ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে আরো কিছু তথ্য
গত ২৭ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব-এ ভাষা আন্দোলনে অন্যতম অংশগ্রহণকারী তৎকালীন সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক আবদুল গফুর 'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: কিছু বিভ্রান্তিকর প্রচারণা' শীর্ষক একটি লেখায় '৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বদানের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনায় তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে 'একটি বিশেষ মহলের'বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখাটি মূলত স্মৃতিনির্ভর; ফলে দু' একটি তথ্যগত ভুল রয়ে গেছে। যেমন '৫২ সালে শেখ মুজিবের মুক্তির তথ্যটি।
গফুর সাহেব উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিব '৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেল থেকে মুক্তি পান।
দু'বছর আগেও ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য ('৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে) বদরুদ্দীন উমরের মতো একজন শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক কর্মীকে সরকারি দলের সমর্থকদের কাছ থেকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের লেখাটির পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কিছু লেখা, বক্তব্য, এমনকি জনসমাবেশও হয়েছে।
তাছাড়াও ১৫ এপ্রিল ১৯৯৮-এর হলিডেতে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী লন্ডন প্রবাসী আমীর আলীর লেখাটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা মূল্যায়ন সংক্রান্ত সবগুলি লেখাতেই কিছু তথ্য বিভ্রান্তি রয়ে গেছে।
ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকার মূল্যায়ন নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে মন্তব্য করা প্রয়োজন মনে করে এবং ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা বাড়ানোই আজকের লেখার উদ্দেশ্য। বিশেষ করে গত বছর ১৫ এপ্রিল '৯৮-এর হলিডেতে '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী লন্ডন প্রবাসী আমীর আলীর লেখাটি আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে।
আমীর আলী তাঁর লেখায় দেশ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের মন্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উমরকে ইতিহাসের ওপর জোর দিতে বলেছেন। আমীর আলীর মনে হয়েছে বদরুদ্দীন উমর ইতিহাসকে রাজনীতির চোখে দেখেন আর রাজনীতিকে ইতিহাসের মতো করে উপস্থাপন করেন। উপদেশটি বদরুদ্দীন উমরের জন্য অনাবশ্যক মনে হয়েছে আমার কাছে। তবে পাঠক হিসেবে আমীর আলী এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতেই পারেন। অনাবশ্যক বলেছি এই কারণে যে, বদরুদ্দীন উমরের দর্শনই হচ্ছে ইতিহাসের সকল ঘটনার মধ্যে রাজনীতির নির্ধারক ভূমিকাকে স্পষ্ট করা। তাঁর লেখার সাথে যারা পরিচিত তারা তাঁর অবস্থান খুব ভালো করেই জানেন। যে মার্কসীয় রাজনীতির তিনি ধারক ও বাহক সেই রাজনীতি নিয়ে তাঁর সাথে বিতর্ক করা যেতে পারে। তবে তাঁর লেখায় সে দর্শন স্পষ্ট হবে না এটা আশা করা ঠিক না।
বদরুদ্দীন উমর মার্কস ও লেনিনের পলিটিক্যাল স্টাইল অনুসরণ করতে চেষ্টা করেন। শ্লেষাত্মক, তির্যক বক্তব্যে বিরোধী মতকে ধরাশায়ী করতে চান। আমাদের উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতিতে এ ধরনের চাঁছাছোলা বক্তব্য অনেক সময় অস্বস্তির সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র বক্তব্য বলার ধরনেই তিনি অনেক পাঠক হারাতে পারেন, যাদের হয়ে আমীর আলী উৎকণ্ঠাটি ব্যক্ত করেছেন।
বদরুদ্দীন উমর হয়তো বলবেন পাঠক মনোরঞ্জনের জন্য তিনি লেখেন না, তিনি রাজনীতির জন্য লেখেন। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এখানেই শেষ করে আমি আমার মূল বিষয়ে চলে যাই এবার।
বদরুদ্দীন উমরের উল্লিখিত লেখাটি নিয়ে যে নাটক করেছে সরকারি দল, তা না করলেই ভালো হতো। মুজিবকে বড় করতে যেয়ে যে ছোট করা হয় কোনো কোনো সময় তা পদকলোভী বুদ্ধিজীবীরা, তোষামোদকারী আমলারা আর গদি আগলানো মন্ত্রীরা প্রায়ই ভুলে যান। সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত তা কেবল ঈশ্বরই বলতে পারেন। কিন্তু সেটা যেভাবেই ঘটুক, এর ফলে যে মানুষটি একজন প্রতিবাদী তরুণ থেকে অনেক নিপীড়ন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর ভুলের জন্য চূড়ান্ত মূল্য দিয়ে গেছেন, তাঁকে নিয়ে অনাবশ্যক টানাহেঁচড়া শুরু হয়। পদকশোভিত বুদ্ধিজীবীরা দুটো বিষয় খেয়াল রাখলে ভালো হবে, সে দুটো হচ্ছে: এক, বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ একমাত্র জাতিরাষ্ট্র যা কি না মাত্র সিঁকি শতাব্দীর মধ্যে আর একটি উপনিবেশোত্তর জাতিরাষ্ট্র অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে সৃষ্টি হয়েছে। দুই, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের অনেকেই পূর্বোক্ত পাকিস্তান জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অনেক নেতার রাজনৈতিক ভূমিকা আলোচনায় এ বাস্তবতা বেশ জটিলতা সৃষ্টি করে। যদি এমন হতো যে একেবারেই নতুন একটি প্রজন্ম বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, তাহলে সেই প্রজন্মের নেতাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা এ ধরনের জটিলতা মুক্ত হতো। ব্যাপারটি সেভাবে ঘটেনি।
পাকিস্তান আন্দোলনের পেছনে যে রাজনীতি সক্রিয় ছিল সেটা উপমহাদেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। এই রাজনীতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণরা পূর্ব বাঙলার মানুষদের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে রাজি ছিলেন না। বিশেষ করে সংখ্যা ও রাজনৈতিক সচেতনতার দিকে যাঁরা ছিলেন পাকিস্তানের যে কোনো অঞ্চলের জনগণের চেয়ে অগ্রগামী। ফলে পূর্ব বাঙলার রাজনৈতিক ভাগ্যনিয়ন্তাদের সঙ্গে সেসব তরুণের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, যদিও সেই সংঘর্ষের ভাষা শক্তি সঞ্চয় করতো পাকিস্তান আন্দোলনের ন্যায্যতা থেকে।
যদি কেউ '৪৭-এর আগস্ট থেকে পূর্ব বাঙলার প্রতিবাদী আন্দোলনের ভাষা লক্ষ করেন, বিশেষ করে '৫২-এর পর ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভ্রুণের শারীরিক অবয়ব বৃদ্ধির ব্যাপারটা খেয়াল করেন, তা হলে দেখবেন তার সেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শরীরে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জন্মদাগ জ্বলজ্বল করছে।
কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাঙালী জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভূমিকা নির্ধারণ করতে গিয়ে '৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকেই তাদের বাঙালী জাতীয়তাবাদী বানানোর দরকার নেই। অর্থাৎ সেটা বানাতে গিয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণকে যদি কাটছাঁট করা হয় অথবা নতুন সাক্ষ্য-প্রমাণ তৈরি করতে হয়, তাহলে দলীয় কর্মীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ইতিহাসের ঘরে তার প্রবেশানুমতি মিলবে না।
সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ২০ বছর আগে এক বক্তৃতায় শেখ মুজিবকে উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা বলেছেন; কারণ তিনিই একমাত্র নেতা যিনি জনগণের একজন ছিলেন এবং জনগণের খুব কাছে অবস্থান করতেন, যা কি না গান্ধী কিংবা জিন্নাহ করেননি। গান্ধী খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছেন কিন্তু জনগণের কাছে তিনি ছিলেন 'দেবতা'- অনেক দূরের এক মহামানব। আর জিন্নাহ তো জনগণের ছায়াও মাড়াতে চাইতেন না; যদিও তিনি ভারতীয় মুসলমান জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা ছিলেন।
শেখ মুজিবের এই অবস্থান স্মরণে রেখেও মনে রাখতে হবে, সাধারণ বাঙালীর অনেক দুর্বলতাও তাঁর মধ্যে ছিল। তাঁর কৃতিত্ব দেখাতে গিয়ে সেই দুর্বলতাগুলি অস্বীকার করে তাঁকে অসাধারণ করতে গিয়ে হাস্যকর করার অপচেষ্টা যদি 'পদকভূষিত' বুদ্ধিজীবীরা না করেন তা হলে বাঙালী জাতির হয়ে ওঠার ইতিহাসে তারা আরো একটু কম ভেজাল মেশাবেন।
শেখ সাহেব দোষগুণেই জনগণের অনেক কাছাকাছি ছিলেন। নিরেট নিখুঁত মহামানব হয়ে তিনি জন্মাননি। তিনি ইতিহাসের এক প্রয়োজনীয় জায়গায় প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অন্যদের আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা তিনি নিয়েছিলেন। এটাই তাঁর গুণ। এই ভূমিকা লেখার প্রয়োজন হলো এই কারণে যে, আমার বক্তব্যটা বোধগম্য করা তাহলে সহজ হবে।
বদরুদ্দীন উমর '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবের ভূমিকা নিয়ে একটা বক্তব্য রেখেছেন। বক্তব্য রেখেছেন এই কারণে যে (তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী) শেখ সাহেব '৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থেকে বন্দি অবস্থায় তিনি চিরকুটের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উমর সাহেব তাঁর বিশিষ্ট ভঙ্গিতে দাবিটি নস্যাৎ করতে চেষ্টা করেছেন দেশ পত্রিকায় লেখা একটি নিবন্ধের মাধ্যমে। বাকি ঘটনা পাঠকরা জানেন ধরে নিয়ে আমি ওর মধ্যে যাচ্ছি না। এরপর বিভিন্ন কাগজে বেশ কিছু লেখা এসেছে। তাতে উমর সাহেবকে বকাঝকা করা হয়েছে; আবার অনেকে তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়ে উমর সাহেবকে সমর্থন করেছেন।
বদরুদ্দীন উমরের লেখাটাকে 'হত্যা' করে সরকার নিঃসন্দেহে ভুল করেছে। এ ধরনের ভুল আমলানির্ভর সরকার সবসময়ই করে থাকে। বদরুদ্দীন উমরের লেখার প্রতিবাদে দুটো কাজ করা যেত; এক, বদরুদ্দীন উমরের লেখায় যদি কোনো তথ্য ভুলভাবে পরিবেশিত থাকে তাকে সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে খারিজ করা, দুই, শেখ মুজিবুর রহমান আদৌ এটা বলেছেন কি না সেটা খোঁজ করা এবং যদি বলেও থাকেন তবে সেটার পক্ষে তথ্য প্রমাণ যদি না থাকে তাহলে তিনি হয়তো সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারেননি এ কথাটা তার পক্ষ হয়ে বলা। এর বাইরে কোনো পদ্ধতিই বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যকে নাকচ করতে পারবে না।
আমীর আলীর হলিডে'র লেখায় যে তথ্যটি বেরিয়ে এসছে সেটি হলো যে শেখ মুজিবুর রহমান '৫২-এর ২০ বা ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেন্ট্রাল জেল বা হাসপাতালে ছিলেন না। এটি একটি তথ্য যেটি প্রমাণিত হলে ২১ ফেব্রুয়ারি বা তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কয়েকদিনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক করার আর কোনো মানে হয় না। এ কারণে আমাদের দুটো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা উচিৎ: এক, যখন ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয় তখন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, না জেলে বা কোন জেলে? ঢাকায় না অন্য কোনোখানে? দুই, তিনি কত তারিখে মুক্তি পান?
বদরুদ্দীন উমর প্রথম প্রশ্নের তথ্যের দিকে নজর দেননি। আমীর আলী ২২ ফেব্রুয়ারি জেলে গিয়ে জেল সুপারের কাছে জানতে পারেন যে, শেখ মুজিবকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেল থেকে ঢাকার বাইরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কোথায়? আমীর আলী বলেননি। আমীর আলীর দ্বিতীয় তথ্যটি তৎকালীন দৈনিক ইনসাফের রিপোর্টভিত্তিক যাতে বলা হয়েছিল শেখ মুজিবকে ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কোন জেল থেকে, উল্লেখ করা হয়নি। তারিখটি কি সঠিক?
ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে দলিলটি ব্যবহার করবো সেটি হচ্ছে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাপ্তাহিক পত্রিকা ইত্তেফাকের ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ও ৫ মার্চের ইস্যু দুটি। তখন সম্পাদক ছিলেন তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী) এবং প্রকাশক ছিলেন ইয়ার মহম্মদ খান। ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ৯ হাটখোলা রোডে অবস্থিত প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে মুদ্রিত হতো এবং ট্যাবলয়েড আকারে ৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হতো।
১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাকের ৭নং পৃষ্ঠায় 'মজিবরের মুক্তিদাবীতে ভাষানী' (লক্ষণীয় ভাসানী বানান একই পত্রিকায় 'স' ও 'ষ' ব্যবহার হতো, এবং মুজিবুর ও মজিবর লেখা হতো) শীর্ষক একটি খবর ছিল। মওলানার বক্তব্যটি আমি হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, 'আমি জানিতে পারিয়াছি যে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে নিরাপত্তাবন্দী শেখ মজিবর রহমান ও মহীউদ্দিন আহমদ অনশন ধর্মঘট করিয়াছেন। জনসাধারণ অবগত আছেন যে, শেখ মুজিবর রহমান দীর্ঘদিন হইতে মারাত্মক রোগে ভুগিতেছেন এবং কিছুদিন পূর্বে চিকিৎসার জন্য তাহাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। কিন্তু তাহাকে রোগমুক্তির পূর্বেই আবার জেলে প্রেরণ করা হয়...।'
মওলানা ভাসানীর বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শেখ মুজিব ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অন্তত জেলে ছিলেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারির আগেই তিনি ঢাকা মেডিকেল থেকে জেলে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। তাহলে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের নিকট অতীত বা আন্দোলনের সময় তিনি হাসপাতালে ছিলেন না।
২১ ফেব্রুয়ারি তিনি কোথায় ছিলেন এবং কবে মুক্তি পান প্রসঙ্গে ইত্তেফাকের ৫ মার্চের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ঐ তারিখে প্রকাশিত ইত্তেফাকের ৪নং পৃষ্ঠায় 'শেখ মজিবর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তিলাভ' শীর্ষক খবরে লেখা হয়, 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারী শেখ মুজিবর রহমান বিগত ২৬শে ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল হইতে মুক্তিলাভ করেন। জনাব রহমান ১৯৫০ সালে নিরাপত্তা আইনে বন্দী হন।... মুক্তি পাইয়াই জনাব রহমান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসে তার যোগে খবর পৌঁছান এবং ঢাকার শোচনীয় দুর্ঘটনার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি স্বাস্থ্যের কারণে বর্তমানে তার গ্রামের বাড়ীতে অবস্থান করিতেছেন।'
ইত্তেফাকে অবশ্য উল্লেখ নেই কবে তাকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। তবে তার মুক্তির তারিখটি ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। তবে ২১ ও পরবর্তী ঘটনাবলির কথা মনে রাখলে অনুমান করা যায় তাঁকে ২১ তারিখের আগেই ফরিদপুরে স্থানান্তরিত করা হয়; তবে সেটা ১৬ তারিখে অনশনের আগে, না আমীর আলীর মতে ১৮ তারিখে অনশনরত অবস্থায় সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ফরিদপুর স্থানান্তরের তারিখের জন্য জেলের কাগজ দেখা যেতে পারে। তবে এটা নিশ্চিত তিনি ২১-এর নিকটবর্তী কোনো তারিখে অন্তত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন না। ঐ সময়ে ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁর ফরিদপুর জেলেই থাকার কথা।
২১ তারিখের আন্দোলনের নেতৃত্বে না থাকলেও ভাষার প্রশ্নে তিনি বাঙলা ভাষার পক্ষে ছিলেন এটা প্রমাণ করার মতো ঐতিহাসিক দলিলও আছে। সে বিষয়ে তর্ক তোলার কোনো প্রয়োজন নেই। ২১ তারিখের আন্দোলনের সময় তিনি জেলে ছিলেন এবং ঢাকার বাইরে ছিলেন- এটাই ঐতিহাসিক তথ্য। তথ্য বিকৃতি ঘটানো ছাড়াই বাঙলা ভাষার জন্য শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রমাণ করা যায়।
- লেখক: ইতিহাসবিদ ও গবেষক
[প্রকাশিত বই 'কালের কল্লোল' থেকে]