করোনার ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি প্রকাশনা শিল্প
বেশিরভাগ শিল্প খাত করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের ধারায় ফিরেছে। তবে প্রকাশনা শিল্প, বিশেষত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
২০২০ সালের মার্চে দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর মহামারির প্রভাবে প্রকাশকদের ব্যবসা একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়। এমনকি গত বছরের বইমেলাও তারা ঠিকমতো করতে পারেননি। অথচ প্রকাশকদের বছরের মোট আয়ের একটা বড় অংশই আসে বইমেলা থেকে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুসারে, বেশিরভাগ প্রকাশনা সংস্থাগুর মালিকই এখন অর্থ সংকটে ভুগছেন। অর্থাভাবে তারা ২০২২ সালের জন্য নতুন বই প্রকাশনার কাজ শুরু করতে পারছেন না।
তার ওপরে প্রকাশকরা আশঙ্কা করছেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরোদমে না-ও খুলতে পারে। এতে এ বছরের ব্যবসা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, প্রকাশকদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আরও কমে যাবে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রকাশনা সংস্থার মালিকেরা তাদের পুঁজি হারিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই এ বছর নতুন বই ছাপতে পারছেন না।'
তিনি আরও বলেন, 'হ্যাঁ, ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে আমাদের অবশ্যই নতুন বই ছাপতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো অবস্থায় আমরা নেই। বই ছাপার কাজ শুরু করতে হলে প্রকাশকদের ঋণ নিতে হবে।'
শ্যামল পাল আরও বলেন, ফের ব্যবসা শুরু করার জন্য তাদের মহামারিপূর্ব সময়ের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ টাকার প্রয়োজন। কারণ বই ছাপার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এবং শ্রমের খরচও আগের চেয়ে বেরে গেছে।
মহামারির আগে প্রতি টন কাগজের দাম ছিল ৩৫ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫২ হাজার টাকা। প্লেট প্রতি খরচ ১৪০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা এবং প্রতি কেজি বাইন্ডিংয়ের আঠার দাম ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি জানিয়েছে, তাদের সদস্যসংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। এর মধ্যে ৩ হাজার প্রকাশক ঢাকাভিত্তিক, তাদের কর্মীসংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি কর্মী। সব সদস্য মিলে প্রতিদিন ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা লোকসান গুনছেন।
এ পর্যন্ত প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (পিয়াব) লোকসানের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি লোকসান দিয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি।
অনিক প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাহতাব উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মহামারির কারণে তিনি পুঁজি হারিয়েছেন। এখন নতুন বই ছাপার জন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
পিয়াবের তথ্যানুসারে, বই ও অন্যান্য উপকরণ ছাপানোর কাজ সাধারণত প্রতি বছর জানুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ শতাংশ ছাপার কাজ হয়েছে।
পিয়াবের সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কিছু ছাপাখানা এখন সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের বই ছাপতে ব্যস্ত।
তিনি বলেন, 'কিন্তু বেসরকারি প্রকাশকরা এখনও ছাপার কাজ পুরোদমে শুরু করতে না পারায় বেশ কিছু ছাপাখানা এখন অলস বসে আছে।'
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দুটি বইমেলা করতে না পেরে সৃজনশীল প্রকাশকরা বিপুল লোকসান গুনেছেন।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আসন্ন অমর একুশে বইমেলার আশায় বসে আছি। কোনো কারণে মেলা না হলে আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।'
শ্যামল পাল জানান, তাদের সমিতি সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছিল, কিন্তু তাদের অনুরোধে সাড়া দেওয়া হনি।
তিনি বলেন, 'আমরা চাই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসের জন্য আমাদের বই কিনুক। এই শিল্পের টিকে থাকার জন্য এটা একটা বড় সাহায্য হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।'