‘বিয়ে করো, নাহলে গুলি করব’: যে অপরাধজগতে অস্ত্রের মুখে যুবকদের বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়
অবিনাশ মিশ্রার জন্য সরকারি চাকরি আশীর্বাদ হয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু এই চাকরিই উল্টো তার জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। উত্তর ভারতের দারিদ্র্যপীড়িত রাজ্য বিহারের মুঙ্গের জেলার ২৮ বছর বয়সী এই শিক্ষক প্রতি সন্ধ্যা কাটান শঙ্কার মধ্যে। রাস্তায় হাঁটার সময়ও তিনি সতর্ক থাকেন। রাস্তায় অচেনা গাড়ি বা অচেনা মুখের দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। অবিনাশ সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকেন, তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে অপহরণ করতে পারে।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অবিনাশ বলেন, "মাথায় বন্দুক ধরে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ওরা চায় আমি বিয়েটা মেনে নিই। আমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছিল। এটাকে কীভাবে বিয়ে বলা যায়?"
বিহারে এখন অন্যতম বড় সমস্যা হলো 'পকড়ুয়া' বিয়ে বা বন্দুকের মুখে বিয়ে। এখানে বরকে অপহরণ করে বন্দুকের মুখে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। এর পেছনে অনেক কারণও রয়েছে। যেমন বিয়ের আগে পাত্রপক্ষের পরিবারের টাকা দাবি করা একটি পুরোনো প্রথা। কিন্তু এ টাকা অনেক সময় কনেপক্ষের পরিবারের দেওয়া সম্ভব হয় না। যার কারণে অনেকে মেয়েকে বিয়ে দিতে এ পথ ধরেন। এছাড়া ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য হিসেবে বিহারে জাতিগত বৈষম্য, পারিবারিক বিরোধ এবং আর্থ-সামাজিক চাপের কারণে এ সমস্যা আরও বেড়েছে।
সাংবাদিক ইন্দ্রজিৎ সিংহ জানান, ১৯৭০-এর দশকের দিকে পণ প্রথা যখন ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে, তখন পকড়ুয়া বিয়ের হারও বাড়তে শুরু করে। বেকারত্ব তখন চরমে ছিল, ফলে কোনো যুবকের চাকরি হলেই তিনি পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে ওপরে থাকতেন। ১৯৮০-এর দশকে এর প্রকোপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় এবং ২০০০ সালের আগপর্যন্ত এটি চলতে থাকে। ২০০৯ সালের পর এ প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে। তবে এখন আবারও অপহরণ করে বিয়ের ঘটনা বাড়ছে।
৩২ বছর বয়সী রাজেশ কুমার রাজ্য বিদ্যুৎ বোর্ডে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি পকড়ুয়া বিয়ে নিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
রাজেশ বলেন, "ওরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ আমার রুটিন অনুসরণ করেছে। আমি কখন অফিসে যাই, কোন চায়ের দোকানে যাই, এমনকি আমার বোন কখন কলেজে যায়, সেটাও জানত।"
তিনি এখন অন্য একটি শহরে থাকছেন; তারপরও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, "ওই চক্র আমার পরিবারকে তাদের অস্ত্রধারী সদস্যদের ছবি দেখিয়েছিল; অস্ত্র নিয়ে আমার বোনের কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। তাদের বার্তা পরিষ্কার ছিল: সহযোগিতা করো, নাহলে পরিণতি ভয়াবহ হবে।"
রাজ্য অপরাধ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাত হাজার ১৯৪টি জোরপূর্বক বিয়ের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৯২৫টি এবং ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৩১০টি। তবে এই সংখ্যা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্রের অল্পই তুলে ধরেছে।
সেন্ট্রাল বিহারের জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা সুবোধ কুমার বলেন, "একটি ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হলে অন্তত তিনটি ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয় না। অপরাধী গ্যাংয়ের প্রতিশোধ অথবা সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অধিকাংশ ভুক্তভোগী চুপ থাকে।"
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা বেড়েছে, যা এই গ্যাংগুলোর জন্য নতুন 'আকর্ষণীয় লক্ষ্য' তৈরি করেছে।
বেকারত্বের প্যারাডক্স
অপ্রত্যাশিতভাবে জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা বাড়িয়েছে বিহারের বেকারত্ব। যুবকদের মধ্যে (১৫-২৯ বছর) বেকারত্বের হার ১৩.৯ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ১০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। সেখানে সরকারি চাকরি এক ধরনের সোনালি সুযোগ, যা অপহরণকারীদের চক্রগুলোর জন্য একটি প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. অলোক সিং বলেন, "এটি আসলে একটি ঝড়। রাজ্যের সাম্প্রতিক নিয়োগগুলো বেকারত্বের সাগরে একটি দ্বীপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। একজন তরুণ যখন সরকারি চাকরি পেয়েছেন, তার সঙ্গে আসলে একটি আতঙ্ক নিয়েও চলতে হচ্ছে।"
চাকরির অভাবও চক্রগুলোর কার্যক্রমে পরিবর্তন এনেছে। সম্প্রতি সন্তোষ সিং নামে এক ব্যক্তি এ অপহরণ চক্রের হাত থেকে বেঁচে ফিরেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, এ চক্রগুলোর নজরদারির কৌশল অত্যন্ত উন্নত।
তিনি বলেন, "তারা সাম্প্রতিক সরকারি নিয়োগপ্রাপ্তদের ডাটাবেজ তৈরি করে। এ জন্য তারা চাকরি পরীক্ষার কোচিং সেন্টারগুলোতে নজর রাখে। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও নজর রাখে, চাকরি পাওয়ার খবর জানিয়ে দেওয়া পোস্টের খোঁজে।" সন্তোষ জানান, এখন নতুন পদে নিয়োগ পাওয়ার পরেও রাজ্য ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিবাহ মহামাফিয়ার অন্তরালে
পাটনার একটি অলাভজনক সংস্থার অন্ধকারাচ্ছন্ন অফিস কক্ষ থেকে রাম কুমার মিশ্র নামে এক ব্যক্তি একটি ব্যবসায়িক ডকুমেন্টের মতো একটি কাগজ খুলে দেখালেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, "এটি তাদের রেট কার্ড। এখানে সযত্নে সবার মূল্য লেখা আছে। ইঞ্জিনিয়ার ৮০০,০০০ থেকে ১,০০,০০০০ রুপি; ডাক্তার ১.২ মিলিয়ন থেকে ১.৫ মিলিয়ন রুপি; সরকারি কর্মকর্তা ৫০০,০০০ থেকে ৭০০,০০০ রুপি। তারা এমনকি এখানে ইএমআই-এরও (সমন্বিত মাসিক কিস্তি) ব্যবস্থা রয়েছে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, চক্রগুলো অস্থায়ী অপহরণের চেয়ে বেশ উন্নত ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তারা জেলার মধ্যে নিরাপদ বাড়ি রাখে, আইনজীবী নিয়োগ দেয় এমনকি স্থানীয় ফটোগ্রাফারও রেডি রাখে যাতে বিয়ের বৈধতা প্রমাণে কোনো সমস্যা না থাকে। তিনি আরও জানান, কিছু চক্র বিভিন্ন 'প্যাকেজ'ও অফার করে থাকে। এর মধ্যে সুরক্ষা সেবা, আইনি ডকুমেন্টেশন এবং এমনকি 'অনিচ্ছুক বরদের জন্য পরামর্শের মতো বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে।"
এমন একটি চক্রের সদস্য হলেন মণোজ শর্মা। তিনি অবশ্য বর্তমানে পুলিশের ইনফর্মার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি সম্প্রতি একটি ভীতিকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, "প্রত্যেকটি অপারেশন কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করা হয়। আমাদের লোকেরা কোচিং সেন্টার, সরকারি অফিস এমনকি স্থানীয় চা দোকানেও নজরদারি করে। আমরা আমাদের পছন্দের ব্যক্তির পুরো রুটিন যাচাই করতাম এবং এরপর পদক্ষেপ নেওয়া হত।"
উচ্চবর্ণের দ্বন্দ্ব
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজধানী কলেজের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নওয়াল কিশোর বিষয়টিকে অত্যন্ত বিদ্রূপাত্মক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, "উচ্চবর্ণের পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই বেশি পণ চেয়ে থাকে। এখন তারাই এ চক্রগুলোকে ধরছে যাতে পণ না দিতে হয়।"
বিহারের সৌরথ গ্রামে অনুষ্ঠিত একটি ঐতিহ্যবাহী সমাবেশ হলো বেগুসরাইয়ের স্বরাজ মেলা বা সৌরথ সভা। কিশোর এ সভা থেকেই এর খোঁজ পান। তিনি জানান, এ সভাতে সম্ভাব্য পাত্র-পাত্রীর পারিবারিক বংশ এবং জ্যোতিষশাস্ত্রীয় সামঞ্জস্যতা যাচাই করা হয়।
'সাফল্যের' ব্যবসা!
এ চক্রগুলো যে শুধু বিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত থাকে তা নয়। তারা এর সফলতাও নিশ্চিত করে বলে জানান, সাংবাদিক ইন্দ্রজিৎ সিং। তিনি বলেন, "চক্রগুলো বিয়ের পর বরকে নজরদারির ওপর রাখে। তারা নিশ্চিত করে সে যাতে পালিয়ে না যায় এবং এমনকি পারিবারিক বিবাদ মীমাংসাও করে। এটি একটি প্যাকেজ ডিল।"
এই বাণিজ্যিকীকরণ একসময় ফিকে হয়ে যাওয়া একটি প্রথাকে একটি সুসংগঠিত অপরাধী কর্মকাণ্ডে পরিণত করেছে। যদিও কেউ কেউ সম্প্রতি এ বিষয়ক একটি ওয়েব সিরিজ 'পাকড়ুয়া বিবাহ'- এর (বিয়ে অপহরণ) জনপ্রিয়তাকে দায়ী করছেন। তবে পুলিশ কর্মকর্তা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, "এটি অর্থনীতির বিষয়, বিনোদন নয়। রাজ্যের সাম্প্রতিক নিয়োগের সমারোহের কারণেই এটি আরও জোরদার হয়েছে।"
চক্রগুলো আধুনিক সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সাইবার সেল কর্মকর্তা রাকেশ কুমার বলেন, "তারা এখন ডিজিটাল নজরদারির মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ট্র্যাক করে এবং এমনকি চাকরি-সংক্রান্ত ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চাকরি প্রাপ্তদের আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি আমরা এমন একটি চক্র খুঁজে পেয়েছি যারা চাকরি পোর্টালগুলো ব্যবহার করে সম্ভাব্য লক্ষ্যদের চিহ্নিত করছিল।"
চক্রগুলো ভাঙার প্রক্রিয়া
বিহারের সবচেয়ে প্রভাবশালী জেলাগুলোতে কাজ করা সাবেক ভারতীয় এক পুলিশ কর্মকর্তা অমিতাভ দাস বলেন, "এই সমস্যা শুধু আইনশৃঙ্খলা বা অপরাধের সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক সংকট, যা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সামাজিক বৈষম্য এবং প্রশাসনিক অবহেলার কারণে জন্ম নিয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এই চক্রগুলো সামাজিক চক্রের অংশ হয়ে উঠেছে এবং তারা শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য কাজ করছে না বরং তারা একটি পুরোনো সামাজিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখছে, যা দুঃখজনকভাবে সুশাসন এবং সংস্কারের অভাবকে শক্তিশালী করে।"
তিনি বলেন, "এটি শুধু অপরাধমূলক নয়, এটি গভীর সামাজিক সমস্যাও। এ চক্রগুলো এ সামাজিক ব্যবস্থার সদ্ব্যবহার করে সরকারি চাকরিকে চূড়ান্ত নিরাপত্তা হিসেবে দেখানো হয়। এ কারণে যৌতুকের দাবি বিবাহগুলোকে কঠিন করে তুলছে এবং শ্রেণি বিভেদ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিষয়টিতে পুলিশ অকার্যকর উল্লেখ করে অমিতাভ দাস বলেন, "জেলা ভিত্তিক জোরপূর্বক বিয়ে বিরোধী সেল তৈরি করা কাগজে ভালো মনে হয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই চক্রগুলোর প্রায় সবার মধ্যে সোর্স থাকে- স্থানীয় চায়ের দোকান থেকে সরকারি অফিস পর্যন্ত। তারা জানে কখন নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, কোথায় তাদের পোস্টিং হবে এবং তাদের পারিবারিক পটভূমি। অনেক সময়, পুলিশ আসার আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং তখন এটি হয়ে ওঠে 'পারিবারিক সমস্যা'।"
এ আসলে একটি ট্র্যাজিডি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "একটি বিচ্ছিন্ন প্রথা থেকে এটি সংগঠিত শিল্পে পরিণত হয়েছে। আমরা এমন কিছু ঘটনা দেখেছি যেখানে চক্রগুলো সম্ভাব্য লক্ষ্য ব্যক্তিদের বিস্তারিত ডেটাবেজ তৈরি করে। এর মধ্যে পারিবারিক তালিকা, আর্থিক অবস্থা এবং ক্যারিয়ার বিষয়ক সব কিছু লেখা ছিল। কিছু চক্র রাজনৈতিক সুরক্ষাও পেয়ে থাকে।"
তবে অবিনাশ মিশ্রের মতো অনেককেই এ তথ্যগুলো অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তার নতুন নিয়োগপত্র ড্রয়ারে পড়ে আছে। কখনো কখনো এ ধরনের সফলতা কারও জন্য বড় দুর্বলতাও হয়ে উঠতে পারে।
জানালা দিয়ে সূর্যাস্তের দিয়ে তাকিয়ে অবিনাশ মিশ্র বলেন, "আমি এ চাকরির জন্য বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু আমি এখন প্রতিদিন পরবর্তী হুমকির জন্য প্রস্তুতি নেই।"