বড়রা লাভে ফিরছে, ছোটরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে
মহামারি বা অতিমারি বড়-ছোটর পার্থক্য মানে না। আক্রান্ত করে সবাইকেই। তবে আক্রান্তের পর টিকে থাকা বা আবার ঘুরে দাঁড়ানোটা বড়-ছোটর জন্য সমান নয়। বড়দের জন্য সেটা যতোটা সহজ, ছোটদের জন্য ততোটাই কঠিন।
একজন সম্পদশালী যতো দ্রুত মহামারির বিপর্যয়কে সামাল দিতে পারেন, সীমিত আয়ের একজন মধ্যবিত্ত বা বিত্তের তলানীতে থাকা মানুষের জন্য সেটা খুবই কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ একটি বিষয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যেও পরিস্থিতিটা কম-বেশি একই রকম। মহামারিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার সক্ষমতা থাকলেও ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো হয় বন্ধ হয়ে যায় অথবা টিকে থাকার প্রলম্বিত সংগ্রামে বিপর্যস্ত হতে হয়।
কোভিড মহামারিতে বাংলাদেশেও এই চিত্র দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে প্রবৃদ্ধিতে ফিরতে শুরু করেছে বিভিন্ন খাতে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে এখনো অনিশ্চিত ভবিষ্যত।
বড় পুঁজি, ব্র্যান্ডের পরিচিতি, মার্কেটিংয়ে নিজস্ব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আর সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা নিয়ে ব্যবসায় আবারো লাভে ফিরতে শুরু করেছে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো। বিপরীতে ক্রমশ আরো ছোট হচ্ছে মাঝারি ও ছোট পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলো।
সদ্যসমাপ্ত বছরে (২০২০) দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোভিডের প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে ওষুধ, আবাসন, রড, সিমেন্ট, প্লাস্টিকসহ বড় বড় খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো লাভে ফিরেছে।
প্রণোদনার সুবিধা কাজে লাগিয়ে পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহারের পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগও করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বিপরীতে বিক্রি কমে যাওয়ার পাশাপাশি চরম মূলধন সংকটে ভুগছে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারের দেয়া প্রণোদনা সুবিধাও পায়নি তারা। মূলধন হারিয়ে অনেকে আবার ব্যবসাও গুটিয়ে নিয়েছে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বলছেন, ছোটদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে একটা বড় কারণ মানুষের ব্র্যান্ড নির্ভরতা। বড়দের নিজস্ব শক্তিশালী মার্কেটিং কাঠামো ও নেটওয়ার্ক থাকায় তারা এগিয়ে গেছে। তারা নিজস্ব শো-রুম কিংবা ডিলারদের মাধ্যমে ব্যবসা করেছে। ই-কমার্স থেকে পণ্য কিনতেও ব্র্যান্ড খুঁজেছেন ক্রেতারা।
বিপরীতে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন কোনো মার্কেটিং নেটওয়ার্ক নেই, তাদের পণ্যের ব্র্যান্ড ভ্যালু নেই, ব্র্যান্ড ভ্যালুর তৈরির মতো মূলধনও নেই। মহামারির প্রতিক্রিয়ায় বাজার হারিয়ে তাদের অনেককেই হয়তো ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।
মাঝারি-ছোট এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা দেয়া যায় কীনা তা সরকারের ভাবা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বড়রা বড় হচ্ছে, ছোটরা আরো ছোট
প্রায় দুই যুগ ধরে রাজধানীর মোস্তফা লেনে ছোট একটি কারখানায় জগ, মগ, বক্সসহ প্রায় ২০ ধরনের প্লাস্টিকের পণ্য উৎপাদন করছে বিউটি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিবছর গড়ে ১০-১২ কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে আসছিলো প্রতিষ্ঠানটি।
দেশে কোভিড সংক্রমণ শুরুর পর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ হয়ে যায় বিউটি প্লাস্টিকের কারখানাও। তিন মাস বন্ধ রেখে জুনের শেষ দিকে কারখানা চালু করলেও উৎপাদন সক্ষমতার ২০-২৫ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
জুলাই মাসে কারখানার প্রতিষ্ঠাতা আসগর আলীসহ কয়েকজন কর্মকর্তা কোভিডে আক্রান্ত হলে উৎপাদন আরো সীমিত হয়ে পড়ে। এখন সক্ষমতার মাত্র ১০-১৫ শতাংশ পণ্য উৎপাদন হয় কারখানাটিতে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রি এক কোটি টাকাও হয়নি।
আসগর আলী মারা যান। বিউটি প্লাস্টিকের হাল ধরেছেন তার ছেলে আকবর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'নগদ অর্থ হাতে যা ছিল, তা দিয়ে কয়েক মাস কর্মীদের বেতন দিয়েছি। বাজারে চাহিদা না থাকায় উৎপাদন কম। কোনোমতে টিকে আছি। 'বাবা মারা যাওয়ায় কাগজপত্রের জটিলতায় প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণসুবিধাও পাইনি।'
প্রণোদনা সুবিধা পেয়েও সদ্যসমাপ্ত বছরে বিক্রি অন্তত ৪ গুণ কমেছে প্লাস্টিক ও একসেসরিজ খাতের মধ্যম সারির প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক এক্সেসরিজের। স্টক এক্সচেঞ্জে দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছরের শেষ দুই প্রান্তিকে ৫ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আগের বছর একই সময়ে বিক্রি ছিল ২০ কোটি টাকারও বেশি।
বিউটি প্লাস্টিক ও অলিম্পিক এক্সেসরিজের মতোই ব্যবসায় নিভু নিভু অবস্থা এ খাতের প্রায় চার হাজার কারখানার। তবে এর মধ্যেও ব্যবসা আরো বড় হয়েছে প্লাস্টিক খাতের মার্কেট লিডারদের।
যেমন-আরএফএল। বড় কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রোডাকশন চালু রেখে নিজস্ব শো-রুম ও ডিলারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি অব্যাহত থাকায় কোভিডেও বিক্রি বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আরএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আর এন পাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, সদ্য সমাপ্ত বছরে (২০২০) পণ্য বিক্রিতে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে তাদের। পণ্য বৈচিত্রকরণ এবং অ্যাসেন্সিয়াল প্রোডাক্ট উৎপাদন করে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
আরএফএলের মতোই গত বছর প্রবৃদ্ধিতে ছিল বেঙ্গল, তাজ, সনি, মদিনা প্লাস্টিকসহ বড় বড় কোম্পানিগুলো। কিন্তু কোভিডে নিজেদের ছোট বাজারও ধরে রাখতে পারে নি ছোট ছোট কোম্পানিগুলো। মানুষ পরিচিত ব্র্যান্ডের পণ্যই কিনেছে।
গত ছয় মাসে আবাসন খাতে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি কালো টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। তবে এই বিনিয়োগ পেয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের মাত্র ৩০-৩৫টি প্রতিষ্ঠান। বাকিদের অনেকেই এখনো অস্তিত্ব সংকটে আছে। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে।
আবাসন ব্যবসার শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, কনকর্ড লিমিটেডের সদ্যসমাপ্ত বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশেরও বেশি। সব ফ্ল্যাটই বিক্রি হয়ে গেছে তাদের।
কনকর্ড রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মার্চ থেকে মে- এই তিন মাস বাদ দিলে বছর জুড়ে আমাদের ব্যবসা মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। শেষ দু মাসে এভারেজের চেয়ে ভালো ব্যবসা হয়েছে। চলতি বছরে আমাদের বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্ট আসছে। আশা করি, এই বছর আমাদের ব্যবসা আরো ভালো হবে।'
আবাসন খাতের এই চিত্রের উল্টোপিঠে আছে ঐশি প্রপার্টিজের মতো প্রতিষ্ঠানও। গত বছরের শুরুর দিকে রামপুরায় নেয়া নতুন একটি প্রজেক্ট নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রজেক্টে যেসব ক্রেতা বুকিং দিয়েছিলেন, তাদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা তোলা যাচ্ছে না। পরিচিতি না থাকায় বাকি ফ্ল্যাটগুলোর বুকিংও হচ্ছে না। কোভিডের কারণে সাইটে ক্রেতাদেরও আনা যাচ্ছে না।
ঐশি প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী বলেন, 'রামপুরার প্রজেক্টের অবস্থা ভালো না। মগবাজার ও মিরপুরের দুটি প্রজেক্টেরও ফ্ল্যাটগুলো পড়ে আছে। বিক্রি করা যাচ্ছে না। কয়েক মাস অফিস চালিয়ে মূলধন শেষ। নতুন প্রজেক্ট নেয়া দুরের কথা, টিকে থাকবো কীভাবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।'
কমবেশি একই চিত্র ওষুধ, সিমেন্ট, ইস্পাত, ইলেকট্রনিক্সসহ সব খাতেই। বড়রা ভালো করলেও পিছিয়ে পড়ছে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো। সিমেন্ট খাতের শীর্ষ কোম্পানি শাহ সিমেন্ট, বসুন্ধরা, লাফার্জ হোলসিম, প্রিমিয়ার, ক্রাউনসহ বড়রা কোভিডের বছরেও প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। পিছিয়ে পড়েছে এ খাতের ৫০টির বেশি ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান।
ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রিতে করোনার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি পেয়েছে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। তবে আরেক দেশি প্রতিষ্ঠান মিনিস্টারকে ভুগতে হয়েছে আর্থিক সংকটে।
ওষুধ শিল্পেও ছোট কোম্পানি বিপদে
কোভিডের কারণে ব্যাপকভাবে চাহিদা বেড়েছে ওষুধের। সংক্রমণের শুরুর দিকে ৬৬ দিনের লকডাউন উঠে যাওয়ার পরবর্তী সাত মাসে দেশে ওষুধ বিক্রি বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। তবে এই বৃদ্ধি শীর্ষ ১০-১৫টি কোম্পানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। গেল বছর মোট বিক্রিত ওষুধের ৭০ শতাংশই ছিল শীর্ষ ১০ কোম্পানির। যদিও দেশে বর্তমানে ১৭৪টি কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএর তথ্য অনুযায়ী, বিক্রি প্রবৃদ্ধিতে গত বছর সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে বেক্সিমকোর ওষুধ বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি ২১.৮৪ শতাংশ। হেলকেয়ারের প্রবৃদ্ধি ২১.৪, স্কয়ারের ১৭ শতাংশ। শীর্ষ ১০ কোম্পানির অধিকাংশের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে। অথচ এ সময়ে ওষুধ শিল্পের সার্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের কম।
শীর্ষ কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধির বিপরীতে সংকটে আছে ছোট কোম্পানিগুলো। এমন একটি কোম্পানি হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস। আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির ওষুধ বিক্রি অন্তত ১০ শতাংশ কমেছে।
হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির সেক্রেটারি মো. শফিউজ্জামান বলেন, 'দীর্ঘদিন ডাক্তারদের চেম্বারে না বসা ও বিক্রয় প্রতিনিধিরা মুভমেন্ট করতে না পারায় ছোট ও নতুন কোম্পানিগুলো বাজার ধরে রাখতে পারেনি। মানুষ দোকানে এসে মুলত পরিচিত কোম্পানির ওষুধই কিনেছেন।
সরকারি প্রণোদনা প্রাপ্তিতেও এগিয়ে বড়রা
কোভিডের ক্ষতি কাটাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মূলধন যোগান দিতে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা সুবিধা দেয় সরকার। এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণাদনার মধ্যে বড় শিল্পের জন্য দেয়া ৩৩,০০০ কোটি টাকার মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৩ শতাংশ হাতে পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রপ্তানির জন্য দেয়া ৭০০০ কোটি টাকার শতভাগ বুঝে নিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
অথচ কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দেয়া ২০,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনার মাত্র ৫৪ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। অথচ এই খাতেই কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি।
প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণপ্রাপ্তিতে আরোপিত শর্ত এবং সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতার অভাব ও অনাগ্রহের কারণে ঋণ না পেয়ে এই খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে টিকে থাকার সংগ্রামে আছেন।
এমনই একজন ভোলার পারভেজ রহমান। দীর্ঘদিন ধরে ৫০ জন শ্রমিক নিয়ে গাজিপুরে ছোট্ট একটি টি-শার্ট তৈরির কারখানা চালিয়ে আসছিলেন। কোভিড সংক্রমণ শুরুর পর কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মূলধন সংকটে তা আর চালু করতে পারেননি।
প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ পান নি তিনি। পারভেজ রহমান বলেন, 'কারখানায় চার মাসের ভাড়া ও শ্রমিকদের সংসার চালানোর টাকা দিয়ে আমার মূলধন শেষ। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। মূলধনও নেই। আমি এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।'