টিকা নেওয়ার সংকোচ কোভিডের বিরুদ্ধে অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে
সার্স কোভ-২ জীবাণুর বিস্তার পৃথিবীজুড়ে তৈরি করে আতঙ্ক। একদিকে মৃত্যুর মিছিল, আরেকদিকে জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় লকডাউন বিধিনিষেধে পড়ে অর্থনীতি, দেশে দেশে বেড়ে চলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য। কয়েক দশকের অতি-দরিদ্র্য নির্মূলে আসা অগ্রগতি এক লহমায় ছিনিয়ে নেয় মহামারি। সিংহভাগ মানুষের নজর কাড়ে তখন টিকা গবেষণার নানা সংবাদ। যুগান্তকারী কোনো প্রতিষেধক স্বাভাবিক জনজীবন ফিরিয়ে আনবে, দূর করবে অনিশ্চিয়তার ঝুঁকি, সেই আশাতে বুক বাঁধেন বিশ্ববাসী।
তাই যখন নানা দেশে আবিষ্কৃত কোভিড প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বাজারে আসে এবং টিকাদানে অনুমোদন লাভ করে তখন আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। উচ্ছাসের সঙ্গে টিকার মাধ্যমে মহামারিকে দূর করার আশা করা হয়।
বিভিন্ন দেশের জনসাধারণকে যখন: কে, কখন ও কোথায় গিয়ে টিকা নিতে পারবেন, এমন নীতিমালা জানানো হয়- তখনও ছিল সেই উদ্দীপনার জোয়ার। আবেগে অনেকে আবার উৎফুল্লও হয়ে পড়েন।
এমন একজন ব্রিটিশ নাগরিক ওই সময়ের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, "আমি প্রায় চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম, কেমন যেন মনে হচ্ছিল; আমার জীবন আবার নতুন করে শুরু হতে যাচ্ছে।"
তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা শুনে; ভয়, শঙ্কা এমনকি রাগ হওয়ার কথাও জানান কেউ কেউ।
এই সংকোচ, দ্বিধা আর ক্ষেত্রবিশেষে ক্রোধের উৎসই জানতে হলে, মহামারির প্রথম দিকের অবস্থায় একটু নজর দেওয়া দরকার।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সেসময় কেবল কোভিড টিকা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু, রেকর্ড সময়ে আবিষ্কারের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এসবের কার্যকারিতা কেমন হবে- তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই সন্দেহ পোষণ করেন। আগে থেকেই যারা সকল রোগে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, তারা যেন আরও বেশি অবিশ্বাসী হয়ে পড়েন কোভিড টিকার ব্যাপারে। তাদের কাছে কোভিডের মতো ভয়ঙ্কর রোগ ঠেকাতে প্রতিষেধকের ইঞ্জেকশন নেওয়া হয়ে পড়ে ছেলেভুলানো মিথ্যে আশ্বাস মাত্র। এই ধারণা শুনতে নেহাত 'বোকামি' মনে হলেও, প্রতিনিয়ত তাতে ঝড়ে পড়ছে অমুল্য প্রাণ।
অতীত সাক্ষী দেয় প্রমাণিত টিকা নিয়ে সন্দেহের রেশ কারো জন্যেই শুভ হয়নি। ২০১০ সাল থেকে জাপানে হিউম্যান প্যাপিলামোভাইরাস নামক একটি ত্বকের স্পর্শে ছড়িয়ে পড়া জীবাণুর বিরুদ্ধে সরকারিভাবে টিকাদান শুরু হয়। কিন্তু, জাপানি তরুণীদের একটি অংশের মধ্যে ছিল- তা নেওয়ার অনাগ্রহ। ফলে যারা টিকাটি নেন তাদের চাইতে- না নেওয়াদের মধ্যে মৃত্যুর হার বাড়ে।
বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিড-১৯ টিকা কর্মসূচির মধ্যেও অবিশ্বাসের ফলে অনেক জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে। শুধু যারা টিকা নেননি, তারাই নন; অন্যের মৃত্যুর কারণও হয়েছে তাদের সংকোচ।
২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) প্রধান ছিলেন স্কট গটলিয়েব। তিনি বর্তমানে ফাইজারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা সাম্প্রতিক এক মতামত কলামে তিনি জানান, খুব শিগগির যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহের সমস্যাকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে উঠবে প্রতিষেধক নেওয়ার অনীহা।
এই অবস্থা শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, অন্যান্য দেশেও কমবেশি চোখে পড়ছে। ব্রিটেনে যাদের টিকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাদের অন্তত ১৫ শতাংশ- তা প্রত্যাখান করেছেন। অথচ, ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশদের মধ্যে টিকাগ্রহণের আগ্রহ ছিল বেশ শক্তিশালী। কিন্তু, অনেক ব্যক্তির অনিচ্ছার কারণেই গত ১০ ফেব্রুয়ারি নাগাদ টিকা পেয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখ জন, যাদের সিংহভাগ বয়োবৃদ্ধ। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে সকলে টিকা নিলে সংখ্যাটি প্রায় ২০ লাখ জন বাড়তো।
সামাজিক সংস্পর্শ নিয়ন্ত্রণের বিধি-নিষেধ উঠে যাওয়ার পর এসব ব্যক্তি জীবাণুর নতুন ধারকে পরিণত হবেন। অর্থাৎ, তাদের মধ্যেই দেখা যাবে তুলনামূলক বেশি সংক্রমণ। জীবাণুও একটি প্রাণ। এবং নিজের জৈবিক অস্তিত্ব রক্ষা এবং বংশ বিস্তারের তাড়না থেকেই প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন তুলনামূলক দুর্বল ব্যক্তিকে শিকারে পরিণত করবে। আর এতে শুধু প্রাণহানি বাড়বে তাই নয়, জীবাণু অভিযোজনের সুযোগ পেয়ে এমন শক্তি অর্জন করতে পারে; যা টিকাগ্রহীতাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও কাবু করার সক্ষমতা অর্জন করবে।
অভিযোজনের এই ঝুঁকি কতোটা ভয়ঙ্কর- তা জানা যায় সাম্প্রতিক কালের প্রকাশিত দুটি সংবাদ থেকে। প্রথমটি হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া সার্স কোভ-২ জীবাণুর নতুন বংশজের বিরুদ্ধে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিষ্কৃত টিকার কার্যকারিতা খুবই কম। এতটাই কম যে তা জীবানুটির বিস্তার রোধ করতে পারছে না। যেকারণে, ভ্যাকসিনটি দেওয়া স্থগিত রেখেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় সংবাদ হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রায় চার হাজার নতুন ধরন শনাক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ, জীবাণুর বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধজয়ের প্রতিটি মুহূর্তই আরও মূল্যবান, এবং ব্যক্তি-বিশেষের দ্বিধা আরেক ব্যাপকতর মহামারির ভিত্তি রচনা করছে মাত্র।
বাংলাদেশেও অক্সফোর্ড আবিষ্কৃত টিকাটি দেওয়া হচ্ছে, তাই সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি কম নয়। বরং, জাতীয় পর্যায়ে প্রায় অদৃশ্য কোভিড টেস্ট- সার্বিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
তবে সংকোচের পুরোটাই অতি-উদ্বেগ আর অনাস্থার ফসল- তাও নয়। অনেক সময় সরকারি নীতির অস্বচ্ছতাও দায়ী। এই যেমন প্রতিবেশী ভারতের নিয়ামক সংস্থা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি প্রতিষেধকের অনুমোদন দেয়। কিন্তু, টিকাগ্রহীতাদের এদুটির যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এমনকি তারা কোন টিকাটি পেলেন- তা জানানো হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত কোভ্যাক্সিন- এ আস্থা না থাকায় তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী টিকাদানের অগ্রগতিও কম। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় সবার আগে টিকাদান শুরু করে দেশটি।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রায় ২৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও সরকারি নীতির কারণে টিকাগ্রহণ নিয়ে সংকোচ ও দ্বিধা দেখা যাচ্ছে।
মহামারির আগে থেকেই বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার সকল টিকা গবেষণার তথ্যে স্বচ্ছতা অবলম্বনের আহ্বান জানান। সরকারি টিকা কর্মসূচিকেও সুস্পষ্ট নীতির মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করেন তারা। কিন্তু, বিশ্বের অনেক দেশ সেই পথে হাঁটেনি। অবিশ্বাসের পাল্লা সেকারণেও ভারি হয়। কিন্তু, দিনশেষে সন্দেহ নিছক হোক বা সঙ্গত- তার কারণে টিকাদানের গতি মন্থর থাকলে, পুরো বিশ্বকে তার চড়ামূল্য দিতে হবে।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে