সরকারি খরচ বাড়িয়ে ভারত কি দ্রুত অর্থনৈতিক উত্তরণে ফিরতে পারবে?
গত সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভারতের জাতীয় বাজেট ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। তার বিপরীতে আশাভঙ্গ হয় বন্ডে লেনদেনকারীদের। উভয়ের প্রতিক্রিয়াই কী সঠিক?
বাজেট অধিবেশনে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ চলতি অর্থবছরে মোট সাড়ে ৩৪ লাখ কোটি রুপি বা ৪৭২ বিলিয়ন ডলার খরচের ঘোষণা দেন, যা বিশ্লেষকদের ধারণার চাইতেও ৫৭ বিলিয়ন ডলার বেশি। বিশ্লেষকরা এপ্রিল থেকে নভেম্বর মেয়াদের প্রবণতা অনুসারে ওই আভাস দেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত খরচের হার বাধাগ্রস্ত হবে, এমন হিসাবের ভিত্তিতেই তারা নতুন বছরে সরকারি ব্যয় কম হওয়ার প্রাক্কালন করেন।
কিন্তু, সীতারমণ শুধু খরচের অঙ্কেই উদারহস্ত হননি। আগামী অর্থবছরে কোষাগার থেকে বাড়তি ৫শ' কোটি ডলার খরচের বিবেচনাও রেখেছেন।
এই ঘোষণায় প্রধানত চারটি কারণে পুঁজিবাজারে বইছে খুশির জোয়ার। প্রথমত, ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণে; নতুন করে কোনো করারোপ করা হয়নি বা করের পরিধিও বাড়ানো হয়নি। দ্বিতীয়ত, মোট ব্যয় আরও ৫শ' কোটি ডলার বাড়লেও, পুঁজি খরচের বিবেচনায়; ভারতীয় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রয়াদেশ এবং মুনাফার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার বাড়বে বলে আভাস দেওয়া হয়। তৃতীয়ত, বাণিজ্যিক ঋণ দাতাদের মন্দ সম্পদের বোঝা হ্রাস করতে অর্থমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি- বাজারে আশা সঞ্চার করেছে অধিক স্বাধীন অর্থ প্রবাহের। পাশাপাশি, অবকাঠামো খাতের পুঁজি চাহিদা পূরণে নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করবে কেন্দ্রীয় সরকার। আর চতুর্থত, বিদেশি বীমাকারীদের স্থানীয় যৌথ উদ্যোগে অংশীদারিত্ব ৪৯% থেকে বাড়িয়ে ৭৪% করার সিদ্ধান্তও একটি অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য সংস্কারের পদক্ষেপ।
সেই তুলনায় বন্ডে বিনিয়োগকারীরা নেতিবাচক মূল্যায়নের আশঙ্কায় মুষড়ে পড়েন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপি'র সাড়ে ৯ শতাংশ হতে পারে। এই ব্যবধান পূর্বানুমানের চাইতেও ২ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।
সীতারমণ আগামী বছরে ঘাটতির ব্যাপকতা কমানোর ইচ্ছে পোষণ করেছেন। তবে সেটা ব্যাপক আকারে হবে না, বলেও জানান। ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে জিডিপি'র ৬.৮ শতাংশ, এবং তা সত্ত্বেও বন্ড বাজার এবং নাগরিকদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে আবারও নয়াদিল্লিকে আগ্রাসীভাবে ঋণ নেওয়া শুরু করতে হবে। এই অবস্থায় সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ কেন্দ্রিয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার দিকে। আরবিআই পুঁজিবাজারে বিদেশি লগ্নীর ডলার কিনে রুপির দরবৃদ্ধি ঠেকাতে সচেষ্ট। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারি বন্ড পুনঃক্রয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাধ্যের একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
ভারত অর্থনীতির শোচনীয় হাল থেকে দ্রুত উত্তরণে রেখাচিত্রে ইংরেজি বর্ণমালার 'ভি' অক্ষরের মতো উত্থান চায়। একবার সেটি অর্জন করা গেলে সরকারি ব্যয়ের পরিধি হ্রাস করা যাবে বলেও আশা করছে সরকার। যেকারণে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর থেকে আয় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধির, আর রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে আগের চাইতে পাঁচগুণ বেশি আয়ের হিসাব ধরা হয়। জোরেশোরে টিকাদান চলমান থাকায় এবং জীবাণুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে থাকায়; এসব লক্ষ্যমাত্রা শুনতে যতটা অতি-সাহসী মনে হয়, আসলে ততোটা নয়। বরং, প্রত্যাশা অনুযায়ী ইতিবাচক ফল মিলতে পারে।
কিন্তু, তারপরও সরকারি ব্যয়ের নির্দেশিত গতি ধরে রাখতে হলে বছরজুড়ে অর্থায়নের সমস্ত দিক ঠিকঠাক চলতে হবে। বিশেষ করে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ফেডারেল রিজার্ভ যদি তাদের ক্রয়কৃত সম্পদের মাত্রা কমায়; তাহলে উদীয়মান অর্থনীতির বাজারে ঋণের খরচ বাড়বে। এতে করে ভারত অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরানোর জন্যে যথেষ্ট সময় পাবে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে 'স্বনির্ভরতা' তৈরি নিয়ে ভারতের রক্ষণশীল নীতি অব্যাহত রাখা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গাড়ি ও মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ আমদানির শুল্ক। এই নীতি উৎপাদন খাতের জন্যে সহায়ক হবে না। বিশেষ করে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানিগুলো, অথচ অর্থনীতির দ্রুত উত্তরণের জন্য তাদের ঘুরে দাঁড়ানোটা আবশ্যক।
ভারতের নগর কেন্দ্রগুলো যখন লকডাউনের আওতায় আসে, তখন শহর থেকে গ্রামীণ জনপদে ফিরে যান ৬ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক, যা ইতালির জনসংখ্যার সমান। নিজ এলাকায় ফিরে তারা কর্মসংস্থান সঙ্কটে পড়েন। সরকারি প্রকল্পে কম-মজুরির অস্থায়ী মজদুরির সুযোগও কমেছে ৩ কোটি ৪০ লাখ। বেকার হয়ে পড়া ভারতীয়দের এক-পঞ্চমাংশ ছিলেন উৎপাদন, পরিষেবা এবং নির্মাণখাতের কর্মী। তাদের অধিকাংশ এখন হয় কৃষি শ্রমিক হয়েছেন, না হলে বেকার বসে আছেন।
তবু বলতে হয়; মহামারির কল্যাণেই দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থাকা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য কিছু বিষয়ে সতর্ক হয়েছে ভারত। টিকার খরচ বাদ দিয়েও স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার কোটি ডলার। এই অর্থ স্বচ্ছ এবং কার্যকরভাবে খরচ করা যায় কিনা- সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মোদ্দা কথা; উচ্চ ঝুঁকির খরচ পরিকল্পনা সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের উপরে নির্ভর করবে সফলতা বা ব্যর্থতার দশা। 'ভি' আকৃতির উত্থান নিয়ে বন্ড বাজারের বিনিয়োগকারীরা আরও আশাবাদী হবেন নাকি পুঁজিবাজারের উচ্ছাস শঙ্কায় রুপ নেবে; নাকি উভয়ের বর্তমান প্রতিক্রিয়াই সঠিক প্রতিভাত হবে; সেটাও বলে দেবে সরকারের পদক্ষেপ।
- লেখক: অ্যান্ডি মুখার্জি ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- অনুবাদ: নূর মাজিদ