজেও নিজেকে জড়ান আজিম। এরমধ্যে রয়েছে 'মেক-অ্যা-উইশ ফাউন্ডেশন' ও 'ফ্যাশন ফর রিলিফ'।
মারিয়া ক্যারিসহ বেশ কিছু তারকা হয়ে ওঠেন তার নিয়মিত আড্ডার বন্ধু; অন্যদের আগ্রহ যে তার ব্যাংক ব্যালেন্সের দিকেই বেশি ছিল, সে কথা না বললেও চলে!
আসলে, কেট মস কিংবা ক্লাউডিয়া শিফারের মতো সুপারমডেলদের সঙ্গে ছবি তোলার আকাঙ্ক্ষা ও সেটি পূরণ সম্পর্কে আজিম নিজেই মাঝে মধ্যে রসিকতা করতেন। 'বোঝাতে চাই, তাদের সঙ্গে আগেই দেখা হয়েছে আমার,' একবার বলেন তিনি, 'তবে তাদের সঙ্গে আড্ডা দিইনি বা ঘোরাঘুরি করিনি।'
এমন রসিকতার আড়ালে থাকা বেদনা ঠিকই টের পাওয়া যায়!
- সূত্র: ডেইলি মেইল, যুক্তরাজ্য