সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে চলছে চসিক নির্বাচন, বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ
করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস স্থগিত থাকার পর বুধবার অবশেষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন।
সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নগরীর প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ মানুষ ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দিয়ে তাদের নগর পিতা নির্বাচন করতে চলেছেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী (নৌকা প্রতীক) ও বিএনপির শাহাদাত হোসেন (ধানের শীষ) সহ মোট সাত মেয়র প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্ধিতা রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে।
অন্য পাঁচ মেয়র প্রার্থীরা হলেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা), এনপিপির আবদুল মঞ্জুর (আম), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এমএ মতিন (মোমবাতি), ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার) এবং স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী খোকন চৌধুরী ( হাতি)।
এছাড়া ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং ১৪টি সংরক্ষিত আসনে ৫৭ জন মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর, প্রচারণায় হামলাসহ বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে।
সাময়িকভাবে ভোট গ্রহন স্থগিত
সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে পাথরঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই আওয়ামীলীগ কাউন্সিলর ও বিএনপি কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ভাংচুর করা হয়েছে। সাময়িকভাবে ভোট গ্রহন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
জে এম সেন স্কুল কেন্দ্রেও ভোট গ্রহন সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। এখানেও সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী সালাউদ্দিন ও আওয়ামীলীগ এর বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর হাসান মুরাদ বিপ্লব এর সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষ ঘটে।
দুপুর ১ টার দিকে ৩৪ নং ওয়ার্ডের দুই কেন্দ্রেও আওয়ামীলীগ ও বিএনপি কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের পর নির্বাচন স্থগিত করেন রির্টানিং কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান। তিনি টিবিএসকে বলেন, সংঘর্ষের ঘটনা , কেন্দ্র দখল এবং ইভিএম ভাংচুর এর পর এ দুই কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দু'জন নিহত, আহত অন্তত ৩০
সকালে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে পৃথক সংঘর্ষে দু'জন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়েছেন।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে নগরের পাহাড়তলীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে আলাউদ্দিন নামে এক কর্মী নিহত হয়েছেন।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতায় কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (সিএমসিএইচ) পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার।
সংঘর্ষের পর বঙ্গবন্ধু বাংলা স্কুল কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ প্রায় এক ঘন্টা স্থগিত ছিল বলে জানান সে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার।
এর আগে সকালে নগরীর ১২নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর দ্বন্দ্বে আপন ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন নিজাম উদ্দিন মুন্না নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী।
স্থানীয়রা জানায়, নিহত যুবক মুন্না ১২ নম্বর ওয়ার্ডের (সরাইপাড়া) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী সাবের আহমদের কর্মী ছিলেন। তার ভাই হত্যাকারী সালাউদ্দিন কামরুল একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিনের কর্মী। নির্বাচন নিয়ে দুইভাইয়ের মধ্যে কিছুদিন ধরে বিরোধ চলছিল। আজ সকালে ভোট শুরুর আগেই দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলে মুন্নাকে ছুরিকাঘাত এবং গলাকেটে হত্যা করে পালিয়ে যায় কামরুল। পুলিশ মুন্নার লাশ উদ্ধার করেছে।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে চকবাজার এলাকার কাতালঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দেলাওয়ার হোসেনের পোলিং এজেন্টদের মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আহত
নগরীর কোতয়ালী থানাধীন ২৬ নং ওয়ার্ডের চর পাথরঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মো মাইন উদ্দিন (২৮) আহত হয়েছেন। দুুপুর আড়াইটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
কেন্দ্রে দুর্বৃত্ত্বের হামলায় তিনি আহত হন বলে জানায় মেডিকেল কলেজে দায়িত্বরত পুলিশ। তিনি চমেকের ২৬ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসধীন।
বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ
বিএনপির নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন চসিক নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন।
বুধবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় পশ্চিম বাকলিয়া বিএড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ''আমার বাড়ির লোকজনকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আড়াই ঘণ্টায় এ কেন্দ্রে ৩৩৬ ভোটের মধ্যে মাত্র ৯টা ভোট পড়েছে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না আসার জন্য সব ধরনের কৌশল তারা নিয়েছে'।
ডা. শাহাদাত বলেন, আমাদের দলীয় এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। সকাল ৯টার মধ্যে আমাদের ১৫ জন কর্মী আহত, গুলিবিদ্ধ ও ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছে।
দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে ১৪, ১৫, ২১ নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী মনোয়ার বেগম মনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
দুপুর ১টায় পাথরঘাটা ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ইসমাইল হোসেন বালিকে পুলিশ আটক করেছে। আওয়ামী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সাথে বিএনপির এই কাউন্সিলর প্রার্থীর সংঘর্ষের পর তাকে পুলিশ আটক করে।
বেলা ২ টার দিকে চসিক নির্বাচনের অভিযোগ নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। ঠিক একই সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানকা গাড়িতে করে অন্যত্র চলে যেতে দেখা যায়।
'প্রহসনের নির্বাচন'
দক্ষিন কাট্টলি ওয়ার্ডের আওয়ামী লিগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর মোরশেদ আক্তার চৌধুরী নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন আখ্যা দিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন- 'নির্বাচন কমিশন একটি প্রহসনমূলক নাটক মঞ্চস্থ করেছে'।
সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লিগের এই কাউন্সিলর বলেন, ' ভোট কেন্দ্রে গিয়ে লাভ নেই। গোপন কক্ষে অন্যজন আপনার হয়ে সুইচ টিপে দিচ্ছে। আপনি আপনার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন না'।
তিনি আরও বলেন, এই অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি বেলা ১২ টায় এই ঘোষনা দেন।
লাইভে তিনি আরও জানান যে, নির্বাচন কমিশনার তার কাছে ৫০ লক্ষ টাকাও দাবি করেন; রির্টানিং কর্মকর্তা হাসানুজ্জমান একটি ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচন করছে।
প্রশাসন তাদের কোনরূপ সহযোগিতা করে নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
ভোটের নিরাপত্তায় গত সোমবার থেকেই মাঠে নেমেছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, নগর পুলিশের ৭ হাজার ২৫৯ সদস্যসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর প্রায় ৯ হাজার সদস্য আজ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছে। অতীত সহিংসতার ইতিহাস, প্রার্থীদের অবস্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার চসিক নির্বাচনে ৭২৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪১৭টিকে (প্রায় ৫৮ শতাংশ) 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে বিবেচনা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
নির্বাচন কমিশন সুত্রে জানা গেছে, চসিক নির্বাচনের ৪১ ওয়ার্ডে ৭৩৫টি ভোট কেন্দ্রে থাকবে ৪ হাজার ৮৮৬টি বুথ। এসব কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন ৭৭৫ প্রিসাইডিং অফিসার, ৪ হাজার ৮৮৬ সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ৯ হাজার ৭৭২ পোলিং অফিসার।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারিশ ইউএনবিকে বলেন, চসিক নির্বাচনে নগর ও হাটহাজারী উপজেলা মিলিয়ে ৭৩৫টি কেন্দ্র আছে। কেন্দ্রগুলোর অতীতের সহিংসতার ইতিহাস, প্রার্থীদের অবস্থান এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে প্রায় ৮ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েনসহ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। ২৫ প্লাটুন বিজিবি মোবাইল টিমে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে সব কেন্দ্রে কাজ করবে।
তিনি জানান, এসব কেন্দ্রে অস্ত্রধারীসহ ছয়জন করে পুলিশ সদস্য ও ১২ জন করে আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে। আর এর বাইরে সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রধারীসহ চার জন পুলিশ ও ১২ জন করে আনসার সদস্য থাকবে।
এছাড়া, কেন্দ্রের বাইরে টহল পুলিশ, সাদা পোশাকের পুলিশ ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা তৎপর থাকবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকবে নগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, কাউন্টার টেররিজম ও সোয়াট।
এবারের চসিক নির্বাচনে ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকছে না। তাই এদিন বন্দরনগরীতে যানবাহন চলাচল ও অফিস-আদালত যথারীতি চলবে বলে আগেই জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
তবে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে কার, মাইক্রোবাস, ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ বেশ কয়েক ধরনের যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বলে ইউএনবিকে জানিয়েছেন সিএমপির জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ মো. আবদুর রউফ।
তিনি বলেন, সিএমপির আওতাধীন এলাকায় ভোটগ্রহণের জন্য মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত কার, মাইক্রোবাস, জিপ, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা, ইজিবাইক, ট্রাক, পিকআপ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে গত সোমবার মধ্যরাত থেকে জারি হওয়া মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত।'