ইপিজেড প্রকল্পে বিলম্ব: হারাচ্ছে এফডিআই ও রপ্তানি আয়
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/14/p1_info-2.jpg)
৪৬৬ কোটি টাকার এককালীন বিনিয়োগ থেকে ৪২০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের দরজা খুলে যেতে পারে, বছরে আসতে পারে ৮৪০ কোটি টাকার রপ্তানি আয় এবং তৈরি হতে পারে ১৪ হাজার কর্মসংস্থান।
যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা যেকোনো মানুষ দ্বিতীয় চিন্তা না করেই এই সুযোগ লুফে নিত। সুস্থ মস্তিষ্কের কেউই এত লাভজনক বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে আসতে চাইবে না।
কিন্তু জায়গাটা বাংলাদেশ। এখানে প্রকল্প বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধি বর্ষার বন্যার মতোই অবধারিত। এবার দেরির শিকার চারটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) আটটি কারখানা ভবনের নির্মাণ, যা তৈরি করা হচ্ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য।
পরিকল্পনাটি ছিল সহজ—ভবন নির্মাণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা। কিন্তু এর বাস্তবায়ন পরিণত হয়েছে আরেকটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নমুনায়।
প্রকল্পটি শুরু হয় ২০২২ সালে। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৬৬ কোটি টাকা। ঠিকাদারের কাজে মন্থরগতি, ওয়াটার রিজার্ভ নির্মাণে জটিলতা ও গ্যাস পাইপলাইন স্থানান্তর না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি নির্মাণকাজ।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/14/p1_-jump-info-2.jpg)
চট্টগ্রাম ইপিজেডে দুটি ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। সেখানে বিল্ডিং-২-এর নির্মাণকাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৩ শতাংশ হলেও নির্ধারিত সময়ের ৮৩ শতাংশ ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। ৪২ কোটি টাকার চুক্তিমূল্যে ঠিকাদার ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু করে ২০২৩ সালের অক্টোবরে। ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ভবনের নিচতলার পশ্চিম পাশে গ্যাস পাইপলাইন সরাতে বিলম্ব করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এছাড়া পানি রিজার্ভের কাজে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হওয়ায় কাজের বাস্তবায়নে হচ্ছে ধীর গতিতে। এতে নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন শেষ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঈশ্বরদী, উত্ততরা ও মোংলা ইপিজেডে ভবন নির্মাণকাজেরও একই অবস্থা। ভবন নির্মাণ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় এসব কারখানা কবে চালু হবে সে বিষয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) তথ্যানুসারে, ভবনগুলোর নির্মাণ সম্পন্ন হলে ৩৫ মিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ আসবে, বার্ষিক ৭০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হবে এবং ১৪ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
কিন্তু আপাতত এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের চিরচেনা বিলম্বের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া স্রেফ কিছু তথ্য শুধুই কাগজে-কলমে রয়ে গেছে।
ভবনগুলো নির্মাণের ফলে ১ লাখ ২৭ হাজার ২৭২ বর্গমিটার জায়গা পাওয়া যাবে। বেপজার রাজস্বও বাড়বে এর মাধ্যমে।
বেপজার তথ্যানুসারে, চট্টগ্রাম ইপিজেডে নির্মাণাধীন প্রথম ভবনটি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, অথচ এর মধ্যে নির্ধারিত ৬৭ শতাংশ সময় চলে গেছে।
চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন অন্য ভবনগুলোর অগ্রগতি যথাক্রমের ৩৩ শতাংশ, ৩৪ শতাংশ ও ৩৮ শতাংশ। অথচ চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ভবনগুলো নির্মাণের চুক্তি ছিল।
মোংলা ইপিজেডে মাত্র ২০.০৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, বাকি ৮০ শতাংশ শেষ করতে হবে জুনের মধ্যে।
উত্তরা ইপিজেডের ভবনটির নির্মাণকাজ ৪৪ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, আর ঈশ্বরদীতে দুটি ভবনের অগ্রগতি যথাক্রমে ৬০ শতাংশ ও ৫০ শতাংশ। ভবন দুটি নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল মার্চ ও এপ্রিলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেপজার কর্মকর্তারা বিলম্বের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে আশ্বাস দেন তারা।
তারা বলেন, কাজের গতি বাড়াতে ঠিকাদর ও জোনের প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। তাদের সঙ্গে সভা করা হবে।
এ প্রকল্পের লক্ষ্য নিজেরা নির্মাণের ঝামেলায় না গিয়ে আগেই প্রস্তুত কারখানা নিতে আগ্রহী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্ণ প্রস্তুত স্পেস সরবরাহ করা।
প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা কিছু সময় হাতে রেখে জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছি। তবে আমাদের প্রকল্পর মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেস্বর পর্যন্ত। প্রয়োজনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে আরও ৩ মাস সময় দেওয়া হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, ঈশ্বরদী ইপিজেডের দুটি ও উত্তরা ইপিজেডের একটি ভবন আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্মাণ শেষ হবে। আর চট্টগ্রাম ইপিজেডের চারটি ভবনের নির্মাণ চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
বেপজা সূত্রে জানা গেছে, এসব কারখানার বেশ চাহিদা রয়েছে। বিশেষত ছট্টগ্রাম ইপিজেডের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কিছু বিনিয়োগকারী ইতিমধ্যে ভবন নেওয়ার আগ্রহও প্রকাশ করেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণ শেষ করতে পারলে শুধু চট্টগ্রাম ইপিজেডেই মোট ৫৪ হাজার ৬৭২ বর্গমিটার স্পেস তৈরি হবে। ভাড়া দিয়ে এসব ভবন থেকে বেপজার রাজস্ব বাড়বে প্রতি মাসে ১.৬৪ লাখ ডলার।
বেপজার সদস্য (ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন) মো. আশরাফুল কবির সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইপিজেডগুলো প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট এফডিআইয়ের ২৯ শতাংশ এসেছে এই ইপিজেডগুলো থেকে।
তিনি বলেন, সম্মিলিতভাবে মাত্র ১৩.৯৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে আসা মোট ১ হাজার ৪৬৮.১৭ মিলিয়ন ডলার এফডিআইয়ের মধ্যে ৪২৪.২৯ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এনেছে ইপিজেড ও বেপজা ইকোনমিক জোনগুলো।
বর্তমানে দেশের আটটি ইপিজেডে ৪৪৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে ২৫৬টি বিদেশি মালিকানাধীন, ৪৯টি যৌথ উদ্যোগের এবং ১৪২টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান। আরও ১০৮টি শিল্প ইউনিট নির্মাণাধীন।
এই ইপিজেডগুলোতে সাইকেল, কসমেটিকস, মোবাইল যন্ত্রাংশ, শক্তি সাশ্রয়ী বাল্ব ও সেফটি ইকুইপমেন্টসহ নানা পণ্য উৎপাদিত হয়।
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেপজা মোট ৬.৯১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১৪.৯১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে।
তবে চলমান প্রকল্পগুলোর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—কারণ এটি শুধু বিনিয়োগের গতি ধরে রাখবে না, বরং ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারীদের চাহিদাও পূরণ করবে।