প্রকল্পে অনিয়ম প্রতিরোধে স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহারের উদ্যোগ
গাজীপুর সাফারি পার্কের অভ্যন্তরে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭.৭ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর। আপাত দৃষ্টিতে পুরো পরিকল্পনা সাধারণ এক প্রকল্প বলেই মনে হবে। এমনকি কাজ শুরুর জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন এবং অর্থ বরাদ্দও পেয়ে যায়।
তবে প্রকল্পটি নিয়ে সরকারের বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ এবং মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ২০১৯ সালে আইএমইডি প্রকল্পটি পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রস্তাবিত ৭.৭ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে দুই কিলোমিটার রাস্তার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অন্য একটি প্রকল্পের অধীনে ঐ দুই কিলোমিটার রাস্তা নির্মিত হয়। অর্থাৎ, বন অধিদপ্তর ৭.৭ কিমির রাস্তার অর্থায়নে প্রকৃতপক্ষে ৫.৭ কি.মি. রাস্তা নির্মাণ করত।
এধরনের প্রশ্নবিদ্ধ কাজের অনেক উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবে। দেশে এমন সব জায়গায় ব্রিজ নির্মাণ করা হয় যেখানে কোনো রাস্তার অস্তিত্বই নেই। আবার পুরোনো কাঠামোর উপর নতুন স্থাপনা নির্মাণের উদাহরণও অনেক।
এই সব অনিয়ম এবং দুর্নীতি বন্ধের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা কমিশন একটি ভৌগোলিক মানচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা (জিআইএস) এবং রিমোট সেন্সিং আপ্লিকেশন (আরএসএ) প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত হবে এই ম্যাপ।
নতুন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো নির্মাণ প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটছে কি না তা পরিকল্পনাবিদরা সহজেই জানতে পারবে। স্থাপনা পুনর্নিমাণের মাধ্যমে যেসব দুর্নীতি করা হয় তা এখন সহজেই বন্ধ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, পরিকল্পনা কমিশনের মতে, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে যেসব অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্প হয়ে থাকে সেগুলোও থামাতে সক্ষম হবে নতুন এই উদ্যোগ।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, রাজনীতিবিদদের ইচ্ছানুসারে প্রায়ই তাদের বাড়িঘরের কাছাকাছি জায়গায় রাস্তা, ব্রিজ এ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষদের জন্য সেসব প্রকল্প তেমন একটা কাজে দেয় না।
জন তহবিল ব্যবহার করে এধরনের স্থাপনা নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে জিআইএস এবং আরএসএ প্রযুক্তি ভূমিকা রাখবে বলে জানান তারা।
উদাহরণ হিসেবে কর্মকর্তারা সুনামগঞ্জের মঈন-আলীগঞ্জ সড়কে চেলা খালের উপর নির্মিত ৬৬ মিটার ব্রিজের কথা বলেন। পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৩.৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়।
এক বছর আগে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়ির পাশে ব্রিজটি নির্মিত হয়। তবে সেতুটি যদি আধা কিলোমিটার দূরে আলীগঞ্জ বাজারের খালের উপর নির্মিত হতো তাহলে স্থানীয়রা উপকৃত হতো।
পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ সাজেদুল কাইয়ুম দুলাল বলেন, পরিকল্পনা কমিশন কর্মকর্তাদের পক্ষে প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের আগে দেশব্যাপী মাঠ পরিদর্শনে যাওয়া সম্ভব না।
"স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করা গেলে জনসাধারণ উপকৃত হবে। প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে জিআইএস ব্যবস্থা যুক্ত করা গেলে, রাজনৈতিক প্রভাবাধীন এবং পুনরাবৃত্তির কাজগুলো বন্ধ করা যাবে," বলেন তিনি।
ইতোমধ্যে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সফটওয়্যার নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছে। প্রকল্পটি শেষ হতে দেড় বছর সময় লাগবে। সফটওয়্যারটি চলে আসলে সকল উন্নয়ন পরিকল্পন্য জিআইএস এবং আরএসএ প্রযুক্তির মাধ্যমে যাচাই করার পর অনুমোদন দেওয়া হবে।
কোনো প্রকল্পের সময়সীমা কিংবা অর্থায়ন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন এবং আইএমইডি স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে প্রকল্পটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। একই প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে বনায়নের ক্ষেত্রসমূহ স্কোয়ার মিটারে নির্ণয় করতে পারবে।
জিআইএস এমন একটি প্রযুক্তি যার মাধ্যমে ভু-পৃষ্ঠের অবস্থান নির্ণয় ও পর্যবেক্ষণ করা যায়। প্রযুক্তিটিতে ম্যাপের সাথে সাধারণ ডেটাবেজ অপারেশন যেমন কোয়ারি এবং স্ট্যাটিস্টিকাল বিশ্লেষণকে একীভূত করা হয়।
রিমোট সেন্সিং হলো বিমান কিংবা স্যাটেলাইটের সেন্সরের সাহায্যে ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন মাপঝোঁক নির্ণয়ের বিজ্ঞান ও কলা। এই সেন্সরগুলো চিত্রের সাহায্যে তথ্য ধারণ করে এবং চিত্রগুলো বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখে। জিআইএসের সাথেই রিমোট সেন্সিং চিত্রায়ন যুক্ত থাকে।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হলে আরও কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, জিআইএস ব্যবহারের মাধ্যমে সহজ, সুলভ এবং সবথেকে উপযোগী উপায়ে কীভাবে প্রযুক্তি ও অন্যান্য বিকল্প ব্যবহৃত হতে পারে তা সহজেই বাছাই করা যাবে।
ব্রিজ নির্মাণের অনুমোদন প্রদানের আগে নদী পথের উল্লম্ব ও আনুভূমিক ছাড়পত্রের ক্ষেত্রেও জিআইএস ব্যবহার করা যাবে। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ব্রিজ পুনর্নিমাণের খরচও বাঁচাবে এই প্রযুক্তি।
এছাড়া, জিআইএস এবং আরএসএ ব্যবহার করে হাইড্রোগ্রাফিক চিত্র তৈরি করা যাবে যার মাধ্যমে ড্রেজিং, খাল পুনর্খনন, বাঁধ এবং অন্যান্য কাজে ভূপৃষ্ঠের সুর্নিদিষ্ট আয়তন নির্ণয় করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের (ইউআরপি) অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ শাকিল আখতার বলেন, জিআইএস ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদনের পরিকল্পনা বেশ ভালো একটি উদ্যোগ।
তিনি বলেন, "এ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিগত পাঁচ বছর কিংবা তারও আগে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, সেই তথ্য পাওয়া যাবে। নতুন কোনো রাস্তা কিংবা অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ বা সংস্কার হলে তার সময়সূচিও এই ম্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে। ফলে পুনরাবৃত্তি এড়ানো সহজ হবে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের প্রাক্তন অধ্যাপক আমানত উল্লাহ খান বলেন, বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তর (এসওবি) এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে পুরো দেশের আধুনিক জিআইএস ম্যাপ আছে।
"এছাড়াও সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, এলজিইডি, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে জিআইএস ম্যাপ আছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের তথ্য একত্রিত করে একটি সম্মিলিত তথ্যাগার নির্মাণ করা যেতে পারে।"
বাংলাদেশ সোসাইটি অব জিও-ইনফরম্যাটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আমানত উল্লাহ খান আরও বলেন, "বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়মিতভাবে ম্যাপটি আপডেট করার ব্যবস্থা নিতে হবে"।
উচ্চ রেজ্যুল্যুশন সমৃদ্ধ এসব স্যাটেলাইট চিত্র পর্যালোচনা করে রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্যোগকালীন ক্ষয়ক্ষতিও মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। এমনকি চিত্রগুলো থেকে প্রমাণ সাপেক্ষে ত্রাণ এবং পুনর্বাসন প্রয়োজনীয়তাও বিবেচনা করা সম্ভব হবে।
স্থানিক বিবেচনায় জনবসতির কাছাকাছি দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্যসেবাদান কেন্দ্রের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ণয় করাও সম্ভব হবে।
এছাড়া, জিআইএস এবং আরএসএ ডেটাবেজের ভিত্তিতে বিভিন্ন অবকাঠামো, ব্রিজ, রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্য সেবাদান কেন্দ্র, স্থল, নৌ এবং সমুদ্র বন্দর, ডিপো, বিমানবন্দর, খাদ্য গুদাম, হিমাগারের মতো সকল সম্পদ তালিকাবদ্ধ করা যেতে পারে।
ভবিষ্যতে নির্মাণ পরিকল্পনা নির্ধারণেও সাহায্য করবে এই প্রযুক্তি। দুর্যোগের সময় জরুরি সরঞ্জামাদি এবং উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত বিশেষায়িত যানবাহন সরবরাহ পরিকল্পনাও প্রযুক্তিটির মাধ্যমে সহজেই পরিচালনা করা যাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কনসেপ্ট পেপার অনুযায়ী, স্থানিক ডেটার ব্যবহার আশেপাশের উদ্ভিদ এবং প্রাণীকূলের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব, ভূগর্ভস্থ এবং পৃষ্ঠজলের উপর প্রভাব, বাস্তুসংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) উপর প্রভাব ইত্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে বা কমাতে সক্ষম হবে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং কর্তৃপক্ষ সিস্টেমটিতে তথ্য যুক্ত এবং হালনাগাদ করতে পারবে। সম্মিলিত পরিকল্পনা পরিচালনার জন্য পুরো তথ্যাগারটিতেই পরিকল্পনা কমিশনের প্রবেশাধিকার থাকবে।
বিভিন্ন সরকারি বিভাগ এবং কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ বিভাগের পরিকল্পনার জন্য কমিশনের ডিজিটাল সেবা পোর্টাল ব্যবহার করতে পারবে বলেও জানান কমিশনের একজন কর্মকর্তা।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Satellite image check planned to stop project anomalies