মূল সূচকগুলোর ইতিবাচক ধারায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ছায়া
গত বছরের সাধারণ ছুটির প্রভাব কাটিয়ে গত ডিসেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় শিল্পপণ্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৮২ শতাংশ। গত মাস পর্যন্ত দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবহার ও বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির তথ্য অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিল। প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক বেশিরভাগ সূচক-আমদানি-রপ্তানি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ইতিবাচক চিত্র অর্থনীতিকে প্রি-প্যান্ডেমিক লেবেলে পৌঁছে দেওয়ার মতো শক্তিশালী অবস্থানে ছিল, রাজস্ব আদায়েও প্রবৃদ্ধির দেখা মিলছিল। প্রবাস আয় ও কৃষিখাতে ঋণ বিতরণ বরাবরই উৎসাহব্যাঞ্জক ছিল।
করোনার সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলায় চলমান লকডাউনে এসব সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার তথ্য উঠে এসেছে অর্থবিভাগের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে, যা সম্প্রতি 'সরকারি সম্পদ ও বাজেট মনিটরিং কমিটি'তে উপস্থাপন করেছেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে বোরোর বাম্পার ফলন ও আগামী জুন নাগাদ রপ্তানিতে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
চাহিদা সৃষ্টিকারী সূচকগুলো কোভিডের ধকল সামলে নিয়ে গত এক বছরে ইতিবাচক ধারায় ফিরলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করার সূচকগুলো সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর আগেও প্রি-প্যান্ডেমিক লেবেলের তুলনায় অনেক পেছনে ছিল। গত অর্থবছরের জুলাই- ফেব্রুয়ারি সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশের বেশি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়া এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক অবস্থায় ছিল, যা চলমান লকডাউনের প্রভাবে আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করেছে অর্থবিভাগ।
করোনার ভয়ে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার এই সময়ে সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সচল রাখার উদ্যোগের কথা গত বাজেট বক্তব্যে বলা হলেও বাস্তব চিত্র পুরোই উল্টো। গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আগের বছরের তুলনায় সরকারের উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় উভয়ই কমে গেছে। ফলে অর্থনীতির সংকটকালে সরকারের বিনিয়োগ বাড়িয়ে বেসরকারিখাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার কথা থাকলেও, এক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে যেখানে সরকারের মোট ব্যয় ছিল ২,১৭,৪৪১ কোটি টাকা, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ১,৯৬,০৬১ কোটি টাকা। বাজেটের আকার বিবেচনায় গত অর্থবছর এই সময়ে সরকারি ব্যয় ছিল মোট বাজেটের ৪১.৫৬ শতাংশ, এবার হয়েছে ৩৪.৫২ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় করেছে সরকার।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় ৪২ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে সরকার। আগের অর্থবছর একই সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৪৫ শতাংশের বেশি ছিল। চলতি অর্থবছর শেষেও এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সন্তোষজনক হবে না বলে আশঙ্কা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কোভিড মহামারি থেকে অর্থনৈতিক সুরক্ষায় ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১,২৮,৪৪১ কোটি টাকা ঋণ-সহায়তা ঘোষণা করলেও প্রি-প্যান্ডেমিক লেবেলের তুলনায় বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। মূলত কোভিডের কারণে অনিশ্চিত ভবিষ্যত এবং একদিকে ইকোনমিক জোনগুলো সময়মত বাস্তবায়ন করতে না পারা, অন্যদিকে ইকোনমিক জোনের বাইরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। গত বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারির তুলনায় এ বছরের একই সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে ৫৩০ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোভিডকালে সরকারের ব্যয় ও বেসরকারিখাতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে যেভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সমর্থন দেওয়া প্রয়োজন ছিল, তা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলায় ঘোষিত প্রায় মাসব্যাপী লকডাউনে ইতোমধ্যে ইতিবাচক ধারায় ফেরা সূচকগুলো আবারও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে নামবে। আর বিনিয়োগ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, বেসরকারিখাতে ঋণপ্রবাহ একই সূত্রে গাঁথা, যা বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক কোভিড পরিস্থিতিতে উন্নতি না হলে ইতিবাচক ধারায় ফিরবে না।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, 'গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে অর্থনীতি যে গভীর খাদে পড়েছিল, তা থেকে উত্তরণের একটা প্রবণতা জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত চলছিল। এই খাদ থেকে উঠে এসে সামনে যেতে পারলে প্রবৃদ্ধির দেখা মিলত। তবে এর আগেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির ক্ষত কতটা গভীর হবে, আর এর প্রবণতা কত মাস থাকবে সে বিষয়ে ধারণা করা যাচ্ছে না'।
তিনি বলেন, 'মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি আয় আগের বছরের চাইতে সামান্য কম। বিনিয়োগের কোন সূচকই করোনার আগের অবস্থায় যায়নি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বাস্তবায়নে অদক্ষতার কারণে সরকারের আর্থিক ব্যয়ে খাদ থেকে বের হওয়ারও কোন লক্ষণ নেই'।
তিনি বলেন, 'জিডিপির সবচেয়ে বড় অংশ ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয়ে কিছুটা পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। মানুষের কেনাকাটা, ভ্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভ্যাট আহরণে টাকার অংশে কিছু প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছিল'।
কাজেই এ কথা বলা যাচ্ছে যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছিল। তবে প্রবৃদ্ধি দেখা যাওয়ার আগেই সঙ্কট শুরু হয়েছে।
বিদেশি বাণিজ্যে সারা বছরই কারেন্ট একাউন্টে সারপ্লাস ছিল। যার কারণে রিজার্ভ বেড়েছে। তবে বহিঃবাণিজ্যে স্থিতিশীলতার মূল কারণ অর্থনৈতিক স্থবিরতা।
বিনিয়োগ বেশি হলে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বেশি হতে পারত। উৎপাদন ঠিক থাকলে কাচামাল আমদানি আরও বেড়ে যেত। এর ফলে কারেন্ট একাউন্টে চাপ থাকত। অন্তত ট্রেড ব্যালান্স নেগেটিভ হতে পারত।
করোনায় স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি রক্ষায় বড় অঙ্কের চাহিদা থাকলেও সরকারের অর্থ ব্যয় উল্টো কমেছে। এর ফলে বড় অঙ্কের ঘাটতি প্রাক্কলন করে বাজেট দেয়া হলেও সার্বিক বাজেট ঘাটতি লক্ষ্যের কম।
তবে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা। বিভিন্ন খাতে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধির মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। ফলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে না। তবে ব্যবসা বাণিজ্যের পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় এই সূচকেও অবনতি হবে বলে তার আশঙ্কা।
তিনি বলেন, 'চলতি বাজেটেই সরকারের ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বাজেট ঘাটতি কম থাকায় অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ সরকারের রয়েছে'।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এর সাবেক প্রেসিডেন্ট শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ব্যাপকমাত্রায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছে। এতে আগামী কয়েকমাসের মধ্যে ওইসব দেশের ক্রেতাদের আস্থা ফিরলে বাংলাদেশের রপ্তানিও ইতিবাচক ধারায় ফিরবে'।
তিনি বলেন, 'সেকেন্ড ওয়েভ অর্থনীতিতে এতোটা প্রভাব ফেলবে, তা কারও ভাবনায় ছিল না। প্রথম ওয়েভের সংকট কাটিয়ে ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, এই সময়ে নতুন করে সংকট হওয়ায় তাদের আগের অবস্থায় ফিরতে এবার বেশি সময় লাগবে'।
'অনেকে পেটে-ভাতে বাঁচার চেষ্টা করছে। সরকারও জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করছে। ছোট ব্যবসায়ীরা গতবছর পহেলা বৈশাখ ও ঈদ উল ফিতরে লোকসান করেছে। এবারও তাদের ঈদবিক্রি ভালো হবে না। কারণ, ক্রেতাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঘাটতি রয়েছে। তাই সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে', যোগ করেন তিনি।
চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন আনার পর ব্যাপকমাত্রায় টিকাদানের মাধ্যমে মানুষের আস্থা ফেরানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, 'ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে কোভিড নিয়ন্ত্রণে আসার সময় যাতে বাংলাদেশেও তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে। একই সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারের বিনিয়োগ অনেক বাড়াতে হবে। সরকারের ব্যয় না বাড়লে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না'।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আগেও অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকেই মন্দা পরিস্থিতি ছিল। প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় তেমন বাড়েনি। বিনিয়োগ ও উৎপাদনের প্রতিটি স্তরেই স্থবিরতা বিরাজ করছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ছে না। আবার আমদানির পরিমাণও কমছে'।
'অর্থনীতির এ মন্দা কতদিন থাকে তা নির্ভর করছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্রতা ও স্থায়ীত্বের উপর। তবে আমার মনে হয় প্রথম ঢেউয়ের মতো করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব পড়বে না। তবে অর্থনীতির গতি কমে আসবে'।
তিনি বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির গতি ধরে রাখা কঠিন হবে। আমার মতে এবার দুই-তিন শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে না'।
তিনি আরও বলেন, 'নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন। অনিশ্চয়তা না কাটলে তারা কখনোই বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। জিডিপির ৩০ শতাংশের বেশিই আসছে বিনিয়োগ থেকে। এই বিনিয়োগ বাদ দিয়ে অর্থনীতি সামনে যেতে পারবে না'।
'এই মুহূর্তে বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাঁধা করোনার বিস্তার। যে সমস্ত দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তাদের বিনিয়োগ, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কাজেই আমাদের অর্থনীতি সচল রাখতে হলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টিকাদানের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, যেখানে সরকার এতদিন উদাসীন ছিল'।
তবে এটা ঠিক যে করোনার শতভাগ টিকা নিশ্চিত করতে অনেক সময় লাগবে। এ সময়ের মধ্যে জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করে কখনও লকডাউন প্রয়োগের মাধ্যমে আবার কখনও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে।