কোভিডের রহস্যময় সংক্রমণ হ্রাসে কেনাকাটার উৎসবে মেতেছেন ভারতীয়রা
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ ভারত। কোভিড সংক্রমণেও যুক্তরাষ্ট্রের পরেই প্রতিবেশী দেশটির অবস্থান। তবু, সাম্প্রতিক সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন ভারতীয়রা।
জনজীবনে চাঞ্চল্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে ভালো করেই চোখে পড়ে। বিপণীকেন্দ্রের পার্কিং লটে রাখা গাড়ির সারি, দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষির কোলাহল, সেলুনে ও রেস্তোরাঁয় লম্বা লাইন; সবখানেই জনতার ভিড় দৃশ্যমান।
'বাড়িতে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি, কতক্ষণ আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা যায়?' প্রশ্ন রাখেন ৩২ বছরের গৃহিণী কানিজ জোহরা। বিগত কয়েক মাসে তিনি দুটি জাতীয় ছুটিতে দেশের নানা প্রান্তে স্বপরিবারে ভ্রমণ করেন। গত মাসে তিনি ভিড় ঠেলে দিল্লির জনপ্রিয় ডিএলএফ মলেও শপিং করতে যান।
"সংক্রমিত হওয়ার ভয় প্রথম প্রথম অবশ্যই ছিল। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে ভাইরাসটি যেমন ভাবা হয়েছিল, তেমনভাবে ভারতীয়দের আক্রান্ত করেনি। বিশেষ করে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মারাত্মক অবস্থার তুলনায় ভারতীয়রা ভালোই আছে।"
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশাল অঞ্চল করোনাভাইরাসের বিস্তারে প্রায় অচল। প্রাদুর্ভাব নিয়ে সতর্ক আছে চীন।
সেই তুলনায় ভারতজুড়ে যেন উবে গেছে মহামারি নিয়ে জনমনের উদ্বেগ। জাতীয় পর্যায়ে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যু হারের রহস্যময় ও নাটকীয় পতন, যার মূল কারণ। আর মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া মাত্র কানিজের মতো ক্রেতারা ভিড় করছেন পছন্দের দোকানে। সবল চাহিদার কল্যাণে ভোক্তাপণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলো তাদের আয় বৃদ্ধির কথা জানাচ্ছে, অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে ইতিবাচক সম্ভাবনা। ভারতীয় অর্থনীতির উত্তরণে যতোটা সময় লাগবে ভাবা হয়েছিল, বাস্তবে তার চাইতেও দ্রুত ঘটছে ইতিবাচক এসব ঘটনা।
ভারতে সংক্রমণ হারের ক্রমাগত পতনের ঘটনা বিজ্ঞানীদের দ্বন্দ্বে ফেলেছে। কোভিডের দ্বিতীয়, তৃতীয় এমনকি চতুর্থ ঢেউয়ের আঘাতে নানা দেশে যখন বিপর্যস্ত, তখন সংক্রমণ হারে শীর্ষস্থানে থাকা একটি দেশে কীভাবে তা কমছে- তার উত্তর অজানা।
গেল বছরের সেপ্টেম্বরে সংক্রমণের চূড়ান্ত উঠতি লক্ষ্য করে ভারত। তখন দৈনিক ১ লাখের কাছাকাছি ছিল শনাক্তের সংখ্যা। তারপর থেকে নতুন সংক্রমণের হার কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। মৃত্যুহারও কমেছে একই গতিতে। সেপ্টেম্বরে দৈনিক মৃত্যু ১০০০ জনের বেশি হলেও- তা এখন ১০০ জনেরও কম।
অবশ্য, আনুষ্ঠানিক সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। এজন্য তারা আগের তুলনায় কম পরিমাণে স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং গ্রামীণ এলাকায় ইচ্ছেকৃতভাবে মৃতের সংখ্যা কম দেখানোকে দায়ী করছেন। কৃত্রিমভাবে সংখ্যা বদলানো হলেও, তা যে খুব বড় আকারে হচ্ছে না- তার প্রমাণ মেলে দেশটির প্রায় শূন্য কোভিড ওয়ার্ডগুলোর দিকে তাকালে। এই চিত্র মহামারির সত্যিকার উন্নতির দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে অতি-আশাবাদ বেড়েছে সর্বত্র। দেশটির সরকারি অর্থনীতিবিদেরা আগামী ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আভাস দিচ্ছেন। এটি অর্জিত হলে ২০২০ সালের রেকর্ড ৭.৭ শতাংশ সঙ্কোচনের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা যাবে।
ভারতের আর্থিকখাতের কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থা- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া'র গভর্নর শক্তিকান্ত দাস চলতি ফেব্রুয়ারিতেই বলেন, 'ভোক্তাদের আস্থা ফিরছে।' এর মাধ্যমে তিনি স্থানীয় অর্থনীতিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসা, অব্যাহত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা এবং অন্যান্য সূচকের ইতিবাচক অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত দেন।
মহামারির কারণে এতদিন চাহিদার যে আগুন ছাইচাপা পড়েছিল, তা স্ফুলিঙ্গে রূপ নিয়েছে ভোক্তাদের নির্ভাবনায় খরচ করার প্রবণতায়। দেশটির বৃহত্তম কিছু খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তাপণ্য উৎপাদক কোম্পানি এখন যার সুফল পেতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরে সমাপ্ত প্রান্তিকে রেকর্ড মুনাফার ঘোষণা দেয় রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। মুকেশ আম্বানির খুচরা ব্যবসার উদ্যোগে বিপুল সফলতা, শিল্পগোষ্ঠীটির লাভের অঙ্ক বাড়ায়। আদিত্য বিড়লা গ্রুপের আওতাধীন ফ্যাশন রিটেইল সংস্থাও গত প্রান্তিকে লাভের ঘোষণা দেয়। অথচ, গেল বছরের একই মেয়াদে কোম্পানিটি লোকসানের মুখ দেখেছিল।
ভোক্তাপণ্য উৎপাদক ইউনিলিভার পিএলসি চতুর্থ প্রান্তিকে ভারতীয় বাজারে ২০ শতাংশ বিক্রয় বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়। বহুজাতিক সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যালান জোপ ব্লুমবার্গ টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "জীবাণুর বিস্তারে মহা-সঙ্কটপূর্ণ সময় কাটানোর পর, আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি।"
অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো প্রমাণ করছে; যাত্রীবাহী গাড়ি বিক্রির গতি, সঙ্গে ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানিও বেড়েছে। ভারতের বিমানবন্দর ও মহাসড়কগুলোতেও দেখা যাচ্ছে ব্যস্ততা।
আজ সোমবার আর্থিক সংস্থা- নোমুরা হোল্ডিং ইঙ্ক জানায়, তাদের ভারতীয় ব্যবসায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার সূচক- ইন্ডিয়া বিজনেস রিসাম্পশন ইনডেক্স ধারাবাহিক ঊর্দ্ধগতি লক্ষ্য করছে। এমনকি গত সপ্তাহের শেষ নাগাদ সূচকটি মহামারি-পূর্ব অবস্থানের চাইতে মাত্র দুই শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে চলে আসে।
ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের ভারত বিশেষজ্ঞ অভিষেক গুপ্তা বলেন, "মহামারিতে সবচেয়ে প্রভাবিত হয়েছিল মুম্বাই ও দিল্লি। দুটি শহরেই এখন চলাফেরার দিক থেকে জনজীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে।"
তবে মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের আস্থা ফেরার সুবাতাস নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্যে সুখবর হতে পারেনি। তাদের মধ্যে দারিদ্র্য আরও বেড়েছে। মহামারির অভিঘাতে নতুন করে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ অতি-দরিদ্রে পরিণত হয়েছেন,বলে একটি জরিপে ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আশা, জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টিকাদানের কল্যাণে সবাই অর্থনৈতিক উত্তরণের সুফল পাবে। তবে এখন পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের প্রত্যাশার তুলনায় ধীরগতিতে চলছে টিকাদানের উদ্যোগ। টিকানীতি নিয়ে কৌশলগত কিছু সিদ্ধান্তই তার প্রধান কারণ। তরিঘড়ি করে স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি ভ্যাকসিন অনুমোদন এবং তা জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করায়- প্রতিষেধক গ্রহণে ইতস্তত করছেন অনেকেই।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ