চশমার বৃহত্তর ও প্রাচীনতম পাইকারি বাজারের করোনাচিত্র
ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে কিছুদূর এগিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পেরোলেই ফুটওভার ব্রিজের ডানদিকে পাশাপাশি রয়েছে ইসলামপুর আর পাটুয়াটুলি। প্রথমটিতে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের বাজার আর পরেরটিতে চশমার সর্ববৃহৎ বিখ্যাত পাইকারি বাজার
বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে যতদূর ইতিহাস ঘাঁটা গেল তাতে বুঝলাম, পাটুয়াটুলিতে প্রথম চশমার দোকানটি স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে; অর্থাৎ এ বাজারের গোড়াপত্তন সেই ইংরেজদের আমলের শেষদিকে। ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র তখন কেবলমাত্র স্বাধীন হয়েছে!
খোঁজখবর করে সবচেয়ে পুরনো কিছু দোকানের হদিশ বের করা গেল, এরমধ্যে কামাল অপটিক্যাল, প্যারাডাইজ অপটিক্যাল, মেহবুব অপটিক্যাল, চশমা ঘর, এই চার দোকানের গোড়াপত্তন হয় সেই শুরুতে। ১৯৪৮ সালে। বাকি দোকানগুলো অনেক পরে, পর্যায়ক্রমে।
পাটুয়াটুলিতে ঢোকার মুখেই একেবারে শুরুর দিকেই কামাল অপটিক্যালের অবস্থান। এই দোকানে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন খোকন। তার দৃষ্টিকোণ দিয়ে পাটুয়াটুলির চশমা ব্যবসার খুটিনাটি জানতে চাইলাম।
"এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা চশমা কিনতে আসে', অনেক জ্যাম ঠেলে তাদের আসতে হয় বলে জানালেন খোকন।
'জ্যাম তো আছেই, পুরনো ঢাকার অলিগলি পর্যন্ত আসতে গাড়িভাড়াও কম যায় না। এসব বিবেচনায় নিয়েই আমরা দাম কম রাখি। তাছাড়া, এখানে বিকিকিনি হয় পাইকারি দরে। আমাদের এখানে যে ফ্রেমের দাম ৫০০ টাকা, সেটিই বাইরের বড় দোকানগুলোতে চাইবে ন্যূনতম ২০০০ টাকা।"
অনেক সময় ক্রেতার সাধ্য বুঝেও পাটুয়াটুলির বিক্রেতারা চশমার ফ্রেমের দাম চেয়ে থাকেন।
"করোনায় এমনিতেই বেচাবিক্রির হার অনেক কম। লাভ তেমন একটা না হলেও, আমরা প্রডাক্ট ধরে রাখিনা। মানুষ এত কষ্ট করে এতটা পথ আসে, বিক্রেতা হিসেবে আমরাও তাই কিছুটা বিবেচনা করি", আন্তরিকতার হাসি হেসে আরও বললেন খোকন।
জানা গেল, পাটুয়াটুলির বেশিরভাগ চশমার মূল উৎস চীন। চীনের পাশাপাশি ভারত থেকেও ইদানীং চশমা ও ফ্রেম আমদানি হয়। বিমান আর জাহাজ দু'পথেই চলে আমদানি। মাত্র ৬০ টাকা থেকে শুরু করে দুই হাজার টাকার ফ্রেমও মিলবে পুরনো ঢাকার এই আড়তে।
১৯৪৮ সাল থেকে পাটুয়াটুলিতে সুনামের সাথে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে প্যারাডাইস অপটিক্যাল। এখানে পাইকারি ও খুচরা দুইভাবেই বিকিকিনি চলে। ক্রেতাদের প্রয়োজনে চোখের ডাক্তার দেখানোরও সুযোগ আছে। কয়েকটা দোকান ঘুরে ভেতরে বেশ কিছু রোগীকে ডাক্তারের জন্য বসে থাকতেও দেখা গেল।
প্যারাডাইস অপটিক্যালের বিক্রেতা শাহরিয়ার হাসান জানালেন, পুরনো হলেও করোনার প্রভাব কাটাতে পারেননি এ বাজারের কেউই, ব্যবসা অর্ধেক কমে গেছে।
"এখানে একশটির ওপর চশমার দোকান। কখনো ১৫ হাজার টাকার বিক্রি হয়, আবার কখনো ৫ হাজারও হয় না। বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে", বললেন শাহরিয়ার।
বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, খুচরাতে ফ্রেমভেদে ৪০ টাকার কাছাকাছি লাভ থাকে, অন্যদিকে পাইকারি দরে প্রতি ফ্রেমে লাভ হয় ১০ টাকার মতন।
পাটুয়াটুলির চশমা বাইরের দোকানে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়; এ কথায় সায় দিলেন কাজী অপটিক্যালের বিক্রয়কর্মী জাকারিয়া অনিকও। তাহলে পাটুয়াটুলির বিক্রেতাদের লাভ হয় কীভাবে?
এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এখানে যেহেতু দিনশেষে বিক্রয়ের পরিমাণ বেশি, ফলে লাভের সম্ভাবনাও বেশিই। ঢাকার বড় বড় এলাকার চশমার দোকানগুলোতে তো আর আমাদের মত এত দেদারসে বিক্রি হয় না।'
ফলে "পাইকারী থেকে আমাদের মূল লাভ উঠে যায়। খুচরা যেসব বিক্রি করি, তাতে আমরা ক্রেতাদের কাছে সামান্য দাম কমিয়ে দিলেও তেমন একটা লোকসান গুনতে হয় না। এজন্যই নিজেদের ব্যবহারের জন্য যেসব ক্রেতারা চশমা কিনতে আসে, তখন পাইকারি বাজার হওয়া সত্ত্বেও; তারা এখানে খুচরা ফ্রেম সুলভ মূল্যে পান।"
অনিক জানালেন, খুচরা বিক্রয় থেকে মাস শেষে তাদের এক লাখ আশি হাজার থেকে দুই লাখ বিশ বা কোন কোন মাসে আড়াই লাখ টাকার মত আয় হয়। ঢাকার বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীরা কয়েক হাজার পিস চশমা একই দিনে কিনে নিয়ে যায়। পাইকারীর ক্ষেত্রে ফ্রেমের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, টাকার অংকটাও বড়। অনিকের ভাষ্যমতে, "পাইকারি বেচাকেনার হিসেবটাই আলাদা।"
এ দোকানেই নিজের জন্য চশমার ফ্রেম বাছাই করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিন। গত তিন বছর যাবত পাটুয়াটুলি থেকেই চশমা কেনা হয় তার। কারণ হিসেবে তিনিও জানালেন চশমার সুলভ মূল্যের কথা।
"পাটুয়াটুলির চশমার মান অনেক ভাল। ফ্যাশনেবল আর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চশমা এখানে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। ঘুরে ঘুরে অনেক দোকান থেকে পছন্দ করা যায়। আমি তাই এখান থেকেই চশমা কিনি।''
৭২ বছর পুরনো মেহবুব অপটিক্যালের সামনে আসলেই বোঝা যায় এর গায়ে লেগে আছে দীর্ঘকালের আঁচড়। মুরুব্বিরা বললেন, আগে যৌবনে এই দোকান দেখনদার থাকলেও, এখন এই হতশ্রী, জীর্ণ অবস্থা। চশমা মার্কেটের অন্যসব নতুন দোকানের জেল্লা- প্রাচীনতম মেহবুব অপটিক্যালে অনেকটাই অনুপস্থিত। ১৯৪৮ এই দোকানের প্রতিষ্ঠাকাল। ব্যবসার হাল এখন তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। দোকানের বয়স চশমা রাখার তাক দেখেও খানিকটা আন্দাজ করা যায়!
কথা হলো এখানকার দু'জন কর্মচারীর সাথে। মো. আলমগীর কাজ করছেন প্রায় ১৬ বছর যাবৎ, অপর বিক্রয়কর্মী মো. নূর হোসেন চশমা বিক্রয়ের সাথে জড়িত ৪০ বছরের উপর।
মো. আলমগীর এর মতে, পাটুয়াটুলির আগের সেই একচেটিয়া আধিপত্য এখন নেই। প্রতিটি পাড়া, মহল্লা আর জেলায় জেলায় এখন চশমার দোকান গড়ে উঠেছে।
একসময় মেহবুব অপটিক্যাল, কামাল অপটিক্যাল, ফ্যাশন অপটিক্যালের মত বনেদি দোকানগুলোই শুধু বাইরে থেকে চশমা আমদানি করে নিয়ে আসত। তাদের কাছ থেকে খুচরা চশমা ব্যবসায়ীরা কিনতেন।
কিন্তু এখন সময় বদলেছে, বদলেছে ব্যবসার ধরনও।
এখন নতুন অনেক ব্যবসায়ী্রা নিজেরাই সরাসরি আমদানির সাথে জড়িত। তারা স্বয়ং চীনা রপ্তানিকারকদের থেকে চশমা কেনে; ফলে বনেদি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কেউ নির্ভরশীল নয়। বরং পরিস্থিতি উলটে গেছে বলে জানালেন আলমগীর।
অগ্রজদের কেউ কেউ এখন নতুনদের কাছ থেকে আধুনিক নকশা ও ফ্রেমের চশমা কিনে এনে নিজেদের দোকানে বিক্রি করছেন। করোনায় বিপুল ক্ষতির উল্লেখ করলেন এই আদি দোকানের দীর্ঘদিনের কর্মচারী।
"আগের তুলনায় এখন তিনভাগের এক ভাগ বিক্রিও হয় না। করোনার আগে আমাদের দোকানে কর্মচারী ছিল ১৫-১৬ জন, এখন করোনার পর রয়ে গেছে মাত্র তিনজন। দোকানের ভাড়াই উঠছে না, কর্মচারীদের বেতন আসবে কোত্থেকে!"
করোনা পরবর্তী প্রভাব কাটিয়ে উঠতে চশমা বাণিজ্যে তাই সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন মো. আলমগীর।
একই সুর শোনা গেল লাকি অপটিক্যালের চশমা বিক্রয়কারক মো. আক্তার হোসেনের মুখেও। তিনি বললেন, "করোনায় এখন আগের মতো ব্যবসা নেই। আগে এমনও দিন গেছে যখন আমরা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ফ্রেম বিক্রি করেছি, এখন পাঁচ হাজার টাকাও ওঠে না।"
তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, "মহামারিতে একমাত্র ঔষধের ব্যবসাই আলোর মুখ দেখেছে, বাকি সব ধরনের ব্যবসা ডুবেছে।"
"যে কোন ব্যবসার ক্ষেত্রে এতদিন বৃহস্পতি আর শনিবার বিক্রির হার বেশি থাকত। করোনা এসে সে ধারাও বদলে দিল।''
এক দোকানের দুজন কর্মচারী চাকুরী হারানোর ভয়ের কথা উল্লেখ করে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন: এখানে এমন দোকান মালিকও আছেন, জমি বিক্রি করে এনে ব্যবসায় টিকে থাকতে চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ কর্মচারীদের বেতন না দিতে পেরে, স্বেচ্ছায় চলে যাওয়ার অনুরোধও করছেন।
চশমার পাশাপাশি পাটুয়াটুলিতে আছে আধুনিক সব নকশার সানগ্লাস। শুক্রবার পাটুয়াটুলিতে বন্ধের দিন।
ডিজিটাল লেনদেনের যুগে এসে, প্রাচীন এই চশমার বাজারেও হাতেগোণা কিছু দোকানে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে যারা ঢাকার বাইরে থেকে আসেন; তারা নগদ লেনদেনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, বলে জানান প্যারাডাইস অপটিক্যালের বিক্রয়কর্মী শাহরিয়ার।
আধিপত্য কমে এলেও এতসব আলো-ঝলমলে নতুন দোকানের ভিড়ে পাটুয়াটুলি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে কিনা- জানতে চেয়েছিলাম মেহবুব অপটিক্যালের বিক্রেতা মো. আলমগীরের কাছে।
"আমাদের এই দোকান ১৯৪৮ সাল থেকে চলছে। এর প্রতিষ্ঠাতারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। মানুষ চলে যায়, কিন্তু ব্যবসা ঠিকই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে চলে। পাটুয়াটুলিকে সারা বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে চশমার বৃহত্তম বাজার হিসেবে চেনে, তার কদর কখনোই শেষ হবে না", প্রত্যুত্তরে বললেন তিনি।
বাংলাদেশ চশমা শিল্প ও বণিক সমিতির কমিটির সদস্যদের কারো সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও, এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া জানা সম্ভব হয়নি।