প্রত্যন্ত গ্রামের বাঁশ-বেতের ফার্নিচার বিক্রি হচ্ছে সারাদেশে
বিভিন্ন নামাদামি ব্র্যান্ডের দৌরাত্ম্যে স্থানীয় ভাবে যেসব ফার্নিচারের দোকান ছিল তা দিন দিন ব্যবসা হারাচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নিত্য নতুন ডিজাইন আর চকচকে বাহারি আসবাবের প্রতি মানুষ ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে।
তবে এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদাহরণ হতে পারেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার বড়চেগ গ্রামের আমির হোসেন সিরাজ। বুদ্ধিমত্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতায় আসবাবের প্রতিযোগিতায় স্বতন্ত্র ভাবে এখনও টিকে আছেন। তিনি নিজ গ্রামে বাঁশ বেত দিয়ে গড়ে তুলেছেন আধুনিক ফার্নিচারের কারখানা। বড় বড় স্থানীয় ফার্নিচারের দোকান যখন ব্র্যান্ডের ফার্নিচারের কাছে হার মানছে, তখন সুদূর এই গ্রাম থেকেই তিনি সারা দেশে বিক্রি করছেন তার তৈরি বাঁশ-বেতের ফার্নিচার।
২০০৩ সালে মাত্র ২০ হাজার টাকা পুঁজি ও ১ জন শ্রমিক দিয়ে শুরু হয়েছিল তার ফার্নিচার ব্যবসা। এখন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৫ জন শ্রমিক। তার প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন 'সিরাজ কুটির শিল্প'। তার এই কুটির শিল্প সারা দেশে যেমন যাচ্ছে তেমনি সারা দেশে তার পরিচিতিও এনে দিয়েছে। সেই সাথে বেড়েছে একার পরিচিতি। করোনার কারণে অবশ্য গত বছর থেকেই ব্যবসা একটু খারাপ যাচ্ছে, তবে অর্ডার আছে এখনও। এমনিতে স্বাভাবিক সময়ে এত অগ্রিম অর্ডার থাকে যে দিন রাত শ্রমিকদের কাজ করতে হয়। বছরে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লক্ষ টাকার বাঁশ বেতের ফার্নিচার বিক্রি করেন তিনি।
নিজের উদ্যোগ এবং সাফল্য নিয়ে আমির হোসেন সিরাজ কথা বলেছেন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে। তিনি জানান, এক সময় মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করলেও বর্তমানে তার কর্মচারিদের বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খরচ প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
তিনি বলেন, "আমি আগে নার্সারির ব্যবসা করতাম। কিন্তু ১৯৯৮ সালে আমার ধারণা হলো নিজের ঘরের জন্য বাঁশ বেত দিয়ে কিছু ফার্নিচার তৈরি করব। যখন তৈরি করলাম অনেকেই নিতে চাইলেন, আস্তে আস্তে বাড়িতেই কাজ শুরু করলাম এবং সামান্য লাভে বিক্রি করতাম। পরে চিন্তা করে দেখলাম বাণিজ্যিকভাবেই বিক্রি শুরু করি। তাই ২০০৩ সালে বাড়ির পাশে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ২০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে একজন কর্মচারী সাথে রেখে কাজ শুরু করলাম । এখন প্রতি মাসে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার বিক্রি হয়। দেশে বিভিন্ন প্রান্তে কুরিয়ারের মাধ্যমে গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যায়। অনেকেই আছেন আমার থেকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিক্রি করেন। কেউ কেউ আবার বিদেশেও পাঠান। বিদেশে ভালো চাহিদা আছে। একজন কাতার প্রবাসী আমার থেকে প্রচুর পণ্য নেন, সেগুলো তিনি কাতারে বিক্রি করেন।"
প্রায় সব ধরনের জিনিসই এখানে তৈরি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, বাঁশের তৈরি আধুনিক ডিজাইনের খাট, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, ফুলের টব, সোফাসেট, রিডিং টেবিল, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, টেবিল ল্যাম্প, পেন স্ট্যান্ড, হোটেল-রেস্টুরেন্ট-অফিসের ফার্নিচারসহ বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্রের চাহিদা বেশি। এগুলো তৈরি করার জন্য উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি এবং তার কর্মচারীরা বাঁশ-বেত সংগ্রহ করেন। বাঁশ সংগ্রহ করাই এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান তিনি।
আমির হোসেন সিরাজ বলেন, তিনি কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজ থেকে কাজ শুরু করেছিলেন, আজও কারও সাহায্য ছাড়াই চলছেন। বেশ কয়েকবার কর্মসংস্থান ব্যাংকে গিয়েছেন, কিন্তু ফান্ড না থাকায় কোনো সাহায্য পাননি।
"ভিন্ন ধরনের এসব ফার্নিচার তৈরি করতে যথেষ্ট পুঁজিরও প্রয়োজন রয়েছে। বাঁশ, বেত আর সঙ্গে কিছু ওষুধও কিনতে হয়। তাছাড়া ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। স্বল্প পুঁজি নিয়ে শিল্প টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন,"
"মহামারীর কারণে দীর্ঘ দিন কুরিয়ার বন্ধ ছিল, ফলে পণ্য পাঠাতে পারিনি। তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাঁশও সংগ্রহ করতে পারিনি। কিন্তু কর্মচারীদের বেতন ঠিকই দিতে হয়েছে। করোনার সময়ে যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছি তা এখনো পুষিয়ে উঠতে পারিনি। সরকারী সাহায্য পেলে ভালো হতো। কিন্তু চেষ্টা করেও পাইনি। যদি সরকারের থেকে সাহায্য পাই তাহলে বড় আকারে নতুন করে ফ্যাক্টরি সাজাতে পারব। সঠিক নির্দেশনা পেলে সারাদেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করতে পারব বাঁশ-বেতের পণ্য।" বলেন তিনি।
এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, তার কাজকে এগিয়ে নিতে যতো ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন তা করতে ইচ্ছুক তারা।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশেকুল হক জানান, "তিনি কখনো সহযোগিতার জন্য আবেদন করেননি। হয়তো তিনি জানেন না কিভাবে আবেদন করতে হয়। আমরা নিজ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করে সরকারের সুযোগ সুবিধাগুলো তাকে পাইয়ে দেব এবং কীভাবে এ শিল্পের আরও বিস্তার ঘটানো যায় তা নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করবে।"