কালুরঘাট নতুন সেতু: ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে চলে গেলেন এমপি বাদল
“দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আছেন। তার মধ্যে আমি হচ্ছি, বলাউল্লাহ। কালুরঘাট নতুন সেতু নিয়ে বারবার শুধু বলেই যাচ্ছি, কোনো কাজ হচ্ছে না। কালুরঘাট নতুন সেতুটির জন্য আমি এলাকায় মুখ দেখাতে পারি না। মানুষ আমার মরা মা তুলে গালি দেন। আমি এটা আর সহ্য করবো না। যদি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কালুরঘাট সেতুর কোনো সুরাহা না হয়, তাহলে আমি এ সংসদ থেকে পদত্যাগ করবো।”
কিন্তু সংসদ থেকে পদত্যাগের আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মাঈনুদ্দিন আহমদ খান বাদল।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের বাজেট আলোচনায় এমপি বাদল এসব কথা বলেন। দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ এ সংসদ সদস্য বৃহস্পতিবার ভোরে ভারতের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বস্তরে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার জীবদ্দশায় কালুর ঘাট নতুন সেতু দেখে যেতে না পারার জন্য সরকারের প্রতি আক্ষেপ করেছেন অনেকে।
বাদলের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে তার। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে বাদল ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা মৃত আহমদ উল্লাহ খান এবং মাতা মৃত জতুমা বেগম।
সংসদ সদস্য বাদলের চাচাতো ভাই মো. সাইফুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত মাসের ১৮ অক্টোবর চিকিৎসার জন্য ভারতের বেঙ্গালোরোতে যান। হার্টের সমস্যা ছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, “কালুর ঘাট নতুন সেতুর জন্য দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসলেন তিনি। কিন্তু জীবদ্দশায় আর দেখে যেতে পারলেন না তিনি।”
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন বাদল। চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসন থেকে তিনি তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে খ্যাতি পান তিনি।
ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা বাদল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বাঙালিদের ওপর আক্রমণের জন্য পাকিস্তান থেকে আনা অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে খালাসের সময় প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন বাদল।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাদল সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। জাসদ, বাসদ হয়ে পুনরায় জাসদে আসেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনেও বাদলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
বাদলের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলন চট্টগ্রাম মহানগরীর বীরযোদ্ধা মোহাম্মদ হারিছ।
তিনি বলেন, “বাদলের মৃত্যু আমাদের শোকাহত করেছে। অসময়ে তার এ চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধে আমরা এক সাথে যুদ্ধ করেছি। সে ছিল খুবই সাহসী। সব কিছুতেই আগে থাকতো সে। এখন বার বার সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।”
এমপি বাদলকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
তার ভেরিফাইড পেইজে তিনি লিখেন-বাদলের মৃত্যুতে “আবারও পিতৃহারা হলাম। দুবছর আগে হঠাৎ স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়েছিলেন যখন, তখন তার বন্ধু মহিউদ্দিন চৌধুরীও গুরুতর ভাবে অসুস্থ, হাসপাতালে। খুব আফসোস করতেন বন্ধুকে দেখে যেতে পারেন নাই। অশ্রু সজল নয়নে স্মরণ করতেন। আজ থেকে আমরা তাকে স্মরণ করবো।”
চট্টগ্রামের স্বার্থে বাদল আপোষহীন ছিলেন মন্তব্য করে তিনি লিখেন, “চট্টগ্রামের স্বার্থে, মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে কোথায় ছিল না তার গর্জন? প্রথম তার সঙ্গে আমার পরিচয় শৈশবে। এরশাদের দোর্দন্ড শাসনের সময়। তৎকালীন পিজি হাসপাতাল, আজকের বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের রাজবন্দীদের কক্ষে। আমার বাবার প্রিজন সেলের সহবন্দী ছিলেন। এরশাদের সঙ্গে আপস করে মন্ত্রী হতে পারতেন, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন বন্দী জীবন।”
নওফেল আরো লেখেন, “আমাকে সমাজতন্ত্র শেখাতেন, দেখতেও ছিলেন স্ট্যালিনের মত, ইম্পোজিং ব্যক্তিত্ব। আমার বাবার সঙ্গে হাস্যরস আর গভীর রাজনৈতিক আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। মন্ত্রমুগ্ধের মত তার কাছ থেকে শুনতাম। পরবর্তীতে যখনই দেখা হতো, প্রতিবার তার কাছ থেকে শিখেছি।’ বাংলাদেশের রাজনীতি আরও একজন বিরল প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদকে হারালো। এ এক অপূরনীয় ক্ষতি। জাতীয় সংসদ আর জাতীয় রাজনীতি, হয়তোবা এই সিংহের গর্জন আর শুনবে না। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, আদর্শিক রাজনীতির এই সিংহ পুরুষকে আজীবন স্মরণ করবেন। বেঁচে থাকবেন আমাদের প্রিয় মাঈনুদ্দিন খান বাদল, আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায়।”
২০১২ সাল থেকে কালুরঘাট নতুন সেতুটি নিয়ে চারটি দেশের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা চালিয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকার দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। বাকি টাকার যোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। অর্ধযুগ পার হলেও নতুন সেতুর এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট রেল কাম সেতুটি জরাজীর্ণ হওয়ায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবং বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় প্রস্তাবিত চীন, মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং কর্ণফুলী নদীর ওপর পুরানো কালুরঘাট রেলসেতু ভেঙে নতুন করে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ সেতুটি সরকারের মেগা প্রকল্প দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইনের অন্তর্ভূক্ত।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাট কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল কাম সড়ক সেতু নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে ঢাকার রেলভবন কার্যালয়ে পাঠায়। পরে সেটি যাচাই-বাছাই শেষে কয়েক দফা পুনর্গঠন করে চলতি বছরের ২৭ মার্চ সংশোধিত ডিপিপি রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে এমপি বাদলের সাবেক প্রেস সেক্রেটারি আলম দিদার বলেন, “ভারতে যাওয়া আগেও আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখন বলেনছিলেন, কালুর ঘাট সেতু তো হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী ও সেতু মন্ত্রীর সাথে আমি দেখা করে কথা বলেছি। দ্রুত কাজ শুরু করবে বলে তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছে। আফসোস হচ্ছে তিনি আর সেতু দেখে যেতে পারবেন না।”