বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর: অস্বাভাবিক বাড়তি ব্যয়ের কারণে দুবার প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত
চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের একটি জোনকে গ্রিন সিটিতে রূপান্তর করতে নেওয়া নতুন একটি প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। অথচ একই শিল্পনগরে চলমান অন্য একটি প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি সড়ক নির্মাণে বরাদ্দ সাড়ে ছয় কোটি টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) চলমান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। গ্রিন সিটির প্রকল্প প্রস্তাবটিও বেজারই তৈরি করা। নতুন প্রকল্পে সব মিলিয়ে ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য যে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, তা চলমান প্রকল্পের তুলনায় ২১৯ কোটি টাকা বেশি।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে এক কোটি ঘনমিটার ভূমি উন্নয়নে বেজা চেয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা, যা চলমান প্রকল্পে একই কাজে বরাদ্দের চেয়ে ৮৭ কোটি টাকা বেশি।
বিভিন্ন খাতে এ রকম আরও অনেক বাড়তি ব্যয়ের প্রস্তাব, বরাদ্দের বিভাজন না থাকা, পুরনো প্রকল্প থেকে কপি-পেস্ট করে নতুন প্রস্তাব তৈরি করার কারণে গত জুন মাসে বেজার গ্রিন সিটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবটি (ডিপিপি) ফেরত পাঠায় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)।
এরপর সংশোধিত যে ডিপিপি জমা দেয় বেজা, সেটাও একই কারণে পিইসি থেকে ফেরত আসে।
পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে ব্যয় না কমিয়ে সংশোধিত প্রস্তাবে উল্টো কয়েকটি খাতে বাড়তি ব্যয় যুক্ত করে বেজা। সংশোধিত প্রস্তাবে গাড়ি কেনা, জ্বালানি, মসজিদ নির্মাণসহ বেশ কিছু খাতে 'অস্বাভাবিক হারে ব্যয় বৃদ্ধির' প্রস্তাব করা হয়েছে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বেজার দায়িত্ব প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করা। অনুমোদনের কাজ পরিকল্পনা কমিশনের।
তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনে ডিপিপি পাঠানোর পর দুবার পিইসি সভা হয়েছে। দ্বিতীয় সভার সুপারিশের ভিত্তিতে এখন প্রস্তাব পুনর্গঠনের কাজ চলছে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।
এদিকে, প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ৪ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকার প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে ৪৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক, স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। বাকি অর্থের যোগান দেবে সরকার।
চট্টগ্রামের মীরসরাই ও সীতাকুণ্ড এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর নামে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, তার চারটি জোনের মধ্যে বিএসএমএসএন-২ জোনকে গ্রিন সিটিতে রূপান্তর করতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
গ্রিন সিটির জন্য বরাদ্দ জমির পরিমাণ প্রায় ১৫০০ একর। শিল্পনগরের বাকি তিনটি জোনের প্রায় ২ হাজার একর জমি ইতোমধ্যেই শিল্পকারখানা স্থাপনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে ভূমি উন্নয়ন, ৩০ কিলোমিটারের চার-লেন সড়ক, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ভবন, ডিস্যালিনেশন প্লান্ট, স্টিম নেটওয়ার্ক, সলিড ওয়েস্ট প্ল্যান্ট, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, খাল খনন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক এবং সোলার প্যানেল স্থাপনের কথা।
জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনুমোদনে ধীরগতির কারণে বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
খরচের বাড়বাড়ন্ত
প্রথম ডিপিপিতে যানবাহন ভাড়ার জন্য সাত কোটি, যানবাহন কেনায় পাঁচ কোটিসহ মোট ১২.৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করেছিল বেজা। সংশোধিত দ্বিতীয় প্রস্তাবে শুধু ২৪টি গাড়ি কেনার জন্যই ২৭.৬৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
সংশোধিত প্রস্তাবের ওপর অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রকল্পে আটজন চালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই ৮টির বেশি গাড়ি কেনার সুযোগ নেই।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, 'আমাদের মনে হয়েছে, গাড়ি কয়েকটা বেশি কেনা দরকার। তাদের কাছে মনে হয়েছে, কম গাড়ি দরকার। এ রকম হতেই পারে।'
প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহৃত যানবাহনের পেট্রোল ও লুব্রিকেন্ট কিনতে সংশোধিত প্রস্তাবে প্রায় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। প্রথম ডিপিপিতে এ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল ২ কোটি টাকা।
সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে বিদেশে ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন, ট্রেনিং ও স্টাডি টুর খাতে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে বেজা, যা প্রথম প্রস্তাবের চেয়ে আট গুণ বেশি।
প্রথম প্রস্তাবে ভেন্যু রেন্টাল বাবদ ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হলেও পরের প্রস্তাবে তা আট গুণ বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকার বেশি ধরা হয়েছে।
বেজার প্রথম প্রস্তাবে গ্রিন সিটিতে মসজিদ নির্মাণে আট কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধিত প্রস্তাবে তা বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকা করা হয়েছে। পিইসি সভায় এতে আপত্তি জানিয়ে মসজিদে কী পরিমাণ মানুষের সমাগম হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের রেট সিডিউল মেনে ব্যয় প্রাক্কলন করতে বেজাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে সিইটিপি, ডিজেলিনেশন প্ল্যান্ট, স্টিম নেটওয়ার্ক, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, রুফটপ অ্যান্ড ফ্লোটিং সোলার প্ল্যান্ট-সহ ছয় ধরনের অবকাঠামো পিপিপিতে নির্মাণ করা হবে। এসব খাতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন। তবে তারা কোন খাতে কত ব্যয় করবেন, সে বিষয়ে প্রকল্প প্রস্তাবে কিছু উল্লেখ নেই।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে রুফটপ অ্যান্ড ফ্লোটিং সোলার প্ল্যান্ট খাতে সরকারের তহবিল থেকে ৫৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রকল্প যাচাই কমিটির সভায় এ ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় দেশে বিদ্যুতের বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতার সময়ে এ ধরনের ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
এদিকে, বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বমানের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার শর্তে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক চায়, প্রকল্পের কাজ যেন বিশ্বমানের হয়। টেকসই প্রকল্পের জন্যই সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের উদ্বেগ
গত অর্থবছরের শেষদিকে গ্রিন সিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্প অনুমোদনে ধীরগতির কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
সম্প্রতি তৈরি করা বিশ্বব্যাংকের 'ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যাটাস অ্যান্ড রেজাল্টস রিপোর্টে' বলা হয়, ২০২০ সালের ১৯ জুন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ'স বোর্ড অব ডিরেক্টরস এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। তবু এটি এখনো একনেকের অনুমোদন পায়নি।
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সূত্র জানিয়েছে, এই ঋণ সহজ শর্তের নমনীয় ঋণ নয়। ঋণের সুদের হার ৩.৮৭ শতাংশ। ইআরডি'র অতিরিক্ত সচিব বিশ্বব্যাংক উইং প্রধান আবদুল বাক বলেন, প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেলেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হবে। চার বছরের রেয়াতকালসহ ৩৪ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশাবাদী, চলতি মাসেই প্রকল্প প্রস্তাব একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে।