গুপ্তচর থেকে রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার লেখক জন লে কারের বিদায়
'দ্য স্পাই হু কেইম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড' বইয়ের লেখক বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জন লে কার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
রোববার তার প্রতিনিধি জনি গেলার এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ক্যারির মৃত্যুসংবাদ জানানোর সময় তিনি বলেন, "তার মতো কাউকে আর দেখবো না আমরা। তার বিস্ময়কর কাজ দিয়ে গত ছয় দশক ধরে বেস্টসেলার বইয়ের তালিকা ও রিভিউ পেজে তার আধিপত্য বজায় ছিল।"
ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হলেও প্রাথমিক জীবনে তিনি ব্রিটেনের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন। তার আসল নাম ডেভিড জন মুর কর্নওয়েল। নিজের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার অনুপ্রেরণাতেই গোয়েন্দা কাহিনী লেখা শুরু করেন। তবে তার তৎকালীন পেশার কারণে জন লে কার ছদ্মনামেই লেখা শুরু করেন। সে থেকেই এ নামে পরিচিত হন তিনি। গুপ্তচর থেকে গুপ্তচরবৃত্তির উপন্যাসের লেখক বনে যাওয়া লে কার ব্রিটেনের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত লেখক।
টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই, দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডেনার, দ্য নাইট ম্যানেজার, আ মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান সহ মোট ২৫টি বই লিখেছেন তিনি। ১৯৬৩ সালে তার তৃতীয় বই 'দ্য স্পাই হু কেইম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড' প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে।
সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব বার্নে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ইনটেলিজেন্স অফিসারের কাজ শুরু করেন। ১৯৫০ ও ৬০'র দশকে ব্রিটেনের বৈদেশিক গুপ্তচর বিভাগের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এমআই৬ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা এমআই৫ এ কাজ করেছেন তিনি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্কন কলেজে পড়ার সময় গোপনে এমআই৫ এর হয়ে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী দলগুলোতে সোভিয়েত গুপ্তচর আছে কিনা তার অনুসন্ধানই ছিল তার কাজ। ১৯৫৬ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর ইটন কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি এমআই৫ এর অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং জিজ্ঞাসাবাদ ও কিছু গোপন অভিযানে কাজ করেন।
তার বাবা রনি কর্নওয়েল গ্যাংস্টার দলের এক সদস্যের সহযোগী ছিলেন, ইনস্যুরেন্স জালিয়াতির কারণ জেল খাটেন তিনি। ডেভিডের বয়স যখন ৫, তখন তার মা পরিবার ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২১ বছর বয়সে আবার মায়ের দেখা পান তিনি।
কখনো জাঁকজমকপূর্ণ সময়, কখনো বা একেবারেই কপর্দকহীন অবস্থায় দিনাতিপাত; চরম অনিশ্চয়তায় কেটেছে তার শৈশব। ১৯৯৬ সালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "সম্পূর্ণ পৃথিবীই যেন ছিল শত্রুপক্ষের আস্তানা।"
পেশাগত কারণে নিজ নামে বই প্রকাশে বাঁধা থাকায় তার প্রথম বই 'কল ফর দ্য ডেড' জন লে কার ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। আরেকজন ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা কিম ফিলবি তার পরিচয় তার পরিচয় প্রকাশ করে দেয়ার পর তার গুপ্তচর জীবনে ইতি ঘটে।
দ্য স্পাই হু কেইম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড বইয়ের চরিত্র জর্জ স্মাইলির ওপর লেখকের আলাদা দুর্বলতা ছিল। পরবর্তীতে 'টিঙ্কার টেইলর, সোলজার, স্পাই', 'দ্য অনারেবল স্কুলবয়' ও 'স্মাইলিস পিপল' বইয়েও চরিত্রটি দেখা যায়।
কর্নওয়েল একবার বলেছিলেন, "এরকম অতীত, স্মৃতি, অস্বস্তিকর গোপন ব্যক্তিগত জীবন, পেশাগত উৎকর্ষের ধারণাসহ চরিত্রটি যে মুহূর্তে আমার মাথায় আসলো আমি বুঝতে পারি কাজ করার ও কোনোকিছু অবলম্বন করে বেঁচে থাকার মতো আমারও কিছু আছে।"
প্রয়াত লেখকের পরিবার জানিয়েছেন, "ডেভিড তার ৫০ বছরের সঙ্গী জেন সহ নিকোলাস, টিমোথি, স্টিফেন ও সাইমন নামের চার ছেলে রেখে গেছেন। আমরা তার মৃত্যুতে শোকসন্তপ্ত।"
ঔপন্যাসিক রবার্ট হ্যারিস লেখকের ব্যাপারে বলেছেন, "তিনি এমন একজন লেখক যিনি শুধু অসাধারণ লেখক ছিলেন না, নতুন এক সংস্কৃতি তৈরি করেছেন তিনি- এ গুণই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।"
লকডাউনের পুরো সময় জুড়ে তার নিজ বাসায়ই ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সরকারের মহামারি সামলানোর ব্যর্থতার কড়া সমালোচনা করেন তিনি। গত মে-তে তিনি বলেছিলেন, "সর্বত্র জাতীয় ব্যর্থতার চিহ্ন দৃশ্যমান। এর পেছনে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের বিগত অন্তত ১০ বছরের কার্যক্রমও দায়ী।"
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন "একজন মানুষ উচ্চশিক্ষিত হলেও প্রচণ্ড অজ্ঞ হতে পারেন।" মহামারির পর সম্পদের সমান অধিকারের ভিত্তিতে ন্যায্য সমাজ গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তার উপন্যাসের চরিত্র জর্জ স্মাইলির চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে তিনি স্নায়ু যুদ্ধের সময়কার পৃথিবীর অন্যায় অবিচারের বাস্তবিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তার টিংকার টেইলর, সোলজার, স্পাই অবলম্বনে ১৯৭৯ সালে নির্মিত ড্রামা সিরিজে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা অ্যালেক গিনেজ। ১৯৮০'র দশকে প্রকাশিত হয় তার আরেক মাস্টারপিস 'আ পারফেক্ট স্পাই'।
বার্লিন প্রাচীর পতনের পর সোভিয়েত-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ধারণা থেকে বেরিয়ে স্নায়ুযুদ্ধকালীন গোপন অস্ত্র কারবারের ব্যাপারে দ্য নাইট ম্যানেজার বইটি লিখেন। নতুন শতাব্দীর শুরুতেই বড় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা উঠে আসে তার 'দ্য কনস্ট্যান্ট গার্ডেনার' বইটিতে। পরের দশকেই 'আ লিগাসি অব স্পাইস' বইয়ে তার প্রিয় চরিত্র জর্জ স্মাইলিকে দেখা যায় আবারও।
২০১৯ সালের অক্টোবরে তার শেষ উপন্যাস 'এজেন্ট রানিং ইন দ্য ফিল্ড' প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে প্রকাশ পায় তার এক খন্ডের আত্মজীবনী 'দ্য পিজিওন টানেল'।