খেলাপির তালিকায় নাম ঠেকাতে নুতন কৌশল
২০১৪ সালে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ঋণ নেয় ড্রাগন সোয়েটার ও স্পিনিং লিমিটেড। পরিশোধ না করায় ঋণটি খেলাপি হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১১২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) খেলাপি হিসেবে নাম ওঠে প্রতিষ্ঠানটির।
সিআইবিতে নাম তালিকাভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের জানুয়ারিতে নিম্ম আদালতে ঘোষণামূলক মামলা (ডিক্লারেশন স্যুট) দায়ের করলে আদালত তা খারিজ করে দেয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে একই বছরে মার্চে হাইকোর্টে সিভিল আপিল করে ড্রাগন সোয়েটার।
হাইকোর্ট আবেদন মঞ্জুর করে নিম্ন আদালেতের আদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে। এতে সিআইবি তালিকা থেকে খেলাপি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নাম বাদ পড়ে। ঋণ রিসিডিউলের সুযোগ পায় ড্রাগন সোয়েটার। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের এর মধ্যে কয়েক দফা বেড়েছে।
সিআইবিতে নাম অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের এটি একটি নতুন কৌশল।
সিআইবিতে যাতে নাম না ওঠে সেজন্য আগে হাইকোর্টে রিট করতেন ঋণখেলাপিরা। আপিল বিভাগের আদেশে উচ্চ আদালতে এ ধরনের রিটের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তারা এ কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন।
এতে প্রথমেই তারা নাম তালিকাভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে প্রথমে নিম্ন আদালতে একটি ঘোষণামূলক মামলা করে। সেই মামলা খারিজ হয়ে যায়। তারপর তারা নিম্ম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে আপিল করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ম আদালতে আদেশ সাময়িক সময়ের স্থগিত করে দেয়। স্থগিতাদেশের মেয়াদ পরে বাড়তেই থাকে।
২০১৮ সালের শেষ দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক বনাম এম আর ট্রেডিং কোম্পানি মামলার আপিল নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের বেঞ্চ সিদ্ধান্ত দেয়, ঋণখেলাপিরা হাইকোর্টে রিট করে সিআইবির তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিতে পারবে না।
রায়ে বলা হয়, এভাবে নামের অন্তর্ভুক্তি স্থগিত করার বিষয়টি সংবিধান ও ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এম আর ট্রেডিং এর প্রায় ২০০ কোটি টাকার খেলাপী ঋণ ছিল। হাইকোর্ট এম আর ট্রেডিং-এর নাম সিআইবিতে অন্তর্ভুক্ত করার উপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।
নতুন কৌশলে যতো আপিল
আপিল বিভাগের ওই রায়ের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ঋণখেলাপিরা নিম্ম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে প্রায় ২ হাজার আপিল করে। এসব আপিলের মধ্যে ১৩৯টি বাদে বাকি সবগুলোতে ঋণখেলাপিরা হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।
যারা স্থগিতাদেশ পেয়েছেন, সিআইবিতে তাদের নাম খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্তিও স্থগিত হয়ে যায়।
এসব আপিলের সঙ্গে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ জড়িত। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে বিভিন্ন ব্যাংক এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০টি আপিল দায়ের করলেও সেগুলোর শুনানি হয়নি এখন পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সিআইবিতে নাম অন্তর্ভুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা নিতে এখন হাইকোর্টে সেভাবে রিট হচ্ছে না। নিম্ন আদালতে মামলার আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে খেলাপিরা নিজেদের পক্ষে স্থগিতাদেশ নেয়ার বিষয়টি এখন কৌশল হিসেবে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম বলেন, আগে রিট করে খেলাপিরা তাদের পক্ষে আদেশ নিতেন। এখন আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার হাইকোর্টে আসছেন তারা। এসব মামলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা উচিত।
এক আদেশ নিয়ে বছরের পর বছর
নিম্ন আদালতে ডিক্লারেশন মামলা করে তা খারিজ হওয়ার পর হাইকোর্টে আপিল করে ঋণখেলাপিরা প্রথমে ৩ থেকে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ পান। পরে এই স্থগিতাদেশ বার বার বাড়িয়ে নেয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসার অবস্থা খারাপের অজুহাত আদালতে তুলে ধরেন ঋণখেলাপিরা।
বিশিষ্ট আইনজীবীঈ ড. শাহদীন মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, হাইকোর্ট কোনো নির্দিষ্ট গ্রাউন্ডে খেলাপিদের পক্ষে আদেশ দিতেই পারে। কিন্তু দেখা যায় প্রভাবশালী আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে বছরের পর বছর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় আদালতের শুনানীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীরা অনুপস্থিত থাকেন। এতে আদালত একতরফা শুনানি নিয়ে আদেশ দেন। তাতে দেখা যায়, আদালতের আদেশ আবেদনকারি খেলাপিদের পক্ষেই যায়।
বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, 'ব্যাংকের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সতর্ক হওয়া দরকার। খেলাপিদের পক্ষে কোনো আদেশ দেয়ার আগে একটু চিন্তা করতে হবে।'
দেখা গেছে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে এমন রিট আবেদনের শুনানি বছরের পর বছর না হওয়ায় ঋণ খেলাপিরা তাদের পক্ষে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বছরের বছর বাড়িয়ে নেয়। তাই এসব আপিল বা রিট দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার বলে মনে করেন খায়রুল হক।
এসব আপিল বা রিট দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্র্টের বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার তাগিদ দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।
ঝুলে আছে বিশেষ বেঞ্চ গঠনের উদ্যোগ
উচ্চ আদালতে খেলাপিদের রিট ও আপিল দ্রুত নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ গঠনের অনুরোধ জানিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিত তিন বার চিঠি দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রীকে। কিন্তু এখনো তা হয়নি
কেন হয়নি জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অর্থমন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির সাথে আলাপ করেছে। তবে এখনো বিশেষ বেঞ্চ গঠন হয়নি।'
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আবারো আলোচনা করে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
তবে অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, খেলাপি ঋণ সম্পর্কিত ঝুলে থাকা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পিত্তির জন্য আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির সাথে আলোচনা করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মামলার কারণে বলা চলে ণ আদায় প্রক্রিয়া একরকম বন্ধ হয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে, যারা আগে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন, এখন তারাও খেলাপিদের কৌশলে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলা বা উচ্চ আদালতে রিট বা আপিল নিষ্পত্তির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে জোরালো উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন ড. ফরাসউদ্দিন।