অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষ: মৎস বাণিজ্যের সম্ভাবনাময় খাত
খাওয়ার জন্য নয়, পালার জন্য যে মাছ সেই মাছ চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের চাষীরা। ময়মনসিংহের কয়েকটি উপজেলায় হচ্ছে বাহারি জাতের এসব অ্যাকুরিয়াম ফিসের পোনা উৎপাদন ও চাষ। বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। গবেষকরা বলছেন এসব মাছের বড় অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তবে দেশে এর চাষ ব্যাপক হারে করা গেলে রয়েছে চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির সুযোগ।
বাসাবাড়ি কিংবা অফিসের ভেতরের শোভা বৃদ্ধির জন্যে আমাদের দেশের মানুষের অ্যাকুরিয়াম মাছ পালার শখ আছে। তবে এই শখটি নতুন এক বাণিজ্যেকে প্রসারিত করেছে। অ্যাকুরিয়াম শুধুই একটি কাচের শোপিস নয়, এটি অনেকের জন্য এখন উপার্জনের উৎসও।
ময়মনসিংহ শহরের অলকা নদীবাংলা মার্কটের বেশ কয়েকটি অ্যাকুরিয়াম ফিসের দোকান রয়েছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা অ্যাকুরিয়াম ফিসের কদর ক্রমশ বাড়ছে। এখানকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, অ্যাকুরিয়াম ফিসের প্রতি কম বয়সের ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়েছে। বাসায় নিজেদের সাধ্যমতো শখে মাছ পালন করছে অনেকেই। সরঞ্জামের দাম একটু বেশি। আর মাছের জাত বাড়ানো আরও বাড়ানো গেলে বিক্রী আরো বাড়বে। এই ব্যাবসায় তিনি আরো বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। একই মার্কেটের আরেক ব্যাবসায়ী রাসেল বলেন রঙিন মাছের বেশির ভাগ বিদেশি তাই দামও বেশি। এসব মাছ যদি দেশে উৎপাদন হতো তাহলে শোভাবর্ধনকারী অনেক মাছই ক্রেতার হাতের নাগালে থাকতো। তিনি জানান স্থানীয়ভাবে কিছু চাষ হয় যা তিনি কম দামে দিতে পারছেন। ক্রেতারাও খুশি হচ্ছেন।
দোকানের বাইরে ময়মনসিংহে বাণিজ্যিকভাবেও অ্যাকোরিয়াম ফিসের উৎপাদন শুরু হয়েছে। এরকম একটি হ্যাচারি হল আমিন হ্যাচারি এন্ড ফিসারিজ। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল ইসলাম ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধলা এলাকার একজন মাছ চাষী। অন্যান্য মাছের সঙ্গে প্রথমে শখের বসে তিনি একুরিয়ামের মাছ চাষ শুরু করেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে পোনা ও মাছ উৎপাদন করছেন তিনি। সরবরাহ করছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার অ্যাকুরিয়াম শপগুলোতে। ময়মনসিংহে তিনিই প্রথম এ ধরনের মাছ চাষ করেন। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে পোনা এনে প্রথমে নিজে চাষ করে এর চাষপদ্ধতি শিখেন। রঙিন মাছ চাষ নতুন হওয়ায় এই কাজে সহযোগিতা করার মতো কাউকে পাননি তিনি। নিজে নিজে শিখেছেন। এখন মাছের রেনু থেকে পোনা উৎপাদন করে পরে বিক্রি করেন। ঢাকার কাটাবনে নিয়মিত মাছ সরবরাহ করেন তিনি। সাইফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে বিশ প্রজাতির অ্যাকুরিয়াম ফিস চাষ করছেন তিনি। পাঠাচ্ছেন ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, খুলনায় বিভিন্ন অ্যাকুরিয়ামের দোকানে। ছোট মাছ প্রতি পিস ১২ টাকা থেকে শুরু ৫'শ টাকা পর্যন্ত পাইকারি দামে বিক্রি করেন। আর আকারে একটু বড়গুলো দুই হাজার টাকা থেকে প্রতি পিস ৫০ হাজার টাকাও বিক্রি হয়।
তিনি আরও জানান, দামি মাছের ক্রেতারা হচ্ছেন দেশে গড়ে উঠা রিসোর্টগুলো। যারা রিসোর্টের শোভা বৃদ্ধিতে জলাশয়ে রঙিন মাছ রাখেন। জানা গেলো বছরে গড়ে বিশ লাখ টাকার এই মাছ বিক্রি করেন সাইফুল ইসলাম। যেখানে লাভের পরিমাণ মোট বিক্রির ত্রিশ শতাংশ।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার আরেক মাছ চাষী সেলিম মিয়া বলেন, স্বল্প পরিসরে শুরু করলেও এখন দিনে দিনে তার বাজার বাড়ছে। তিনি অ্যাকুরিয়াম শপগুলোয় সরাসরি সাপ্লাই দেন। দোকানদার ঘরে বসেই তার মাছ পেয়ে যায়। তার ব্যাবসারও দ্রুত প্রসার ঘটছে। তিনি বলেন, 'এসব মাছ নিয়ে দেশে গবেষণা করে দেশেই অ্যাকুরিয়ম ফিশের জাতের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। সহজ চাষ পদ্ধতি বের করা গেলে আমাদের নতুন আয়ের এ পথ আরও গতি পেত। নতুন নতুন উদ্যোক্তা আগ্রহী হতো।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মাছ চাষী লিজন জানান, 'দেশে চাষ করা মাছের রঙের উজ্জলতা একটু কম থাকে। এটি হয়তো পানির সমস্যা বা খাবারের মাত্রার হেরফের। এই সমস্যা সমাধান করে যদি মৎস বিভাগ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে উৎপাদন বাড়বে, পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি কমবে অ্যাকুরিয়াম ফিসের।'
ময়মনসিংহে অ্যাকুরিয়াম ফিসের চাষে নতুন কর্মসংস্থানও হচ্ছে। ত্রিশালের মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, আগে বেকার ছিলেন তিনি। পরে কাজ নেন আমিন হ্যাচারি এন্ড ফিসারি প্রজেক্টে। এধরনের মাছ চাষে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও দেখে দেখে শিখে নিয়েছেন তিনি। এখন মাসে আট হাজার টাকা বেতন পান। জানালেন এমন অনেকেই আছে যারা কাজ করছেন এসব মাছ চাষের প্রজেক্টে।
কথা হয় বাংলাদেশ মৎস গবেষণা ইনষ্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.খলিলুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন ও থাইল্যান্ড উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভ করেছে এ ধরনের মাছ চাষ করে। বাংলাদেশে এখনও অ্যাকুরিয়াম ফিসের বড় অংশই বিদেশ থেকে আসে। তবে দেশের মাছ চাষীদের এই সেক্টরে আগ্রহী করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা যাবে বিদেশেও। বিদেশে এধরনের মাছের ব্যাপক চাহিদা আছে তাই এই খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন খাতও হতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ মাছ চাষে বিশ্বে অনেক এগিয়ে।
তিনি নিশ্চিত করেন এ লক্ষ্যে, বাংলাদেশে মৎস গবেষণা ইনষ্টিটিউট কাজ করছে। বিদেশি মাছের পাশাপাশি দেশীয় কিছু মাছের জাতও আছে যা অ্যাকুরিয়ামের জন্য চাহিদা রয়েছে। তাই অ্যাকুরিয়াম ফিস হিসেবে দেশীয় প্রজাতির কিছু মাছের প্রজনন ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন তারা।