মৃত্যুর মিছিল
৩৫.
এবার সত্যি ভীত হয়ে উঠল জ্যাক। শেকল বাঁধা পা ছাড়ানোর চেষ্টায় পাগল হয়ে গেছে সে।
'কি বলছ?' ভাঙা গলায় জানতে চাইল।
'ওই যে, আসছে ট্রাকগুলো, ওগুলো কিন্তু তালিবানদের,' বলল তারিক। 'কয়েক মিনিটের মধ্যেই এখানে এসে পড়বে ওরা। শুনেছি ওরা নাকি তোমার উপর বিলা হয়ে আছে।'
এখন রীতিমতো শেকল ধরে টানাহ্যাচড়া শুরু করেছে জ্যাক। 'ও আমার খোদা...!'
'এখন তোমার খোদা তোমার কথা শুনবেন কিনা জানি না,' বলল তারিক, 'তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, তুমি কিছু টের পাওয়ার আগেই তালিবানরা ঠিকই শুনবে।'
শেকলের ঝনঝনানি তীব্র হয়ে উঠল। জানপ্রাণ দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে জ্যাক। 'না...তুমি এটা করতে পারো না...'
ওর দিকে এগিয়ে গেল তারিক। এখনও যুঝছে লোকটা। 'তোমার মতো হালনাগাদ সাংবাদিককে কথাটা বলতে ভালো লাগছে না, কিন্তু তিন মাস আগে এখান থেকে পাঠানো খবরটা দেখেছ না? বেশ কয়েকজন তালিবান নেতা জমায়েত হয়েছিল সম্ভবত। ওরা গরম চা আর আটারুটি খাওয়ার সময় ওদের কোলের উপর তিনটা হেলফায়ার মিসাইল এসে পড়ে।'
এখন গোঙাতে শুরু করেছে জ্যাক; দুই হাতে শক্ত করে শেকল ধরে ক্রমাগত টানছে।
'এখন কথা হলো,' বলে চলল তারিক। 'ওই তালিবান নেতাদের একজনের সঙ্গে তোমার ভীষণ দহরমমহরম ছিল। স্বাভাবিকভাবেই কয়েকজন আমেরিকান হতাহতের পেছনে ওদের হাত থাকলেও তালিবানরা তোমাকে স্রেফ গুপ্তচর সন্দেহ করে বসেছে। তুমি ওদের কনভয় অ্যাম্বুশে সাহায্য করলেও ওরা ভাবছে ওটা তোমার কাভারের অংশ ছিল। খুবই মারাত্মক কাভার। কিন্তু আবার কার্যকরও।'
'এটা সত্যি না!' আর্তনাদ করে উঠল জ্যাক মিল্টন।
আগুয়ান উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাল তারিক। 'ওহ, আমি নিশ্চিত, তোমার কথা ওরা মেনে নেবে, জ্যাক, যদি না আগেই তোমার কল্লাটা নামিয়ে দেয়। অবশ্য তালিবানরা আবার চট করে মুণ্ডু কাটতে যায় না। তোমাকে কতল করার আগে সময় নেবে ওরা।'
শেকল টানাটানিতে ক্ষান্ত দিল জ্যাক। মুখ তুলে তারিকের দিকে তাকাল। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নেমে পাপা হেমিংওয়ে দাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে।
বেল্ট থেকে স্যাট ফোন খসিয়ে উঁচু করে ধরল তারিক। 'আমি হয়তো সবচেয়ে কাছের আর্মি এফওবির সাথে যোগাযোগ করতে পারি, কিন্তু ওরা কি এক এবং অদ্বিতীয় জ্যাক মিল্টনকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে?'
৩৬.
এতক্ষণ স্থির থাকলেও এবার ছোট শিশুর মতো গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল জ্যাক। ব্যাপারটা অবাক হওয়ার মতো না হলেও বছরের পর বছর যেভাবে নিজের দুঃসাহসী একটা ইমেজ গড়ে তুলেছিল, সেহিসাবে কিছুটা বিরক্তিকরই বটে।
'প্লিজ...দয়া করে আমাকে ফেলে যেয়ো না...প্লিজ...'
'ঠিকাছে,' বলল তারিক। 'আমি বিবেচক মানুষ।' আগে বেড়ে জ্যাকের মুখোমুখি দাঁড়াল ও। 'এবার তবে মুখ খোলো হে, বিশ্ব বিখ্যাত বেপরোয়া, দুঃসাহসী সাংবাদিক। জবানবন্দী দিয়ে ফেল। কাজটা করার জন্যে ঠিক ছয় মিনিট সময় পাচ্ছো।'
নাক টানল জ্যাক। 'আমি মোটেই বেপরোয়া, দুঃসাহসী সাংবাদিক নই। আমি ভুয়া। আমি একটা জোচ্চোর।'
'কি রকম?' প্রশ্ন করল তারিক।
'শোনোনি!' চেঁচিয়ে উঠল জ্যাক। 'আমি শুধু নিরাপদে পাহারা দেয়া জায়গাতেই যাই...নিরাপদ না হলে আমার যোগ্য লোকদের ভেতর থেকে কাউকে পাঠাই। সাবেক এনওয়াইপিডি সে, সত্যিকারের বডিগার্ড, আমাকে হুমকি দিলে যেকাউকে খুন করে ফেলতে সবসময় তৈরি। ধুৎ, দোকানে বড়দের ডায়াপার বিক্রির হওয়ার কথা জানো? ফীল্ডে সবসময় ওগুলো পরে থাকি, নইলে কাপড় ভিজিয়ে ফেলার অবস্থা হয়।'
'তোমার হয়ে যারা কাজ করে তাদের কথা যখন উঠল,' বলল তারিক, 'লিসা কুপারের কি করেছ তুমি, তোমার ক্যামেরাম্যান ওয়াল্ট কুপারের স্ত্রী, লিসা।'
'আ...আমি...প্লিজ...'
'ঘড়ি দেখার ভান করল তারিক।
'সময় কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে।'
'আ...আমি...জোর করে ওকে...আমি...'
'আক্রমণ করেছ, ঠিক?'
জ্যাকের মুখের চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল । হঠাৎ পেটের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠল ওর, বুঝতে পারল আরও ভয়ানক কিছুর শিকার হয়েছে লিসা কুপার।
'যৌন হামলা ছিল, ঠিক?' কণ্ঠস্বর নিচু রেখে জানতে চাইল ও।
'হ্যাঁ...তাই...আমি...প্লিজ, এটাই কি যথেষ্ট না?'
'এখনও একটু সময় বাকি আছে,' বলল তারিক, 'বলে যাও।'
'জেসাস, হয়েছে তো!' মরিয়া হয়ে আগুয়ান আলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে বলে উঠল সে। আগের চেয়ে আরও কাছে এসে পড়ায় এখন গাড়ির হেডলাইট চেনা যাচ্ছে।
'আমি একটা শয়তান, স্বীকার করছি,' বলল সে।
মরুভূমির হাওয়ায় আগুয়ান বিমানের এঞ্জিনের আওয়াজ পেল তারিক।
জ্যাক বলল, 'আর আমাকে নিয়ে গল্পগুলোর কথা? আমার ওই বইয়ের কোনো কিছুই সত্যি না। গোল্ডেন গ্লোবের পর দুজন অভিনেত্রীকে বিছানায় নেয়ার গল্প? নিরেট কেচ্ছা। ডাহা মিথ্যা।'
'একটু খোলাসা করো,' বলল তারিক, 'তোমার গোটা জীবনটা, তোমার ইমেজ, তোমার গোটা ক্যারিয়ার...,শুরু থেকে শেষপর্যন্ত স্রেফ মিথ্যার বেসাতি ছাড়া কিছুই না।'
এত জোরে মাথা দোলাল জ্যাক, মনে হলো পুতুলের রশি কেটে ফেলা হয়েছে। 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ...ঠিক তাই।'
আবারও ঘড়ি দেখল তারিক। 'এডগার অ্যালান পোর নাম শুনেছ?' জানতে চাইল ও।
ফের খিস্তি শুরু করল সে। তারপর জিজ্ঞেস করল, 'এর কি মানে?'
'তুমি "ঈশ্বরের দোহাই, মন্ত্রেসর," বললেই তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।'
আবার ওকে গাল বকল সে। বিদায়ের সময় হয়েছে। 'বিদায়, জ্যাক,' বলল ও। 'বিশ্ব নাগরিকদের সাথে বসে সকালের চা উপভোগ করো।'
কম্পাস পরখ করে হাঁটা শুরু করল ও। অচিরেই ওকে উদ্দেশ করে চিৎকার জুড়ে দিল জ্যাক। সম্ভবত এডগার অ্যালান পো'র 'দ্য কাস্ক অভ আমোন্তিলাদো'র কথাটাই বলছে, হয়তো বলছে না। সবচেয়ে কাছের মরুভূমিতে পিছলে হারিয়ে গেল তারিক। ট্রাকের এঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে গেছে জ্যাকের হাঁকডাক।
৩৭.
কম্পাস এবং জিপিএসে নজর রেখে আনুমানিক দশ মিনিট হাঁটার পর পায়ের নিচের জমিন ঢালু হতে শুরু করল। পেছনের ঘটনা দেখা যাবে এমন একটা সুবিধাজনক একটা জায়গা পেয়ে গেল তারিক। এনভিজি বিনোকিউলার দিয়ে পিটনে বাঁধা জ্যাকের দিকে নজর চালাল ও। মরিয়া হয়ে নিজেকে ছোটানোর কসরত করেই যাচ্ছে। তিনটা পিকআপ ট্রাপ ওকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন ওকে ঘিরে রেখেছে, যেন এই লোককে নিয়ে কি করা যায় বোঝার চেষ্টা করছে।
আর্তনাদ শুরু করল জ্যাক। তার চিৎকার এতদূর পর্যন্ত পৌছানোয় অবাক হলো তারিক, নিশ্চয়ই গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে সে।
লোকগুলো জ্যাকের চারপাশে ঘিরে দাঁড়াল।
চিৎকার আরও চড়ে উঠল।
ট্রাকগুলোর একটার উপর বিনোকিউলার স্থির করল ও। পার্ক করার কায়দার কারণে ওটার শাদা রং পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মরুধূলিতে ওটার শরীর ঢাকা পড়ে গেলেও দরজার গায়ে প্রতীক ও হরফগুলো অনায়াসে পড়া যায়।
পটভূমিতে গাছ, পাহাড়, লেক এবং মোষের ছবিঅলা একটা তীরের আকৃতি; হরফগুলো বলছে: ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস।
বিনোকিউলার নামাল তারিক। 'তুমি আসলেই একটা হাঁদা শুয়োরের বাচ্চা। এডগার অ্যালান পোকে ঘোড়ার ডিম চেনো তুমি, এও জানো না প্লেনে চারঘণ্টা একই জায়গায় চক্কর মেরে আফগানিস্তানে পৌঁছানো যায় না।'
বিনোকিউলার রেখে তৃপ্তির সাথে কুসুম গরম পানিতে চুমুক দিল ও। মুখ ধুয়ে কুলি করল।
'হাঁদা,' বলে আবার হাঁটতে শুরু করল।
অন্ধকারে চলতে সমস্যা হলেও ভালো দূরত্ব পেরিয়ে এলো ও। কেউ তাড়া করছে না, কেউ বন্দুক ছুঁড়ছে না। বুনো, উন্মুক্ত এলাকায় হেঁটে বেড়াতে ভালোই লাগছে। ওর মনের ভেতর ক্ষীণ একটা কণ্ঠস্বর পাহাড়ের বুকে হারিয়ে গিয়ে সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে চলতে বলছে। যেন সত্যিই অবসর নিয়ে হারিয়ে যায় ও, যেখানে কেউ ওর হদিস পাবে না। দুটো জিনিস বাদে কথাগুলো বেশ লোভনীয় লাগছে ওর।
মিশন এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি।
তাছাড়া আনিকা রয়েছে।
এগিয়ে চলল ও।
ভোরের ঘণ্টাখানেক আগে ঘড়িতে সময়টা দেখল ও। স্যাট ফোন হুক থেকে খসিয়ে চট করে একটা কল সেরে নিল। চটপটে নারী কণ্ঠ সাড়া দিলে বলল, 'কোয়ালা স্টিং, রেডি।'
'কনফার্ম দ্যাট, কোয়ালা স্টিং,' বলল নারী কণ্ঠ। ফোন রেখে দিল সে।
মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে রইল ও। যুদ্ধের মুখোমুখি না দাঁড়ানো একজন যোদ্ধা। এখন থেকে দিন আর সপ্তাহগুলো কি ঘটবে বোঝার চেষ্টা করল ও। তারপর ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে বলে সব বাতিল করে দিল।
ঘাড় ফিরিয়ে এঞ্জিনের শব্দের উৎসের দিকে তাকাল ও, দ্রুত এগিয়ে আসছে।
ওয়েবিং থেকে ঝুলন্ত বিভিন্ন গিয়ার এবং গ্যাজেটারি থেকে একটা স্ট্রব লাইট খসিয়ে জ্বালালো ও। ইনফ্রা রেডে কাজ করে স্ট্রোব, অর্থাৎ ওটার অবিরাম ফ্ল্যাশ-ফ্ল্যাশ মাথার উপরের লোক বা মেয়েটা ছাড়া কেউ দেখবে না।
আনুমানিক পঞ্চাশ মিটার দূরে ধূলো উড়িয়ে নেমে আসতে শুরু করল একটা কালো লিটল বার্ড এমএইচ ৬ হেলিকপ্টার। ধূলি আর নুড়িপাথরের কবল থেকে গা বাঁচাতে মুখ লুকোল ও। মাথা নিচু করে হালকা চালে ছুটতে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডেই ওটার পেছনে চালান হয়ে গেল ওর গিয়ার, পাইলটের পাশের আসনে জায়গা করে নিল ও। বাকল এঁটে হেডসেট পরল। কালেক্টিভ আর স্টিক নিয়ে ব্যস্ত পাইলট, লাল আভায় আলোকিত ইন্সট্রুমেন্ট পরখ করছে। মরুভূমির উপর দিয়ে ঝড়ের বেগে উড়ে চলল ওরা।
ঘাড় ফিরিয়ে জ্যাকের কাছে আসা পিকআপ ট্রাকগুলো দেখার চেষ্টা করল তারিক। কিন্তু কিছুই নেই ওখানে।
ইন্টারকমে পাইলটের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। 'ট্রেনিং মিশন কেমন হলো, স্যার?'
'এই মামুলি,' বলল ও।
৩৮.
একদিন পর। রবিন ও রেবেকা রায়হানদের নার্সারি হিসাবে পরিকল্পিত কমরায় কাউচে বসে আছে তারিক। টেলিভিশন চলছে, তবে ওটার ভলিউম কমিয়ে রাখা। রেবেকা রান্নাঘরে ব্যস্ত। কফি বানাচ্ছে। তারিকের পাশে বসেছে আনিকা, মামুলি সরকারী উর্দিতে চলতি ফ্যাশনের ছাপ দেয়ার চেষ্টা করছে সে।
'তারপরেও থানার ওসিকে জ্যান্ত ছেড়ে দিলে?' জানতে চাইল তারিক।
'অনেক সাক্ষী ছিল,' ভুরু কুঁচকে বলল ও।
'কিন্তু...আসলে ওর কথাই মেনে নিয়েছ তুমি, তাই না?'
মেয়েটা যেন প্রতিক্ষণে খেপে উঠছে। মুখে স্বীকার করতে না চাইলেও ব্যাপারটা ওর কাছে মজাদার লাগছে।
'দেখ, থানার পুলিসের একজন ওসি এসে ফায়ার লাইনে পার্ক করার কারণে নসিহত শুরু করেছিল। আমাকে সরে যেতে বলে সে। আমি বললাম, সেটা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই সেদিন তার প্রমোশনের দিন ছিল, কেরদানি দেখানোর তালে ছিল সে। আমার পরিচয় সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে অস্বীকার করে সে; কাউকে ফোন করতেও রাজি হয়নি। উল্টো বলেছে, "তুমি কে তার পরোয়া করি না আমি। তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। তোমার গাড়িও বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে।" তিন সেকেন্ডেই ব্যাটাকে কাবু করতে পারতাম আমি, কিন্তু তাতে পরে বহু কালি ঝরাতে হতো। কপালগুণে এনওয়াইডিপিডি টো-ট্রাকটা তুমি জ্যাককে ওখানে থেকে বের করে আনার সময় পর্যন্তও পৌঁছায়নি।'
কি বলবে বুঝতে পারছে না তারিক, তবে ব্যাপারটায় মজা পাচ্ছে। এ বাড়িতে ঝলমলে রোদেলা দিন, দারুচিনির সুবাস আর আরও কিছু জিনিসের সুগন্ধ উপভোগ করছে, তবে সেগুলো কি ঠিক ধরতে পারছে না।
'তারমানে আমি জ্যাককে টেনেহিঁচড়ে রেস্তরাঁ থেকে বের করে আনার সময় স্থানীয় থানায় ওরা তোমাকে জেরা করছিল, আঙুলের ছাপ নিচ্ছিল? ওফ, ওই ছবিগুলো হাতে পেতে এক মাসের বেতন কোরবানি দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করব না আমি।'
ঝাঝিয়ে উঠল আনিকা। 'ওসবের এখন আর অস্তিত্ব নেই। দোষটা তোমার। কাজ সারতে অনেক বেশি সময় নিয়েছ তুমি।'
'এটা তোমার কথা।'
'এবং সেটাই ঠিক।'
দুমগ কফি নিয়ে এলো রেবেকা। ওর হাত থেকে একটা কাপ নিয়ে চুমুক দিল তারিক। বেশ তেতো লাগল। বিনাবাক্যব্যয়ে আনিকার সাথে অদল বদল করল ওটা।
হাসল রেবেকা। 'আবার ঝগড়া করছ?'
'সাপে-নেউলের মতো,' বলল আনিকা।
'উঁহু, বলো নতুন প্রেমিকপ্রেমিকার মতো,' বলল তারিক। আরও প্রসারিত হলো রেবেকার মুখের হাসি। কিন্তু ওর পায়ে পা ঠুকে দিল আনিকা।
ভালো অজুহাত পেয়ে উঠে দাঁড়াল তারিক। কাউচের জায়গাটা রেবেকাকে ছেড়ে দিল।
'দাঁড়াও,' বলল অনিকা। 'এখন হেড লাইন বলবে।' রিমোট তুলে নিয়ে টেলিভিশনের ভলিউম বাড়াল ও।
এটা এনএনএন--জ্যাক মিল্টনের নেটওয়ার্কের প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদ সংস্থার খবর। ওদের শীর্ষখবরের শিরোনাম 'মরুভূমির বুকে বিখ্যাত সাংবাদিকের হেনস্তা।
একজন নারী ও পুরুষ সংবাদ পাঠকের প্রতিবিম্ব দেখা দিল পর্দায়। সকালের খবর নিয়ে পরস্পরের সাথে রসিকতা করছে ওরা, নানা চটকদার মন্তব্য করছে। তবে খবর প্রচারের সময় নীরব রইল ওরা।
আশ্চর্যের ব্যাপারই বলতে হবে, মরুভূমিতে ওটা জ্যাক মিল্টন, হুহু করে কাঁদছে, নাক টানছে, নিজের সমস্ত পাপের কথা স্বীকার করছে। তারিকের কাছে থাকা নতুন কোনো যন্ত্রে রেকর্ড করা হয়েছিল তার পাপের ফিরিস্তি।
কায়দাটা বের করতে পেরে খোদার কাছে শোকর জানাল তারিক।
খবর শেষ হলে প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদ সংস্থার নিউজ রুমে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বজায় থাকল। তারপর কিছু কাগজপত্র নিয়ে গোছাতে শুরু করল সংবাদ পাঠিকা। মুখে বলল, 'বেশ, এই ছিল আমাদের হাতে থাকা সর্বশেষ খবর।'
'নিশ্চয়ই,' গোছানো টেবিলের একটা কিছুর দিকে চোখ স্থির রেখে বলল অপর পাঠক। 'সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী জ্যাক মিল্টন জানিয়েছেন, তাকে...ইয়ে...ম্যানহাটানের জাঁ পল রেস্তরাঁ থেকে অপহরণ করা হয়...'
'অন্তত ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি!' বাধা দিয়ে বলল পাঠিকা। হেসে উঠল তার পার্টনার। তারপর খবর পড়া অব্যাহত রাখল ওরা। 'ঠিক, অপহৃত। নিউ জার্সির এক বিচ্ছিন্ন এয়ারস্ট্রিপে নিয়ে একটা কালো বিমানে উঠতে বাধ্য করা হয়। সেখান থেকে মোহাভে মরুভূমিতে নিয়ে গেছে তাকে অপহরণকারীরা।'
'কালো বিমান?' নিখুঁত শাদা দাঁত দেখিয়ে হাসতে হাসতে জানতে চাইল পাঠিকা। 'আমি তো জানতাম কালো হেলিকপ্টারই এই ধরনের কাজকর্ম করে থাকে।'
'আমিও,' বলল পাঠক, এখন খোলাখুলি হাসছে সে। 'আমার ধারণা ছিল ওগুলো সবসময়ই এরিয়া ফিফটি-ওয়ানে গিয়ে হাজির হয়। জানো তো, ওখানে ওরা বন্দীদের পেছনে নানারকম যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে...'
হাসির দমকে কুজো হয়ে গেল ওরা।
টেলিভিশন অফ করে দিল আনিকা।
দুহহাত বুকে বেঁধে চুপ করে বসল রেবেকা। শেষে বলল, 'আমি বলেছিলাম লোকটার ধ্বংস দেখতে চাই। এখনো সে বেঁচে আছে কেন, নিঃশ্বাস ফেলছে কিভাবে?'
'ওকে আঘাত দিতে বলেছিলে তুমি,' বলল তারিক। 'খতম করে দিতে বলেছ, বলেছ যেন গায়েব করে দিই। তাই করেছি আমরা।'
'ওর নেটওয়ার্ক ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে,' বলল আনিকা। 'হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে সে। জীবনেও আর টেলিভিশন বা পত্রিকায় কাজ করতে পারবে না, ওয়েবসাইটের জন্যেও লিখতে পারবে না। নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাটর্নি ইস্টার কার্ক নিউ রোচেলে সে লিসা কুপারের সাথে কি আচরণ করেছে তার তত্ত্বতালাশ করছে। আমাদের হাতে তার যৌন হামলার স্বীকারোক্তি আছে। ব্যাটার সোজা জেলে যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করবে ইস্টার। আজীবন যৌন হামলাকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে সে। অন্যদিকে আমরা সবসময় জেল থেকে দূরে, রবিনের জন্যে এখানে থাকব।'
'বলা বাহুল্য,' বলল তারিক। 'জ্যাক মিল্টনের মতো লোকদের ওরা কি করে জানো?'
সম্ভবত সায় জানিয়েই ধীরে ধীরে মাথা দোলাল রেবেকা, ভাবল তারিক। পাশের কামরা থেকে জোরলো কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। 'অ্যাই! কেউ একটু এদিকে আসবে?'
তিনজনই উঠে দাঁড়াল। উঠে বসেছে রবিন রায়হান। হাসছে সে। চেহারা আগের তুলনায় ভালো মনে হচ্ছে। ওর খোলা চোখটা উজ্জ্বল, চকচকে। ওর দিকে এগিয়ে গেল রেবেকা। জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেল। আনিকাকে ওর অন্য গালে চুমু খেতে দেখে একাধারে অবাক এবং অবেগপ্রবণ হয়ে উঠল তারিক।
সামনে বেড়ে রবিনের হাত ধরে মৃদু চাপ দিল ও, পাল্টা চাপ দিল রবিন। 'তোমাকে দেখে কি যে খুশি হয়েছি, ওস্তাদ,' বলল সে। কণ্ঠস্বর দৃঢ়।
'আমিও তোমাকে দেখে ভীষণ খুশি, রবিন। মনে হচ্ছে শেষমেশ সেরে উঠছ তুমি।'
'কথা হচ্ছে, আগামী কয়েক সপ্তাহ মাথা ঠিক রাখতে পারলে, নতুন পা আর হাত জুড়ে দেয়ার কাজ শুরু করতে পারব।' প্রবল, প্রকাশ্য ভালোবাসার দৃষ্টিতে রেবেকার দিকে তাকাল সে। 'খোদার কসম, রোজ আমার ঘরে ফিরে আমার বউ ল্যাংড়া নামে কাউকে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাক, মোটেও চাই না।'
'আমাদের ঘরে, বোকা কোথাকার,' আবার ওকে চুমু দিয়ে বলল রেবেকা।
তারিকের দিকে ফিরে রবিন বলল, 'ওস্তাদ, দেখে রাখো, এখন থেকে এক বছরের মধ্যে আবার চলাফেরা করতে পারব যখন, ঠিক সেই বালক আলেকজান্দারের মতো হয়ে যাব, উষ্ণতা আর ফুর্তির খোঁজে দুনিয়ে চষে বেড়াব।'
রেবেকা বলল, 'আমাকে রেখে যেয়ো না যেন, রবিন, তাহলে তোমার খবর আছে।'
একথায় হেসে উঠল রবিন। ওরাও যোগ দিল ওই হাসিতে। হাসতে হাসতে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করল ওরা। তখনই সুবাসটা কিসের ছিল বুঝতে পারল তারিক, আগে যেটা বুঝতে পারেনি।
আশার সুবাস ছিল সেটা।
৩৯.
বাইরে, জর্জিয়ার কড়া রোদে বেরিয়ে এসে চোখ রগড়াতে শুরু করল দুজনই, যেন চোখে কিছু পড়েছে। ভাড়া করা গাড়িতে উঠতে গিয়েও থমকে গেল আনিকা। তারিকও থামল।
রবিনদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আনিকা বলল, 'কি জানো, অনেকেই ভাবে প্রতিশোধ আসলে সময়ের অপচয় এবং সবারই অন্যকে বাঁচতে দিয়ে নিজে বেঁচে থাকা উচিত।'
'হ্যাঁ,' বলল তারিক।
'ওদের এই ধারণা ঠিক না।'
'আমার তরফে কোনও কথা নেই।'
ঘুরে চাবি বের করল আনিকা, আবার থেমে তারিকের দিকে তাকাল। 'একটা প্রশ্ন করি?'
'নিশ্চয়ই।'
'আমার বন্ধু আলীয়া। ও কি বীরের মতো মারা গেছে?'
'এরচেয়ে বীরত্বের কিছু আর হতে পারে না,' বলল তারিক। 'আমার পরিচিত অন্য দুজন মেয়ের কথা বাদে।'
ওই বাড়িটার দিকে ইশারা করল ও। 'ওদের একজন আছে ওখানে। স্বামীর জন্যে সংগ্রাম করছে। আর তুমি...ওদের দুজনের জন্যে লড়ছ।'
'স্রেফ ঠিক কাজটাই করছি আমি,' বলল আনিকা।
'আমরা সবাই কি তাই করছি না?' বলল তারিক।
কথাটা একটু যেন ভাবল আনিকা, তারপর বলল, 'কাজটা যদি ঠিক হয়ে থাকে...ইয়ে, সার্বিয়ার পর ইউনাইটেড স্টেটসে ফিরে কিছু করেছিলে তুমি?'
'সবকিছুর ফয়সালা করেছি।'
'কিভাবে?'
'তোমার মনে আছে, কয়েক মাস আগে সিআইএ-ও ডিরেক্টরেট অপারেশনসের ডেপুটি ডিরেক্টর হেনরি শাটনার মারা গেছে?'
'নিশ্চয়ই,' বলল ও। 'হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে।'
'মোটেও না,' বলল তারিক। জানে, এই মেয়ে অন্তত আধডজন আইন ভাঙতে দেখেছে ওকে। আরও একটায় কি এসে যাবে। 'আসলে সীসার বিষে মরেছে ব্যাটা।'
হাসি দেখা দিল আনিকার মুখে। অবশেষে দরজার তালা খুলল সে।
'এই তো লক্ষ্মী ছেলে। আমার টিমমেইট।'
৪০.
অবশ্য সরাসরি এয়ারপোর্টে গেল না ওরা। জর্জিয়ায় ওদের বাকি সময়টুকু মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ঘোষণা করল আনিকা। তর্কে গেল না তারিক। আটলান্টার ঠিক বাইরে চমৎকার একটা বেড-অ্যান্ড-ব্রেকফাস্ট হোটেলের খোঁজ পেল আনিকা। মুরগী, সর্ষে দিয়ে আলু ভর্তা, সীম, ঝোল এবং ঘরে তৈরি বিস্কিটে পেট পুরে খাবার সারল ওরা।
রাতের খাবার শেষে আনিকাকে উপরে পৌঁছে দিল তারিক।
'এবার কি?' জানতে চাইল ও।
'আগামীকাল ডিসিতে ফিরে যাব। আমার ধারণা নিউ হ্যাম্পশায়ারে তোমার জমাট বাঁধা স্বর্গেই ফিরে যেতে চাইবে তুমি।'
'যদি ওখানে যাওয়ার সুযোগ থাকে।'
'ওহ, সুযোগ থাকতেও পারে,' বলল ও। 'তবে বাজি ধরে বলতে পারি ভবিষ্যতে তোমার পড়শীরা তোমার একশো হাত দূরে থেকে চলাফেরা করবে।'
'সেইরকমই ইচ্ছা ছিল।'
ম্যানহাটানে যেমন করেছিল ও, আনিকার কামরায় ঢুকে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা নিশ্চিত করল। এই ঘরটা অসংখ্য থ্রো-পিলোয় ভর্তি। ভিন্টেজ ওয়ালপেপার, বাথরুমে হ্যান্ড সোপ।
আগের মতোই খাটের কিনারে বসেছে আনিকা, জ্যাকেট খুলে হাতের পিঠে মাথা রেখে তারিকের দিকে তাকাল ও।
দরজার দিকে এগিয়ে গেল তারিক।
হাতলে হাত রাখল।
তালা দেয়া আছে, নিশ্চিত হয়ে নিল।
আবার আনিকার কাছে এসে বলল, 'আমি দুঃখিত...আলীয়াকে বাঁচাতে পারিনি।'
মাথা দোলাল ও। 'সবকিছু জানতে চাই না। শুধু জানতে চেয়েছি তুমি সাধ্যমতো করেছ।'
'তাই করেছি। কিন্তু যথেষ্ট ছিল না।'
'অনেক সময় এমন হয়।'
অপেক্ষা করতে লাগল ও, বুকের ভেতর ধকধক করছে; মুখ শুকিয়ে গেছে, নিজেকে কেমন বেমানান লাগছে। অনেকটা এয়ারক্র্যাফট থেকে প্রথমবারের মতো প্যারাশূট নিয়ে মহাশূন্যে লাফিয়ে পড়ার সেই মুহূর্তটার মতো। সবকিছু ঠিক থাকবে বিশ্বাস করে অন্ধের মতো ঝাপ দেওয়ার কথা জানা ছিল।
মুখ নামিয়ে আনিকার ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেল তারিক। সাড়া দিল সে। দুই হাতে ওর মাথা আঁকড়ে ধরল ও। পরস্পরকে চুমু খেল ওরা।
ভীষণ মিষ্টি আনিকার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তারিক। আনিকার ব্লাউজের বোতাম খুলতে শুরু করল ও। ফিসফিস করে আনিকা বলে উঠল, 'থাম।'
'কেন?' জানতে চাইল বিভ্রান্ত তারিক।
হাসল আনিকা। ওর হাসির শব্দ মোহিত করে ফেলছে ওকে। 'আমরা এখন একটা টিম, তাই না?' তারপর নিজেই ব্লাউজের বোতাম খুলতে শুরু করল। হঠাৎ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল ওদের। কে আগে ব্লাউজের বোতাম খুলতে পারে। কে জিতেছে, বলতে পারবে না ও। আনিকাকে হ্যাঁচকা টানে কোলে তুলে নিল ও, নরম বিছনায় শুইয়ে দেয়ার মুহূর্তে মনে মনে ভাবল তাতে কিছু এসে যায় না।
- (শেষ)