যে কারণে উমা চরণ কর্ম্মকারের দাঁড়িপাল্লা হারিয়ে গেল
১৮৫২ সালে উমা চরণ কর্ম্মকার দাঁড়িপাল্লা বানানো শুরু করেছিলেন। তখনও মুঘল সম্রাট দিল্লিতে ছিলেন, আর ভারতবর্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন বিভিন্ন নবাব, রাজা ও মহারাজা। রাজাদের অনেকেই নিজের ওজন সমান স্বর্ণ বা রৌপ্য প্রজাদের মধ্যে বিলি করতেন। যদি এ তথ্য সত্যি হয়, তাহলে হয়তো উমা চরণের পাল্লাও তারা ব্যবহার করে থাকতে পারেন।
উমা চরণের তৈরি ম্যানুয়াল ওয়িং স্কেল—যা সাধারণ্যে 'কাঁটা' নামে পরিচিত—এর ডিজাইন ছিল কার্যকর এবং টেকসই। এর ওপরের অংশে দুটি কাঁটা থাকে—একটি চলনক্ষম, অন্যটি স্থির। কাঁটা দুটি যখন এক বিন্দুতে মিলে যায়, তখন দু'পাশের ভর সমান বলে ধরা হয়। লোহার পাতের মাঝখানে বসানো কাঁটা দুটি কালো রঙের পাটের ওপর সাদা রঙে লেখা থাকে 'উমা চরণ কর্ম্মকার'। পাতের দুপাশে দুটি আংটা থেকে দড়ি নেমে নিচের কাঠের পাল্লা দুটিকে বাঁধা থাকে। ওপরের আরেকটি আংটা দিয়ে দাঁড়িপাল্লাটি বাঁশের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হয়।
কাঠের পাল্লার একটিতে ওজন ও অন্যটিতে মালামাল রাখা হতো। শ্যামবাজারের আলহাজ্ব বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার আবু বকর বলেন, কাঁটার গায়ে ওজন ধারণক্ষমতাও লেখা থাকত। সাধারণত, এসব পাল্লায় ৩০০ কেজি পর্যন্ত ওজন ধারণ করা যেত। তিনি বলেন, '৩০-৩৫ বছর ধরে আড়তদারি করছি, উমা চরণের কাঁটা ছাড়া আর কিছু দেখিনি। আমি কাঁটার দেশের মানুষ। আমাদের ফরিদপুরে পাটের আবাদ বেশি বলে কাঁটার ব্যবহার অনেক।'
শ্যামবাজারে আড়াইশ আড়ত
ঢাকার শ্যামবাজার শতবর্ষী পুরোনো কাঁচাবাজার। এখানে কাঁচা ও পাকা মালের প্রায় আড়াইশ আড়ৎ রয়েছে। ফরাশগঞ্জ তথা শ্যামবাজারের প্রতিটি আড়তে শতশত বস্তা আলু, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনো মরিচ ও আদার মজুত থাকে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা এ বাজারে জমজমাট বেচাকেনা হয়।
শেরে বাংলা বাণিজ্যালয়ের আহসান গাজী বলেন, 'ব্যবসা-বাণিজ্য এখন তেমন মন্দ না। তবে ২০ বছর আগের শ্যামবাজার আর এখনকার শ্যামবাজার এক নয়। সে সময় রাত-দিন দোকান খোলা রাখতে হতো। কাঁটা এক মুহূর্তও স্থির থাকত না। বস্তার ওজন লিখতে লিখতে সরকারদের হাত ব্যথা হয়ে যেত।'
এখন সে দিনের ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে আহসান গাজী বলেন, 'বলা মুশকিল। আগে চট্টগ্রাম আর ঢাকা ছিল বড় পাইকারি মোকাম। এখন জেলাগুলোতে তো বটেই, উপজেলাগুলোতেও মোকাম গড়ে উঠেছে। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ সহজ হয়েছে, রাস্তা-ঘাট উন্নত হয়েছে। ফলে বড় মোকামে এসে কেনাকাটার প্রয়োজন কমে গেছে। তবে ব্যবসা যা আছে, তা খারাপ নয়।'
কাঁটায় কষ্ট ছিল বেশি
আহসান গাজীর আড়তে শেষবার কাঁটা ব্যবহার করা হয় প্রায় দশ বছর আগে। কাঁটা কি ভালো ছিল না? উত্তরে তিনি বলেন, 'ভালো-মন্দের প্রশ্ন নয়। তখন তো স্কেল ছিল না, তাই কাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না। তবে কাঁটা ব্যবহার বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। লেবার লাগত বেশি, সময়ও বেশি লাগত। এমনকি ১৪৫ কেজি ওজনের বস্তাও ওঠাতে হতো। একজন মানুষের পক্ষে এত ভারী বস্তা বহন করা কতটা কষ্টকর, তা ভাবলেই বোঝা যায়।'
আলহাজ্ব্ব বাণিজ্যালয়ের আবু বকর বিষয়টি আরও খোলাসা করলেন, 'একটি বস্তা কাঁটা করতে [ওজন করতে] তিনজন লেগে যেত। হুক দিয়ে দুজন সামনে টানত, আর একজন পেছন থেকে ঠেলা দিত। মাপার পর আবার দুজন উঠে জোর দিয়ে পাল্লা থেকে বস্তাটি নামিয়ে আনত।
'যেখানে ওজন দেওয়া হতো, সেখানেও কম কষ্ট হতো না। আমাদের কাছে ৫০ কেজি, ৪০ কেজি, ২০ কেজি থেকে ১ কেজি ওজনের পাথর ছিল। ২০ কেজি ওজনের একটি পাথর ওঠানো-নামানো সহজ ছিল না, আর ৫০ কেজি তো বিরাট ব্যাপার।'
আবু বকর জানান, বস্তা তখন ভারী হতো, কারণ যাতায়াত খরচ কম পড়ত। ট্রাকওয়ালা বস্তা গুনে গুনে ভাড়া ঠিক করতেন। এখন বস্তার ওজন বেশিরভাগ ৬০-৬৫ কেজি, বড়জোর ৮০-৮৫ কেজি হয়।
বর্তমানে বস্তার ওজন কম হওয়ার কারণ পরিবহন পদ্ধতির পরিবর্তন। পিকআপ ভ্যান সহজে ঢাকা ও মফস্বলের বিভিন্ন জায়গায় প্রবেশ করতে পারে। বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমে গেলেও ছোট ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। এখন কেউ কেউ মাত্র এক বস্তারও পাইকার।
স্কেলের নিচে চাকা লাগানোর সুবিধা
অগ্রণী বাণিজ্যালয়ের আব্দুর রকিব চোকদার আশির দশকের শেষ দিকে আলুর কারবার শুরু করেন। বড় আড়ত হওয়ায় তাদের দুটি কাঁটা ছিল। উভয়ের গায়েই লেখা ছিল, 'উমা চরণ কর্ম্মকার, নারকেলডাঙ্গা, ভারত।'
তিনি বলেন, 'আমার বাবা বা তার পার্টনার ইমামগঞ্জ থেকে একেকটি কাঁটা (পাল্লা ছাড়া শুধু লোহার পাত) ২৫০০-৩০০০ টাকায় কিনেছিলেন। কাঁটার সঙ্গে লেবারদের সম্পর্ক বেশি ছিল। তারাই এটি ঝেড়ে-পুছে যত্ন নিত।'
একেকটি আড়তে ২০-২২ জন লেবার থাকত। আড়ত তাদের বেতন বা ভাতা কিছুই দিত না, শুধু থাকার জায়গা, কাপড় রাখার দড়ি আর গোসলের পানি দিত। লেবাররা আয় করত মাল কাঁটার মজুরির মাধ্যমে।
'নব্বইয়ের দশকে একটি বস্তা ওঠানো বা নামানোর জন্য লেবাররা বেপারীর কাছ থেকে ৫ টাকা এবং পাইকারের কাছ থেকে ১০ টাকা পেত। এখন পায় ১০ টাকা ও ২০ টাকা। শ্যামবাজার লেবার কল্যাণ সমিতি এ রেট নির্ধারণ করেছে,' বলেন চোকদার।
মিতালি ভাণ্ডারের বর্তমান মালিক আব্দুর রহিম ১৯৮৭ সালে শ্যামবাজারে আসেন ভাগ্যানুসন্ধানে। প্রথম দুই বছর তিনি কেবল পেট চুক্তিতে কাজ করেছেন, কোনো বেতন পেতেন না। তবে তার সততা ও আন্তরিকতা তৎকালীন মালিককে আকৃষ্ট করে।
মালিক তাকে ক্যাশের দায়িত্ব দেন। এভাবে অনেক বছর চলার পর মালিক তাকে অংশীদার করে নেন। পরে মালিক মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকারীরা আড়ত পরিচালনায় উৎসাহ দেখাননি। আব্দুর রহিম তাদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে নিজেই আড়ত পরিচালনা করতে থাকেন।
তিনি দাঁড়িপাল্লার পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ ব্যাখ্যা করেন। দাঁড়িপাল্লা নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির থাকে। বস্তাগুলো টেনে টেনে তার কাছে আনতে হয়। উল্টোদিকে ডিজিটাল স্কেলগুলোর নিচে চাকা লাগানো থাকে বলে যেকোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
'দাঁড়িপাল্লা অনেক জায়গাও দখল করে। আগে একই পরিবারের সব ভাই একটি আড়ত চালাতেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আসার পর দেখা গেল, একসঙ্গে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ঘরগুলো ভাগ হয়ে ছোট হয়ে গেছে। এখন কিছু আড়তে দণ্ডটি ঝুলতে দেখা যায়, কিন্তু পাল্লা আর দেখা যায় না। আড়াইশ ঘরের কোনো আড়তেই আর পাল্লার ব্যবহার নেই।'
বহু বাজি জিতেছেন
রাজীব বাণিজ্যালয়ের লেবার মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের বয়স ষাটের বেশি। তিনি ৩৫ বছর ধরে শ্যামবাজারে মাল ওঠানো-নামানোর কাজ করছেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমায়ের গঞ্জনা সইতে না পেরে চিলাহাটি থেকে ঢাকায় চলে আসেন। নানা জায়গা ঘুরে শেষে তিনি শ্যামবাজারে আসেন।
রাজীব বাণিজ্যালয়েই তার অধিকাংশ সময় কেটেছে। গ্রামে আড়াই শতাংশ জমি কিনে ঘর তুলেছেন, দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এটুকুতেই তাকে খুশি দেখাল। বললেন, 'কাঁটার ব্যবহার যখন ছিল, তখন খুব জমজমাট সময় ছিল। সবাই হৈ হৈ করে কাজ করতাম। একটা বস্তা মাথায় তুললে বুঝতাম এতে কী পরিমাণ মাল আছে। বেশিরভাগ সময়ই আন্দাজ একশ-একশ মিলে যেত। এ নিয়ে বহু বাজিও জিতেছি। এখন কাজ কমে গেছে, আর কাজ সোজাও হয়ে গেছে।'
ডিজিটাল স্কেল আসায় বিক্রেতা বা বেপারীদের জন্য সুবিধা হয়েছে। কাঁটার সময়ে বস্তার ওজন ৭৫ কেজি ৩০০ গ্রাম হলে ক্রেতা ভগ্নাংশ মুফতে পেয়ে যেতেন। এখন স্কেল সঠিক ওজন দেখায়। বেশি হলে ৫০ বা ১০০ গ্রাম মুফতে পায় পাইকার বা ক্রেতা। তাই ডিজিটাল মেশিন বাজারে আসার পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আড়তগুলোতে কাঁটার ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। এটি মূলত ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ঘটেছে।
পাট ওজনে এখনো লাগে
মদিনা কর্পোরেশনে গিয়ে একটি কাঁটা (পাল্লা ছাড়া) ঝুলতে দেখে ভালো লাগল। ছবি তোলার অনুমতি চাইলে ম্যানেজার সম্মতি দিলেন। তারা ২০ কেজি ওজনের একটি বাটখারাও বের করে দেখালেন।
কাঁটার ছবি তোলার পর লেবার আমিনউদ্দিনের সঙ্গে কথা হলো। সিরাজগঞ্জের চৌহালিতে তার বাড়ি। ২০১৩ সালে তিনি শ্যামবাজারে এসেছেন। আগে কৃষিকাজ করতেন, কিন্তু যমুনা নদীর ভাঙনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে পথে নামতে হয়। পরিচিত একজনের মারফতে এখানে লেবারের কাজ নেন।
আমিনউদ্দিন বলেন, 'কাঁটার বাটখারা ওঠাতে-নামাতে হাত ব্যথা হয়ে যেত, তবে কাজ করে মজা ছিল। সবাই হৈ-হল্লা করে কাজ করতাম। এলাকা থাকত সরগরম। এখন শ্যামবাজারে চলছে ভাটার টান।'
উমা চরণের বংশধরেরা এখনো ব্যবসা বহাল রেখেছেন। তাদের পণ্য থেকে বোঝা যায়, তারা সময়ের সঙ্গে আধুনিক হয়েছেন। বর্তমানে ভারত-কেন্দ্রিক এ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দাঁড়িপাল্লার উৎপাদন বন্ধ করেননি।
তবে সে সঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম স্কেল, ডিজিটাল উইং স্কেল, ম্যানুয়াল ওয়িং মেশিন, স্প্রিং ব্যালেন্স, ডায়াল ব্যালেন্স, গোল্ড উইং স্কেল, ইলেকট্রনিক ডিজিটাল উইং স্কেলও উৎপাদন করছেন। সারা ভারতেই তাদের বাজার রয়েছে বলে মনে হয়।
আমাদের দেশে উমা চরণের দাঁড়িপাল্লার ব্যবহার একেবারে শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করেন না আলহাজ্ব্ব বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার আবু বকর। তিনি বললেন, 'যে-সব পণ্য বস্তাবন্দি করা যায় না, সেগুলোর ওজন দিতে দাঁড়িপাল্লা লাগে। যেমন পাট এবং লাকড়ি (জ্বালানি কাঠ)।'
তবে সময়ের সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন আসে। ওজন মাপার যন্ত্রেরও পরিবর্তন এসেছে, আর এটাই স্বাভাবিক। 'জেদ করে পুরোনোটা আকড়ে ধরে রাখলে এগোনো যাবে না,' বলেন আবু বকর।
ছবি: সালেহ শফিক/টিবিএস