আমাদের প্রকাশনা শিল্প কি কোনোদিন পেশাদার ও প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠবে!
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান 'বিস্তার'র কথা এই পত্রিকার পাঠকদের অনেকেই জেনে থাকবেন। চলমান এই অতিমারিকালে আমাদের এই সংগঠনও অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতোই তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড এক পর্যায়ে অন্তর্জালে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেসবের মধ্যে জনপ্রিয়তম অনুষ্ঠানটির নাম 'পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন', যেটি মূলত একটি সাহিত্যকেন্দ্রিক আয়োজন, যেখানে প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান লেখককে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয় তাঁর সাহিত্যজীবনের গল্প, তাঁর সাহিত্যভাবনা এবং বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যায়নটুকু জানার লক্ষ্যে।
এ-পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটির ত্রিশটিরও বেশি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন প্রবীণ লেখক হাসনাত আবদুল হাই, শামসুজ্জামান খান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, আসাদ চৌধুরী, মনিরুজ্জামান, মনসুর মুসা ও সম্প্রতি প্রয়াত আবুল হাসনাত থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত তরুণতর প্রজন্মের লেখক আফসান চৌধুরী, শামীম আজাদ, মোরশেদ শফিউল হাসান, মাসুদুজ্জামান, হরিশংকর জলদাস, ওয়াসি আহমেদ প্রমুখ।
এঁদের প্রত্যেকের কাছেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প সম্পর্কে তাঁদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও একটি নির্মোহ মূল্যায়নের কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এঁরা সবাই একটি বিষয়ে একমত হয়েছিলেন যে, আমাদের প্রকাশনার জগতটি আর যা-ই হোক পেশাদার নৈব নৈব চ! অবশ্য বলাই বাহুল্য, কয়েকটি শ্রদ্ধেয়, বিরল ব্যতিক্রম বাদে।
অথচ এই শিল্পের বয়স তো নেহাৎ কম হলো না! স্বাধীনতা পূর্বকালের নাতিদীর্ঘ পর্বটির কথা যদি বাদও দিই, তবু তো তা খোদ এই বাংলাদেশেরই সমান বয়সী। অনেকেরই জানা থাকবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বইটি প্রকাশিত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে, কলকাতা থেকে। বইটির নাম 'জাগ্রত বাংলাদেশ', আর তার লেখক ছিলেন স্বয়ং আহমদ ছফা। বইটি প্রকাশ করেছিলেন, বলাই বাহুল্য, মুক্তধারা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা, যাঁর কাছে বাংলাদেশের লেখক, পাঠক, সর্বোপরি আমাদের গোটা প্রকাশনা শিল্পের ঋণ কোনোদিন শোধ হবার নয়। পুস্তকপ্রেমিক এই মহান মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম গ্রন্থটির প্রকাশকই শুধু নন, তিনি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া, অতুলনীয় অমর একুশে গ্রন্থমেলারও সাহসী স্বপ্নদ্রষ্টা।
এই দূরদর্শী মানুষই তো স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির মাঠে চাটাই পেতে বসে, একা একাই শুরু করে দিয়েছিলেন তাঁর একক বইমেলা, যা আজ পত্রে পুষ্পে পল্লবিত হয়ে বিশাল ও বিরল এক মহীরুহের আকার ধারণ করেছে, গোটা পৃথিবীতেই যার তুলনা পাওয়া ভার। 'বিস্তার'র সেই অন্তর্জাল অনুষ্ঠানটিতে আগত অতিথিদের প্রায় প্রত্যেকেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের পেশাদারিত্ব চর্চা প্রসঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে এই মানুষের নামোল্লেখ করে বলেছেন যে, তিনি প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে, তাঁর সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইয়ের লেখকদের বাড়ি বয়ে গিয়ে তাঁদের বই বিক্রির হিসাব এবং পাওনা রয়ালটির টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আসতেন।
এখানে তাহলে এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত হবে না যে, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সদ্যপ্রতিষ্ঠিত একটি প্রকাশনা সংস্থা যদি তার একেবারে গোড়াপত্তনের মুহূর্ত থেকেই এরকম পেশাদারি আচরণ করে থাকতে পারে, তাহলে তার পঞ্চাশ বছর পরে আজও কেন দেশের সিংহভাগ প্রকাশনা সংস্থাতেই এই চর্চার এমনতর অভাব পরিলক্ষিত হবে?
এর উত্তর একটাই। মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা পুস্তক প্রকাশনার বিষয়টিকে নিছক ব্যবসা কিংবা স্রেফ চটজলদি অর্থোপার্জনের উপায় হিসাবে নয়, একটি সত্যিকারের শিল্প ও পেশা হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জানতেন, যেকোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগকে শিল্প হিসাবে সফল করে তুলতে হলে সামষ্টিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগ ব্যবস্থার কিছু নিয়ম-কানুন; সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন-ব্যবস্থাপনা; বিজ্ঞাপন ও বিপণন কৌশলের পাশাপাশি ন্যূনতম কিছু নীতিনৈতিকতাও মেনে চলতে হয়। বিশেষ করে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান-সম্পৃক্ত সকল অংশীজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষা, তাদের প্রাপ্যটুকু যথাসময়ে ও যথাসাধ্য পরিশোধ করা, এবং তাদের সঙ্গে হওয়া লিখিত-অলিখিত চুক্তিসমূহকে সম্মান ও পালন করাটুকুও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়েও তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সেইসঙ্গে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রতিও তাঁর ছিল অকৃত্রিম অনুরাগ ও অঙ্গীকার।
একাত্তর সালে কলকাতায় থাকাকালীন তিনি সেখানকার প্রকাশনা শিল্পটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিলেন বাংলা ভাষার বিখ্যাত সব সাহিত্যিকের সঙ্গে। সেই তখন থেকে তাঁর মনেও নিশ্চয়ই এই স্বপ্ন দানা বাঁধছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে তার সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরাও সমান মর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে এবং তাঁদের প্রাপ্য সেই সম্মান ও সম্মানীটুকুর নিশ্চয়তা দিতে সেখানেও দ্রুত গড়ে উঠবে একটি সত্যিকারের পেশাদার ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রকাশনা শিল্প।
তাঁর সেই সুন্দর স্বপ্নের বিপরীতে বর্তমান বাস্তবতাটুকু বড়ই করুণ ও শোচনীয়। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতটি গত পঞ্চাশ বছরে গায়ে গতরে বেশ বড়সড় হয়েছে সন্দেহ নেই। এখন তো মনে হয় হাজারের ওপর আমাদের প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা, ফি-বছর বইও প্রকাশিত হয় হাজারে হাজার, কিন্তু গুণে ও মানে এই শিল্প যে-তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে আজও; ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থার আরও অবনতিই বুঝি হয়েছে। পেশাদারিত্বের চর্চার অভাব আর প্রকৃত লেখকদের দুরবস্থার কথা না হয় বাদই দিলাম।
লজ্জার মাথা খেয়ে আপাতত নিজের কথাই কিছু বলি। গত তিরিশ বছরে এই অধমের মতো সামান্য লেখকেরও নয় নয় করে কুড়িটিরও অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, কোনো কোনোটির আবার একাধিক সংস্করণও হয়েছে, যেগুলো প্রধানত বিশ্বসাহিত্যের তাবড় তাবড় লেখকদের অনুবাদ বিধায় তাদের বিক্রিবাটাও নেহায়েত মন্দ হয়নি। তো, এই বইগুলোর অধিকাংশেরই প্রকাশক বাংলাদেশের মূলধারার প্রকাশনা শিল্পের সামনের সারির কয়েকটি সংস্থা, প্রকাশনা সাম্রাজ্যে যাদের অবস্থান ও অর্জন একেবারে ফেলনা নয়। অথচ এই লেখকের সঙ্গে প্রকাশনাপূর্ব চুক্তি করেছে তাদের মধ্যে হাতেগোনা মাত্র তিনটি কি চারটি প্রতিষ্ঠান; তবে সেই চুক্তির সত্যিকার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, সেই তথ্য না হয় এখানে উহ্যই থাক।
আর লেখকসম্মানী? তা সেটিও জুটেছে বইকি! এই লেখা লিখতে গিয়েই হিসেব করে দেখলাম, গত কুড়ি বছরে কুড়িটি বইয়ের জন্য গুনে গুনে পাক্কা কুড়িটি হাজার টাকা জুটেছে এই লেখকের বরাতে!
তা, এই যদি হয় আমাদের প্রকাশনা শিল্পের বাস্তবচিত্র, তাহলে এই দেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের কতটা উৎকর্ষ ও উন্নয়নই আর আমরা আশা করতে পারি! একদিকে বিশ্বায়ন ও অন্যদিকে পণ্যায়নের যুগে আমাদের ভূ-বাস্তবতা যে এখন পুরোটাই পাল্টে গেছে। জীবনযাপনের চাপ ও চাহিদা বেড়েছে বিপুলভাবে। সংসারের সর্বক্ষেত্রেই কঠিন প্রতিযোগিতা ও পার্থিব প্রয়োজনের রক্তচক্ষুর উপস্থিতি। এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় আর সবকিছুর মতোই, শিল্প-সাহিত্যের অবসরকালীন চর্চা কিংবা সৌখিন মজদুরির কোনো ভবিষ্যৎ নেই কোথাও। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, দিনে দিনে বিস্তৃত হওয়া বাংলাদেশের আজকের সাহিত্য অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা অনেক মেধাবী, পরিশ্রমী, দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল লেখকের দেখা পাচ্ছি, যারা লেখালেখিকে তাদের পূর্ণকালীন পেশা ও কাজ হিসাবে বেছে নিতে পারলে, একটু সুস্থিরচিত্তে, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ব্যতিরেকে লিখতে সক্ষম হলে, আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডারে অনেক স্বর্ণশস্যই ফলতে পারত।
আর এর জন্য সামাজিক স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, বাংলা একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানসমূহের আন্তরিক সহযোগিতার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সবার সম্মিলিত উদ্যোগে দেশে একটি সত্যিকারের পেশাদার প্রকাশনা শিল্প গড়ে তোলা। তা না হলে আমাদের প্রিয় ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যত উচ্ছ্বাস আর যত গর্বই আমরা করি না কেন, সেটি স্রেফ একটি অবিকশিত, আঞ্চলিক ও প্রান্তিক সাহিত্যস্রোত হিসাবেই রয়ে যাবে; বিশ্বের মানচিত্রে তার কোনো দৃশ্যমান ও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হবে না কখনো।
সবশেষে একটি আশার কথা বলি। ইদানিং বাংলাদেশে বেশ কিছু শিক্ষিত, উদার, আধুনিক, সাহিত্যমনস্ক ও শিল্পরুচিসম্পন্ন তরুণ-তরুণীকে প্রকাশনাকর্মে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। এটি আমাদের প্রকাশনা শিল্পের জন্য নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক লক্ষণ। কেননা এই তরুণেরা আপাতদৃষ্টিতে কোনো সংকীর্ণ বৈষয়িক বিবেচনায় নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি সত্যিকার দরদ ও ভালোবাসার টানেই এই কাজে ব্রতী হয়েছেন। একজন সমমর্মী লেখক ও সাহিত্যকর্মী হিসাবে, তাঁদেরকে প্রকাশনার এই মহতী কাজকে যথাসম্ভব পেশাদারিত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার সনির্বন্ধ আহবান জানিয়ে এবং সেইসঙ্গে কয়েকটি অযাচিত পরামর্শ প্রদান তথা দশটি অনুশাসনের উল্লেখ করে এই লেখার ইতি টানছি।
এক. প্রকাশনাকর্মকে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসাবে গ্রহণ করা।
দুই. শুরুতে প্রকাশনা সংস্থার কলেবর একটু সীমিত রেখে অল্প ক'টি বই দিয়ে শুরু করা এবং ধীরে ধীরে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো।
তিন. প্রতিটি আর্থিক বিনিয়োগের আগে ভালো করে তার যাথার্থ্য ও যৌক্তিকতা যাচাই করা।
চার. প্রকাশিতব্য গ্রন্থ নির্বাচনের আগে একটি প্রাজ্ঞ পরিষদ কর্তৃক তাদের বিপণন-সাফল্যের সম্ভাব্যতা যাচাই করে নেওয়া।
পাঁচ. কখনোই কারও অনুরোধ-উপরোধে কোনো বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত না নেওয়া।
ছয়. বই প্রকাশের পূর্বে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে লেখকের সঙ্গে একটি আইনসম্মত চুক্তি করা।
সাত. লেখকের পাণ্ডুলিপিটি একজন ভালো ও পেশাদার সম্পাদককে দিয়ে সম্পাদনা করিয়ে নেওয়া।
আট. বই প্রকাশিত হবার পর সাধ্যমতো তার আলোচনা-প্রচারণা-বিজ্ঞাপনের উদ্যোগ নেওয়া।
নয়. অন্তর্জাল, সামাজিক মাধ্যম ও ই-বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিপণনের উদ্যোগ নেওয়া।
দশ. লেখককে বছরে অন্তত একবার বই বিক্রির সঠিক হিসাব ও সেই অনুযায়ী তাঁর প্রাপ্য সম্মানীটুকু বুঝিয়ে দেওয়া।
- লেখক: সাহিত্যিক ও অনুবাদক