বিজয়ের বাতাসেও দীর্ঘশ্বাস
দেশে যুদ্ধ চলছে, ঝরে যাচ্ছে হাজারো প্রাণ। বাধ্য হয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পরের দেশে আশ্রয় নিতে ছুটে চলেছে কাতারে কাতার মানুষ। এমন সময়ে ফুটবল দল তৈরি করে ভারতের মাটিতে ম্যাচ খেলায় ব্যস্ত বাংলাদেশের এক দল যুবক। ফুটবল খেলে কীভাবে দেশ স্বাধীন হবে? অনেকের মতো এমন প্রশ্ন মনে ভিড় করেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদেরও।
এই প্রশ্নের উত্তর মিলতে বেশি সময় লাগেনি। ভারতে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে নেমেই ফুটবল পায়ে দেশ স্বাধীন করার পথ পেয়ে যান সাইদুর রহমান প্যাটেল, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, জাকারিয়া পিন্টু, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, বীরেন কুমার বীরু, মুজিবর রহমান, বিমল কর, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, নওশেরুজ্জামানরা। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জনমত গঠন করা, বৈশ্বিক স্বীকৃতি লাভ করা। কিন্তু অর্থের যোগানও পেয়ে যান বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই সূর্যসন্তানরা।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা হায়দরাবাদ, জয়পুর, মুম্বাইসহ বিভিন্ন প্রদেশে ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে অভাবনীয় সাড়া পায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। দেশের পক্ষে জনমত গঠন করার পাশাপাশি ভারতের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ প্রবাসী সরকারের হাতে তুলে দিতে থাকেন ফুটবল যোদ্ধারা।
সে সময় ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মনসুর আলী খান পাতৌদি, কিংবদন্তি ফুটবলার চুনি গোস্বামীদের সঙ্গে ফুটবল খেলার সুযোগ হয় তাদের। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বলিউড মহিরুহ দিলীপ কুমার, কিশোর কুমাররা। মুক্তিযোদ্ধাদের ফান্ডে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা জমা দেয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
সময় গড়িয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশে ফিরে মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়েছেন ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের শেষ থেকে ফুটবল দিয়ে দেশকে মুক্ত করার মিশনে নাম লেখানো বাংলাদেশি ফুটবলাররা। এরপর পেরিয়ে গেছে ২০, ৪০, ৪৯ বছর। আজও তৃপ্ত হতে পারেননি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা। চারজন ছাড়া স্বীকৃতি মেলেনি বাকি ফুটবলারদের, পাননি স্বাধীনতা পুরস্কার। আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূর করতেও এগিয়ে যাননি কেউ।
প্রতি বছর ডিসেম্বর এলে পৌঢ় এসব ফুটবলারদের খোঁজ করে মিডিয়া। আর নিজেদের আক্ষেপ, হতাশা, দীর্ঘশ্বাসের কথা জানিয়ে যান তারা। এবারও বদলায়নি গল্প, বিজয়ের ৪৯ বছরেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের কণ্ঠে একরাশ হতাশা-আক্ষেপ। একটু ভালো থাকার জন্য আকুতি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই লোমহর্ষক সফর, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়, স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন দলটির বেশ কয়েকজন ফুটবলার।
সাইদুর রহমান প্যাটেল (প্রতিষ্ঠাতা)
সংক্ষিপ্ত করে বলার জন্য এই অংশ থেকে বলছি। বিক্রমপুরে গিয়ে আমি ট্রেইনিং শুরু। গ্রামের শত শত উৎসাহী মানুষ এসে দেখতো। দক্ষিণ চারিগাঁও নওয়াপাড়ার তরুণ সমাজকে নিয়ে বসে, তাদের ব্রিফিং দেই যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দেশ স্বাধীন করার শপথ নিয়ে তোমাদের অস্ত্র দিয়ে গেলাম, তোমরা যতটা পারো যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যদি পাক আর্মি আসে। এরপর আমরা বিভিন্ন গ্রুপ করে বর্ডার ক্রস করলাম। আমার গ্রুপে ছিল লুৎফর রহমান, মহসিন সাহেব আর মুজির বহমান ভূইয়া। মুজিবর রহমান তখন দক্ষিণ চারিগাঁও নওয়াপাড়ার চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে উনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন। আমার সাথের তিনজনই আমরা সিনিয়র, চাচা বলি উনাদের। আমার বয়স তখন ২১। আমরা আগরতলা হয়ে কলকাতা যাই। কিন্তু কলকাতায় থাকার জায়গা তো আমাদের ছিল না।
৫০-৬০ এর দশকে পাটুয়াটুলিতে ব্যবসা করা অমৃত বস্ত্রালয়ের মালিকরা বালিগঞ্জে গিয়ে ব্যবসা শুরু করে। তাদের বাসা পন্ডিতিয়া রোড, সুবোধ সাহাদের বাসা। মহসিন চাচা বললেন সুবোধ আমার বাল্যবন্ধু, ও গ্যান্ডারিয়াতেই ছিল। ওর বাসায় যাই, মনে হয় ও আমাকে ফেলবে না, আমার এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঠিকানাটা মহসিন চাচার কাছে ছিল। আমরা সুবোধ সাহাদের বাড়িয়ে গিয়ে উঠি। সুবোধ চাচা অনেক আগে কলকাতা গেলেও তার ভাষা পুরো ঢাকাইয়া। উনি বললেন আসো ভাতিজারা, আমিও বাঙালি।
উনি ড্রইং রুম ছেড়ে দিলেন আমাদের জন্য। উনারা চার ভাই আমাদের সব কথা শুনলেন রাত একটা পর্যন্ত। এর মধ্যে লুৎফর রহমান বলে উঠলেন প্যাটেল কিন্তু পিডব্লিউডির খেলোয়াড়। তখন সুবোধ কাকার ছোট ভাই তারক কাকা বললেন, তুমি প্রথম বিভাগের ফুটবলার? কোনো চিন্তা নেই, তোমাকে আমি বেঙ্গল নর্থ রেলওয়ের (বিএনআর) চাকরি নিয়ে দিবো। এই ক্লাবটা অন্যতম সেরা একটা ক্লাব ছিল। তখন আমি বলি আমি কাপুরুষের মতো জীবন বাঁচাতে আসিনি। সবাইকে রেখে এসেছি, দেশকে স্বাধীন করতে আমি যুদ্ধে চলে যাব।
ভোর বেলায় আমাদের বেড টি দিয়েছে, সুবোধ কাকারা নেমে এসেছে। আমরা চারজন বসা। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাইকে রেখে আমরা চলে এসেছি, মনের মধ্যে সব সময় আতঙ্ক। এর মধ্যেই আমার মুখ দিয়ে যে কথাটা চলে আসে, সেটা আল্লাহ প্রদত্ত। আমি এখনও অবাক হই কীভাবে ওই কথাটা চলে আসে। আমি বললাম, আমি সুন্দর একটা চিন্তা করেছি। বললাম আমরা যদি একটা ফুটবল দল গঠন করতে পারি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের তহবিল এবং জনমত আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা একটা ভূমিকা রাখতে পারব। আর আমাদের খেলোয়াড়রাও তো আমাদের সম্পদ। দল গঠন করতে পারলে তারাও চলে আসবে এখানে, নিরাপদও থাকবে। তারাও দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবে, জীবনও রক্ষা পাবে।
তখন লুৎফর রহমান কাকা আমাকে বলে ওঠেন, তোর ছেলেমি এখনও যায়নি। তুই পাগল হয়েছিস? দেশে হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, গণহত্যা চলছে আর তুমি এখানে বিলাসিতা করবে? আমি ক্ষেপে যাই। আমি বলি, আমি ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতি করছি, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের যোগান দিতে থানা লুট করলাম আর আপনি আমাকে ছেলে মানুষ বলছেন? মহসিন চাচা তখন বলে ওঠেন, ভাতিজাকে বলতে দাও। তখন আমি বললাম, একজন শ্রমিক সারাদিন যে খাটনি খাটে, আমাদের ৯০ মিনিটের খাটনি তার চেয়ে কম না। আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফুটবল খেলব। আমরা একটা ল্যাংড়া দল করলেও দেখবেন দর্শকদের ঠাই দেওয়ার জায়গা থাকবে না। কারণ সারা ভারতের দৃষ্টি তখন বাংলাদেশের দিকে।
তখন লুৎফর কাকা হেসে বলে, আমি তো ফুটবল বুঝি না, কীভাবে হবে এটা? আমি বললাম বেরিয়ে পড়ি, তারপর দেখেন কীভাবে হয়। আপনি এটার সেক্রেটারি হবেন। দেখবেন মন্ত্রীর চেয়েও বেশি সম্মান পাবেন। আমরা বের হয়ে গেলাম। এরপর আমরা খাতা-কলম কিনে দেশপ্রিয় পার্কের পাশে ছোট্ট রেস্টুরেন্টে বসে ড্রাফট করলাম। অ্যাডড্রেস করলাম তাজউদ্দিন সাহেবকে। যদিও উনার সামনে তখন আমরা যাই-ও নাই। এরপর আমরা প্রিন্সিব স্ট্রিট গিয়ে দোতলায় কামরুজ্জামান সাহেবের কাছে গেলাম। আমি বললাম, লিডার এমন ভেবেছি। উনি বলে ওঠে, মারাত্মক প্ল্যান তোমার। উনি আমাদের হাত খরচ বাবদ দুই'শ রুপি করে ৮০০ রুপি দিলেন।
পাশে বসেন শামসুল হক সাহেব, প্রাক্তন মন্ত্রী। উনি পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীন বাংলা দলের সভাপতি হন। উনার রুমে গিয়ে বসলাম। সব বললাম। উনি বললেন তোমাদের সাথে আমি আছি। তখন ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে তাজউদ্দিন সাহেব, নজরুল সাহেব বসেন। কর্ণেল ওসমানিও বসেন। তোফায়েল ভাই, ডলি আপারাও তখন নিচে বসেন। আমরা ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে গেলাম। শামসুল হক সাহেব আমাদের তাজউদ্দিন সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। উনি আমাদের সবাইকে চিনতেন। তখন আমি বললাম, লিডার আমরা যদি একটা ফুটবল দল গঠন করতে পারি, মুক্তিযুদ্ধের ফান্ড গঠন করতে পারব, বিশ্ব জনমত আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা একটা অবদান রাখতে পারব। সারা দুনিয়া জানবে আমরা মাঠে নেমেছি।
ব্যাখা দেওয়ার পর উনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ইয়াং চে প্যাটেল তোমার মাথায় এই বুদ্ধি কীভাবে এলো। করতে পারবে তো! আমি বললাম আপনি যদি অনুমতি দেন, আমরা যদি বেতারে প্রচার করতে পারি, আমি আশাবাদী দল হয়ে যাবে। আবার বললাম কোনোরকম একটা দল যদি দাঁড় করাতে পারি, মানুষের জায়গা দেওয়ার উপায় থাকবে না। উনি তখনই আমাদের অনুমোদন দিলেন। বললাম ভারত সরকারের অনুমোদনের জন্য সহযোগিতা চাই। উনি বললেন অবশ্যই। সব ধরনের সহযোগিতা পাবে। উনি আমাদের ১৪ হাজার টাকা দিলেন। ওই সময় যা অনেক। উনি প্রশংসা করে বললেন আমি টাকার চেয়ে জনমত আদায় বেশি গুরুত্ব দিই। উনি অনুমোদন দিলেন, এই আমাদের শুরু হয়ে গেল।
উনি একটা কমিটি করে আনতে বললেন। আমরা পার্ক সার্কাস এলাকার সাকি বার এন্ড রেস্টুরেন্টে বসে কমিটি করলাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে আমরা চিপ পেট্রন রেখে পেট্রন করলাম সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। পেট্রন করলাম তাজউদ্দিন আহমেদকে। প্রথম সভাপতি শামসুল হক সাহেব, সেক্রেটারি লুৎফর রহমান, ট্রেজারার মহসিন সাহেব। সদস্য হলেন জামালপুরের হাকিম সাহেব, ভালুকার এমপি এমএ মতিন, মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া। লুৎফর রহমান বললেন তুই সবার উপরে, দলই তো করলি তুই। উনি বললেন প্রস্তাবক ও সংগঠক তুই। ভারত সরকার, আইএফএর অনুমোদন হয়ে গেল। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএ) অনুমোদনও হয়ে গেল।
পার্ক সার্কাসের ভেতরের মাঠটা আমাদের অনুশীলনের জন্য বরাদ্দ করা হলো। সিলেটের মকবুল হোসেন লিটু ভাই ও বিক্রমপুরের এক ভাই কোকোকোলা বিল্ডিংয়ে ১৭ নম্বর ফ্লাটের আড্ডা দিতেন। উনারা বললেন আকবর আলী ভাই এটা ভাড়া দিতে পারেন, তোমরা আসো। সাহায্য চাইতেই উনি জড়িয়ে ধরলেন। উনি খুশি হলেন স্বাধীনতার পক্ষে যুক্ত হতে পেরে। দুটি রুমি ছিল, ডাইনিং, ড্রইং কিচেন। উনি বললেন, যতদিন দেশ স্বাধীন না হয় আপনারা এখানে ফ্রি থাকবেন। সুবোধ কাকার বাসা ছেড়ে আমরা এখানে উঠি। আমি তখন বিএনআরের মাঠে অনুশীলন করি। আমাকে তারা বলেন সামনে লিগ, তুমি আমাদের দলে খেলবে। এরপর মঈন সিনা আসে। ও বললো আমি বাংলাদেশে যাব, খেলোয়াড় আনতে যাব। ও চলে গেল ঢাকায়।
আমরা গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ওখানে পেলাম হাসান ইমাম ও আলী জাকেরকে। আমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে উনারা বললেন, আজ থেকেই এটা চলবে। এটা মহৎ কাজ। সেদিন বিকাল থেকেই প্রচার শুরু হয়ে যায়। এরপর পার্ক স্ট্রিট দিয়ে আমি হেঁটে যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখি আমাদের ফেমাস আশরাফ ভাই। আশরাফ ভাইকে সব বুঝিয়ে বললাম। উনি বললেন আমি খেলব। এরপর একে একে আলী ইমাম ভাই, প্রতাপ দা, নূর নবী, লুৎফরকে পেয়ে গেলাম। বেতার কেন্দ্রে প্রচার চলছে। এরমধ্যে মঈন সিনা নিয়ে এলো শাজাহান ভাই, লালু ভাই, প্রফেসর সাঈদকে। আটজন হলাম। সিরু চলে এলো।
বেতার কেন্দ্রের খবরে আগরতলায় অনেক খেলোয়াড় চলে আসে। কিন্তু আগরতলায় যেতে চারদিন তিন রাত সময় লাগে। এরপর তাজউদ্দিন সাহেব সাহায্য করলেন। বিএসএফের ডেকোটা প্লেনে আমরা লুৎফর চাচা, মহসিন চাচা ও প্রতাপ দাকে পাঠালাম। এরপর আইনুল ভাই, নওশের, সুরুজ, তসলিম ভাই, সালাউদ্দিন সবাইকে নিয়ে এলো। এরপর পার্ক সার্কাসে অনুশীলন শুরু। এরপর তান্না ও পিন্টু ভাই আসেন। পিন্টু ভাই তখন নাম করা খেলোয়াড়। তার বয়স, ম্যাচুরিটি সব মিলিয়ে তাকে আমরা অধিনায়ক করলাম। ভাইস ক্যাপ্টেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। তান্নাকে আমরা ম্যানেজার করলাম। ননী বসাক রেফারি হলেও তাকে আমরা কোচ দেখালাম। কারণ কোচ তো দেখাতে হবে। এরপর আমরা খেলা শুরু করি। আমি দুটি ম্যাচ খেলে দেশে যুদ্ধ করতে চলে আসি। তবে আমাদের দল ১৬টি ম্যাচ খেলে।
আমি এখনও স্বীকৃতি পাইনি। কী কারণে তা নিয়ে আমি এখনও অন্ধকারে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলে আল্লাহ তাআলা খুশি হন। সেখানে আমি একজন মানুষ। আমার কাজের স্বীকৃতিটা তো আমার পাওয়া উচিত ছিল। এ ব্যথা আমার থাকবেই। সালাউদ্দিন স্বাধীনতা পদক পেয়েছে। অমলেশ পেয়েছে স্বাধীনতা পদক। বিএনপির সময়ে পিন্টু ভাই পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। প্রতাপ দাও সে সময় পেয়েছেন। কয়েকজন খেলোয়াড় পেল, অধিনায়ক পেল। আর আমি নিজে হাতে এতো বড় একটা কাজ করে স্বীকৃত নই, এমন কি দলটাও স্বীকৃত নয়। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি স্বীকৃতির দাবিদার। কিন্তু আমি স্বীকৃত নই। কোনো দামই নেই এর, কোনো মূল্যই পেলাম না। পিন্টু ভাই, সালাউদ্দিন, অমলেশ স্বাধীনতা পদক পেলে ফাউন্ডার হিসেবে সাইদুর রহমান প্যাটেল স্বাধীনতা পদক পেতে পারে না? একা একা এতো বড় কাজ করে, সব খেলোয়াড়কে যোগাড় দল গড়েছি। কিন্তু এটার কোনো দামই পাইনি।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পক্ষ থেকে আমি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের অমলেশ দাকে আর্থিক সাহায্য করেছেন, আইনুলের মৃত্যুর পরে তার পরিবারকে ১৫-২০ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। তসলিম ভাইকে দিয়েছেন ৩০ লক্ষ টাকার সঞ্চয় পত্র এবং নগদ ৫ লাখ টাকা। আশরাফ ভাইকে মিরপুরে তিন বেডের একটা ফ্ল্যাট দিয়েছেন এবং হয়তো ২৫ লক্ষ টাকার সঞ্চয় পত্র দিয়েছেন। ফজলে সাদাইন খোকনকে দিয়েছেন হয়তো ১৫ লক্ষ, যশোরের লুৎফর মারা যাওয়ার পরে তার পরিবারকে দিয়েছে ১৫-২০ লাখ টাকা, খালেক মারা যাওয়ার পর তার পরিবারকে দিয়েছেন একই পরিমাণে।
আমি তখন ঢাকা ছিলাম, তান্নাও ছিল। কিন্তু আমাদের ডাকা হয়নি। আমাদের সাথে রেখেই এসব টাকা দেওয়া যেত, আমাদের ভালো লাগতো। কে অর্গানাইজ করেছেন জানি না। আমাদের ডাকা হয়নি, খারাপ লেগেছে। প্রধানমন্ত্রী অনেক করেছেন। কিন্তু এখন সুরুজ অসহায়, মাহমুদ মারা গেছেন, তার পরিবার অসহায়। প্রধানমন্ত্রী যেন এদিকে সদয় দৃষ্টি দেন। মুজিবরও ভালো অবস্থায় নেই। বিমল দার অবস্থাও ভালো নয়। মোজাম্মেল দ্বারে দ্বারে হাত পাতে। গোলরক্ষক মমিন অসুবিধায় আছে। এদের দিকে নজর দিলে ভালো হতো। নওশের চলে গেছে, আমিও চলে যাব। কিন্তু স্বীকৃতি পাইনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু করে সব সেক্টর স্বীকৃত, শুধু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ছাড়া। অনেকেই বলে গ্যাজেটে তোমাদের নাম আছে, স্বীকৃতি তো দিয়েছেই। তখন আর বলার কিছু পাই না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা নেই আমার। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, এটা বলতে এখনও আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ৩০ লক্ষ প্রাণ, লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করলাম, সেই আনন্দ প্রকাশ করার ভাষা আসলেই নেই আমার কাছে। এরচেয়ে বড় আনন্দ পৃথিবীতে কিছু হতে পারে না। এরচেয়ে বড় কিছু নেই। আমরা বাঙালিরা এখন স্বাধীন, এরচেয়ে বড় অর্জন, আনন্দ আমাদের জীবনে আসেনি।
১০ জানুয়ারি যখন আমরা জাতির জনককে ফিরে পেলাম, সেটাও বিরাট এক আনন্দের ছিল। স্বাধীন হওয়ার পরও বাঙালি জাতি চিন্তিত ছিল যে বঙ্গবন্ধুকে আমরা জীবিত অবস্থায় পাব কিনা। সে সময় মা-বোন, মুরুব্বি, তরুণ সমাজ নামাজ পড়ে, কোরআন পড়ে দোয়া করেছে, মাদ্রাসায় দান করেছে, যেন বঙ্গবন্ধু জীবিত অবস্থায় চলে আসেন। তো এসব আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। একজন মানুষের জীবনে স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় অর্জন। আমি গর্বিত যে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্নভাবে অবদান রাখতে পেরেছি।
কাজী সালাউদ্দিন
ঢাকা থেকে আগরতলা আর ওখান থেকে কলকাতা পৌঁছানো, এটা ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি তখন ধানমন্ডিতে থাকতাম। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে রাত দুইটার সময় রওনা করলাম। হেঁটে হেঁটে আমরা সদরঘাট গেলাম। সদরঘাট থেকে নৌকা নিয়ে ওপার গেলাম। জায়গাটার নাম কাঠপট্টি। নৌকায় বেশিক্ষণ যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ হেলিকপ্টার ঘুরতো, উপর থেকে ফায়ার করতো। নৌকা দেখলে ওরা ফায়ার করতো। আমরা নৌকা থেকে দেখেছি গুলি করার দৃশ্য। এ কারণে পুরোটা নৌকায় না গিয়ে নদী পার হই। ওপাড় গিয়ে দেড় থেকে দুই দিন হেঁটেছি। এরপর আগরতলা পৌঁছাই। আগরতলা যাওয়ার পর ভারতের পুলিশ আমাদের দুজনকে গেপ্তার করে। তারা তো আমাদের চিনতো না।
এরপর আমাদের জেলে রাখে। পরেরদিন ভোর বেলা কয়েকটা জিপ এলো। যেখানে মুক্তিযোদ্ধার অফিসাররা ছিলেন। তখন ছাত্রনেতা ছিলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। উনি আগরতলা ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। উনি ভোরবেলা এসে জেল তদারকি করতেন। ওখানে উনার সঙ্গে আমার দেখা। উনি বলেন তুমি জেলের মধ্যে কেন। আমি বলি আগে বের করেন আমাকে। উনি আমাকে বের করেন। আগরতলা ক্যাম্পে আমি সাতদিন ছিলাম। তখন উজ্জ্বল নামে এক ফটোগ্রাফার ছিলেন, উনি আমাদের কার্গো প্লেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। কারণ ওখান থেকে ট্রেনে কলকাতায় যেতে আড়াই-তিন দিন সময় লাগতো। তো উনি কার্গো প্লেনে ব্যবস্থা করে দেন। সাড়ে তিন ঘণ্টায় ছোট্ট কার্গো প্লেনে কলকাতা যাই। ওখান থেকে ক্যাম্পে যোগ দিই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনে জানতাম ওখানে ক্যাম্প।
আমরা প্রথম ম্যাচ খেলি কৃষ্ণনগরে। পুরো মাঠ ভর্তি ছিল, মানুষ আর মানুষ। ওই ম্যাচটা আমরা ড্র করি। ওখানে আমাদের পতাকা উড়ানো ছিল না। তখন আমরা স্বাধীন না হওয়ায় পতাকা উড়ানো হয়নি। কিন্তু আমরা জিদ করলাম আমাদের পতাকা উড়াতে হবে। অনেক আলোচনার পরে আমাদের পতাকা উড়ানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে এই সিদ্ধান্ত দেওয়ায় ওখানকার ডিসি সাসপেন্ড হয়ে যান। এরপরের ম্যাচটা ছিল কলকাতায়। মোহনবাগানের সঙ্গে খেলি। ওরা গোস্টপাল নামে খেলে। ওই ম্যাচে আমরা ২-২ গোলে ড্র করি। আমি এবং এনায়েত গোল করি। মোহনবাগানের বিপক্ষে দুই গোল করে ড্র করায় আমরা জনপ্রিয়তা পেয়ে যাই। মনে হচ্ছিল আমরা ফুটবল খেলতে জানি।
তারপর বোম্বেতে নবাব পাতৌদি খেলেন ২০ মিনিট। উনি তখন ভারত ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। দীলিপ কুমার, শর্মিলা ঠাকুর থেকে শুরু করে অনেক নায়ক-নায়িকা মাঠে এসেছিল। ওরা অনেক টাকা দান করেছে। এই টাকা আমরা প্রবাসী সরকারের হাতে জমা দিয়েছি। আমরা খেলে যে টাকা পেতাম, সেটা সরকারকে দিয়ে দিতাম। আমি তখন মোহামেডানে খেলতাম। আমার বয়স ছিল ১৬ অথবা সাড়ে ১৬। আমি সবচেয়ে কম বয়সী ছিলাম আমাদের দলের। আমি তূর্য হাজরা নামে খেলি। কারণ দেশে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ছিল। নামটা বেশি ছড়ালে হানাদাররা আমার বাবা-মাকে ধরে নিয়ে চলে যাবে, এ কারণে নাম বদলাই। তূর্য আমার ডাক নাম। পরে টাইটেল জিজ্ঞাস করলে হাজরা বলি। সামনে যে টাইটেল পেয়েছি সেটাই বলে দিয়েছি আর কি।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল স্বাধীনতায় অনেক বড় অবদান রেখেছে। আমরা সরাসরি স্বাধীনতার অংশ। আমরা মন, প্রাণ এবং স্বশরীরে ভূমিকা রেখেছি স্বাধীনতায়। বঙ্গবন্ধু আমাদের আদেশ দেন, আমরা সিপাহী। আমরা বঙ্গবন্ধু এবং দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি।
দেশ যেদিন স্বাধীন হয়, সেদিন ভোরবেলা কোনো এক জায়গা থেকে খেলে আমরা কলকাতায় এলাম। ওখানে আমাদের ক্যাম্প ছিল। রাতে কলকাতা শহর তখন ব্ল্যাকআউট হতো। এয়ারফোর্সের বোম্বিংয়ের কারণে এটা করা হতো, পাকিস্তান বোম্বিং করতো। কিন্তু রাত সাড়ে ৮-৯টার সময় হঠাৎ দেখি চিল্লা-চিল্লি শুরু হয়েছে পুরো শহরে। আর লাইট জ্বলে উঠেছে। তখন খবর পেলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারতীয়রা আমাদের সঙ্গে উৎসব করছিল। ওদের উদযাপনও দেখার মতো ছিল।
দেশ স্বাধীনের খবরে কেমন মনে হচ্ছিল, কী অনুভব করছিলাম, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি স্বপ্নেও মনে করিনি দেশে ফেরত যেতে পারব। বাবা-মা, ভাই-বোনকে আবার দেখতে পারব, এটা শুনতেই কাঁদতে শুরু করি। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি এক জানুয়ারি দেশে ফিরি। ওখান থেকে বাসে করে আগতলা তারপর ভেঙে ভেঙে আসি। যশোর থেকে খুলনা, এরপর ওখান থেকে স্টিমারে করে ঢাকা আসি।
বীরেন কুমার বীরু
আমরা একেকজন একেকভাবে ভারতের মাটিতে গিয়ে পৌঁছাই। আমরা মূলত শরণার্থী হিসেবে যাই। পরবর্তীতে পত্রিকা ও রেডিওতে শুনতে পাই স্বাধীনতার পক্ষে একটা ফুটবল দল তৈরি হবে, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এটা পরে নাম হয়েছে, আগে ছিল জয় বাংলা ফুটবল দল। যারা খেলাধুলা করতো বা আগ্রহী তাদেরকে ডাকা হয়। তখন পার্ক সার্কাসে কান্দানিয়া স্টেট (কোকাকোলা বিল্ডিং) নামে একটা ভবন ছিল, যেখানে আমাদের কিছু সিনিয়র খেলোয়াড় থাকতেন। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। এই দলটা গঠন করার পেছনে ছিল সাইদুর রহমান প্যাটেল, উদ্যোক্তা হিসেবে। এ ছাড়া আলী ইমাম, পিন্টু ভাই, প্রতাপ দা, আইনুল ভাই, আশরাফ ভাইরা ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দল গঠনের নজির নেই, আমরা যেটা তৈরি করেছি। আমাদের কথা ছিল অন্যরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে, আমরা ফুটবল নিয়ে যুদ্ধ করতে চাই, প্রতিবাদ করতে চাই। আমরা স্বাধীন দেখতে চাই আমাদের দেশকে।
তো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনে আমরা কান্দানিয়া স্টেট বিল্ডিং বা কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে যাই। এরপর ৪০ জনের মতো খেলোয়াড়কে সেখানে যুক্ত করা হয়। কয়েকজন বাদ যাওয়ার পরে পার্ক সার্কাস মাঠে আমাদের অনুশীলন শুরু হয়। বাছাইয়ের পরে আমরা ৩৬-৩৭ জন মনোনীত হলাম। এরপর আমরা কোকাকোলা বিল্ডিংয়ের বড় একটি রুমে গাদাগাদি করে থাকতাম। অতজন মানুষের জন্য একটি টয়লেট ছিল। অনেক সময় টয়লেট ব্যবহার না করতে পেরে বাইরে যেতে হতো। এরপর কলকাতা নিউ মার্কেটের পেছনে মল্লিক বিল্ডিংয়ে উঠানো হলো। ওখানে আমাদের ক্যাম্প হয়, আমরা ওখানে থেকে অনুশীলন করতাম।
বিভিন্ন মাঠে অনুশীলন করতাম, এরপর খেলার প্রস্তাব আসতে শুরু করে। ১৬টা ম্যাচ খেলি আমরা, ১১টিতে জয় পাই আমরা। ২টিতে হেরে যাই, বাকি ম্যাচগুলো ড্র হয়। এখান থেকে যে ফান্ড উঠেছিল, সেটা আমরা প্রবাসী সরকারের হাতে দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধা ফান্ডে। সালাউদ্দিন নাম পাল্টে তূর্য হাজরা নামে খেলেছিল। সালাউদ্দিন আর এনায়েত খুব নাম করেছিল। ওদের খেলো দেখে ভারতের মানুষ ভক্ত হয়ে গিয়েছিল যে, এতো সুন্দর খেলে। পিন্টু ভাই, কায়কোবাদ, প্রতাব দা, আইনুল, আশরাফ, তসলিম ভাই, সালাউদ্দিন, এনায়েতদের খেলা দেখে ওরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেক দর্শক হতো সব ম্যাচে।
প্রথম ম্যাচ আমরা কৃষ্ণনগর খেলি। সেখানে অনেক মানুষ হয়েছিল। যে দেশে যুদ্ধ চলে, মানুষ মারা যাচ্ছে, সেই দেশ দল গঠন করেছে আবার খেলবে। এটা দেখতে অনেক মানুষ জড়ো হয় সেখানে। দ্বিতীয় ম্যাচ খেলি মোহনবাগান মাঠে গোস্টোপাল একাদশের বিপক্ষে। মোহনবাগানের সিনিয়র গোস্টোপালের নামে দল করা হয়। এরপর বানপুর, জয়পুর, দূর্গাপুর, বিহার, উড়িষ্যা, নরেন্দ্রপুর, হায়দরাবাদ, বোম্বেতে (বর্তমানে মুস্বাই) খেলি আমরা। বোম্বেতে নবাব পাতৌদি, যিনি ভারত ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন, তিনি বোম্বে ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে খেলেন। দীলিপ কুমার ও কিশোর কুমার আমাদের আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা দেশে ফিরি। দলের সেক্রেটারি লুৎফর রহমান সাহেব আমাদের সার্টিফিকেট ও হাত খরচ দিয়ে দেশে ফিরে আসতে বলেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরা কাঁদতে কাঁদতে দেশে ফিরে আসি।
এরপর তো অনেক সময় গেছে। সবাই আমাদের আশ্বাস দিল কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা স্বীকৃতি বা পুরস্কার কিছুই পেলাম না। ১৯৭২ সালে একটি ফুটবল ম্যাচ হয়, সেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হ্যান্ডশেক করেন আমাদের সাথে। কিছুদিন আগে করোনায় মারা যাওয়া আমাদের একজন নওশেরুজ্জামানের সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধু হাত মেলাচ্ছিলেন, নওশের নাম বলেছিল ওর। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, 'ও তুমি এক সের, দুই সের নয়, নয় সের? অনেক ওজন। ঠিক আছে তোমার যখন ওজন, এই ওজনের পুরস্কার দেওয়া হবে।' উনি নিজেই বলেছিলেন আমাদের পুরস্কার দেওয়া হবে, সম্মান দেওয়া হবে। কিন্তু জাতির পিতার কথা এখনও কেউ রাখেনি। এটা আমাদের দুঃখ যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা আজ আমাদের প্রধানমন্ত্রী, উনাকে আমরা নানা জায়গায় নানাভাবে অনুরোধ করেছি স্বীকৃতি দিতে। কিন্তু এখনও আমরা তা পাইনি। আপনার মারফত অনুরোধ করছি, মিনতি করছি, উনার হাত দিয়েই যেন আমরা স্বীকৃতি পাই। আমরা যেন পুরস্কার পাই।
আমাদের ৩৬ জনের মধ্যে ১২ জন মারা গেছে। ছয়জন আছে বিদেশে। আমরা কজন বেঁচে আছি, এর মধ্যে তসলিম ভাই অসুস্থ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ যে উনি তসলিম ভাইকে সাহায্য করেছেন। খোকন অসুস্থ, তাকেও প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। নওশের, এর আগে লুৎফর মারা গেছে, তাকেও প্রথানমন্ত্রী সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমরা চাই আমাদের একটু ডেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে পুরস্কার দিক বা কাছে ডাকুক। এটা আমাদের আবেদন, উনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী, উনার কাছেই তো বলব।
নারায়নগঞ্জের সঞ্জিত আর্থিকভাবে খুব বাজে অবস্থায় আছে, অসুস্থও। আমি বীরু কথা বলছি, আমিও আর্থিক দৈন্য অবস্থায় আছি। আমার দুটি ছেলে-মেয়ে এখনও চাকরি পায়নি। আমি জুট মিলে চাকরি করতাম, রিটায়ার্ট করেছি। অল্প কিছু টাকা পেয়েছিলাম। আমাদের অবস্থা ভালো না। হাকিম ভাই যশোরের, উনিও অসুস্থ। আমরা পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। প্রায় সবারই ৭০ এর উপরে বয়স হয়ে গেছে। তারপর অসুস্থ, এ ছাড়া আর্থিক দিক থেকে দৈন্য অবস্থায় আছি। এটা অনেকেই বোঝে না, বুঝতে চায় না।
দুঃখ লাগে জয় বাংলা বলে দেশের স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না। এটা খুব দুঃখ জাগায়। মাঝে মধ্যে ১৬ ডিসেম্বরে চ্যানেল আই আমাদের একটু ডাকে, স্টেজে উঠি, আমাদের একটু ক্যামেরায় দেখায়, এই পর্যন্তই। এনএসসি থেকে আমাদের মাত্র তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। যা কারও কাছে বলতেও পারি না। আমরা আর্থিক অনুদান বাড়াতে আবেদনও করেছিলাম। আগের ক্রীড়ামন্ত্রী বীরেন শিকদারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, 'ঠিক আছে যান বাড়িয়ে দেওয়া হবে, ১০ হাজার করে দেব।' আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এটা হয়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেমন লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না। এখন বলতেও আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে। ১৬ই ডিসেম্বর পশ্চিম বাংলার সব লাইট সন্ধ্যার সময় জ্বলে উঠলো আর আমরা শুনলাম আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিশ্বাস করুন আমরা যারা ক্যাম্পে ছিলাম, একে অপরকে ধরে সে কী কান্না! হাউমাউ করে কেঁদেছি। ৩ তারিখে তো যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ৩ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত ব্ল্যাকআউট। সব সময় অন্ধকার থাকতো। এরপর যখন লাইট জ্বললো আর জানলাম দেশ স্বাধীন, কী যে এক অনুভূতি, ব্যক্ত করতে পারব না। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এসব অনুভূতি। নিজেদের ধরে কাঁদছিলাম, ভাবছিলাম দেশ স্বাধীন, নিজেদের দেশে ফিরে যাব। আত্মীয়-স্বজন পাব, লোকজন পাব।
মুজিবর রহমান
কঠিন অবস্থা যাচ্ছিল। আমরা প্রথমে গেলাম সশস্ত্র ট্রেনিং নেয়ার জন্য আগরতলায়। আমার মনে হয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচ আমরা, যারা এপ্রিলের দিকে আগরতলা যাই। সেখান থেকে ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশে আসার পর মুজিব নগর থেকে মেসেজ আসে আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও শুনতে পাই ফুটবল খেলোয়াড়দের দেখা করার ব্যাপারে। তখন ওখানে যাই, এরমধ্যে যশোর রণাঙ্গনে আবার আমার বড় ভাই শহীদ হয়েছেন। সেই জন্য যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা আমার বেশি, কেননা আমার প্রতিশোধ নিতে হবে।
কিন্তু আমার আত্বীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই আমাকে বলেছে যেহেতু আমি খেলি, খেলার সাথে আছি তাই মুজিব নগর যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল এবং আমি গেলাম। তারপরেই আমি ফুটবল টিমের সাথে যোগদান করি। তবে আমি ভাবছিলাম, ফুটবল খেলে কী করব আমরা। দুই-একটা ম্যাচ খেলার পরে দেখলাম এটাই তো বেশি প্রয়োজন আমাদের। হাজার হাজার দর্শক খেলা দেখতে আসে এবং তারা তাদের খুশি মতো টাকা দিচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঔষধ, খাবার কেনার জন্য যে যেভাবে পারছিল সেভাবে সাহায্য করছিল। আমরা যে ফান্ড তুলেছি সেটা প্রবাসী সরকারকে দিয়েছি। প্রথম ম্যাচে আমরা যখন মাঠে নামি, তখন দেখি ভারতের পতাকা ওড়ে, আমাদের পতাকা নেই। তখন বললাম না, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি আমাদের পতাকা উড়বে, জাতীয় সঙ্গীতও বাজবে। তারপর আমরা জাতীয় পতাকা নিয়ে গোটা মাঠ প্রদক্ষীণ করলাম, জয় বাংলা শ্লোগান দিতাম, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান হতো।
সেই যে একটা অনুভুতি, সেখানে বিদেশি সাংবাদিকরা, দর্শকরা উপস্থিত থাকতো। তখন দেখলাম যে এটা অনেক ভালো আমাদের জন্য। এবং এটা বিদেশেও অনেক প্রভাব ফেলতো। আমরা ভারতের বেশ বড় বড় শহরগুলিতে খেলেছি। আমরা ১৬টা ম্যাচ খেলেছি। আমি তখন ইন্টারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। তখন আমাদের সাথে খেলেছেন নবাব পাতৌদি। উনি অনেক ভালো ক্রিকেটার ছিলেন, ফুটবলও অনেক ভালো খেলতেন। তারপর কলকাতাতে ইন্ডিয়ার বিখ্যাত খেলোয়াড় চুনি গোস্বামী খেলেছেন। তারা খেলেছেন আমাদের সঙ্গে মোহনবাগানের হয়ে।
এখনও স্বীকৃতি পাইনি, আক্ষেপ কাজ করে। শুধু ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু আমাদের একটা খেলা দিয়েছিলেন ঢাকা একাদশ বা বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আবু সাঈদ ও বঙ্গবন্ধু। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে এসে পরিচিত হয়েছেন, আমাদের খেলা দেখেছেন পুরো ৯০ মিনিট। আর খালেদা জিয়ার আমলে উনি একদিন এসে আমাদের ক্রেস্ট দেন। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, আমরা যার নেতৃত্বে যুদ্ধ করলাম, যার কথায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, তার কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের জন্য কিছু করে নাই। কিচ্ছু করে নাই, এটা হলো বড় দুঃখের। তার কাছে অনেক বলা হয়েছে, অনেক প্রস্তাবও গেছে আমাদের স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার জন্য।
কিন্তু সমাজে কিছু লোক আছে, তারা বলে এদেরকে কেন স্বাধীনতা পুরস্কার দেবেন? সেই রাজাকারদের কথায় আবার থেমে যায় সবকিছু। আমাদের অনেক খেলোয়াড় মারা গেছে। তবে ক্রীড়া সংস্থা থেকে আমাদের মাত্র তিন হাজার টাকা দেয়া হয়। এটা দেয়ার চেয়ে না দেয়াই ভালো। এটা লজ্জা দেয়া। প্রতিমাসে এই তিন হাজার টাকা দেয়, একজন রিকশা চালকও এর থেকে বেশি আয় করে, একজন শ্রমিকও। স্বীকৃতি না দেওয়াটা যন্ত্রণা দেয়। আমরাই তো প্রথম স্বাধীন বাংলার খেলাধুলাকে এগিয়ে আনলাম। আমাদের শুধু ফুটবল ধরতে পারবেন না, আমাদের যেসব খেলাধুলা আছে, প্রত্যেকটা খেলাধুলাকেই আমরা এগিয়ে নিয়ে এসেছি। তাহলে আমাদের সম্মান আমরা পাবো না কেন, আমাদের সম্মান দিতে এতো দ্বিধা কেন।
আমাদের অনেকে একবেলা খেয়ে দুইবেলা না খেয়ে থাকে। কয়েকজনকে আর্থিক সাহায্যকরা হয়েছে। গতবছর আপনারা লেখালেখি করার পর প্রধানমন্ত্রী ক্রীড়া মন্ত্রীকে বলেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কে কেমন আছে খোঁজ নিতে। আমাদের সব জানানো হলো কিন্তু কিছুই করেনি।
স্বাধীন হওয়ার সে অন্যরকম আবেগ, বলা কঠিন। আমরা তখন কলকাতাতে, যখন রেডিওতে শুনছি দেশ স্বাধীন হচ্ছে, পাকিস্তান আর্মিরা সারেন্ডার করছে, তখন ইন্ডিয়ান লোকজন আমাদের সঙ্গে আনন্দ ফুর্তি করেছে, বাজি ফুটানো হয়েছে। আমরা আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমরা একটা নতুন দেশ পেয়েছি, একটা ইতিহাস গড়েছি। কিন্তু আসার পর আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে হাতের কাছে পাইনি, তখন খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল এখনও অসম্পুর্ণ কিছু রয়ে গেছে। এরপর ১০ জানুয়ারি আমরা যখন উনাকে পেলাম, তখন বুঝলাম যে দেশ পুরোপুরি স্বাধীন হয়েছে।