লাখো মানুষের জীবনরক্ষাকারী এক আবিষ্কার
আমরা আজ ইনসুলিন আবিষ্কারের শততম বছরে পা রাখতে চলেছি। অথচ জীবনরক্ষাকারী জাদুকরি এই বস্তুর মূল্য এখনো বেশি। বিশ্বের তিনটি বড় ইনসুলিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান- এলি লিলি, নভো নরডিস্ক ও সানোফি মিলিতভাবে নির্ধারণ করা মূল্য অনুযায়ী বিশ্বের ৯০ শতাংশ ইনসুলিনের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ফ্রেডরিক বেন্টিংয়ের মাথায় ইনসুলিনের ধারণার জন্ম ১৯২০ সালের এক সকালে। ৩১ অক্টোবর এক মেডিকেল সাময়িকীকে বেন্টিং 'দ্য রিলেশন অব দ্য আইলেটস অব ল্যাংগারহ্যান্স টু ডায়াবেটিস উইথ স্পেশাল রেফারেন্স টু কেসেস অব প্যানক্রিয়েটিক লিথিয়াসিস' শীর্ষক এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধটি পড়ার পর ডাক্তার বেন্টিং ঘুমোতে যান। রাত দুটোর সময় তিনি আচমকাই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। মনে যা আসে, তা দ্রুত কাগজে লিখে ফেলেন।
২৫ শব্দের সেই হাইপোথিসিস থেকেই এক বছরের মাথায় জন্ম বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি।
গবেষণার সুযোগ নিতে বেন্টিং এরপর টরন্টোতে পাড়ি জমান। অগ্ন্যাশয় থেকে জন্ম নেওয়া অনুমিত সাবস্ট্যান্সটি আলাদা করার কাজে নেমে পড়েন তিনি। এখানে তার পরিচয় ঘটে ডাক্তার জন ম্যাকলিয়ডের সঙ্গে। গড়িমসি করে তিনি বেন্টিংকে টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত এক ল্যাব ব্যবহারের অনুমতি দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণাগারেই ১৯২১ সালের ১৫ মে বেন্টিং কাজ শুরু করেন। সহকারী হিসেবে নেন ২২ বছর বয়সী বায়োকেমিস্ট্রির শিক্ষার্থী চার্লি বেস্টকে। পরবর্তীকালে জৈব রসায়নবিদ জেমস কলিপ তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।
বেন্টিং ও চার্লস কুকুরের অগ্ন্যাশয় লাইগেট করার মধ্য দিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি ধারণা করেন, এর মাধ্যমে হজমকারী অগ্ন্যাশয় রসের কার্যক্রম বন্ধ হবে। আর তখনই আইলেট সেলের সেই অজানা নির্যাস শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
পরবর্তীকালে তারা আইলেট সেলগুলো থেকে নির্যাসটি আলাদা করতে শুরু করেন। বাছাইকৃত সেই নির্যাস এরপর তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কুকুরের ওপর প্রয়োগ করেন। দলটি এরপর অগ্ন্যাশয় ছাড়াই একটি কুকুরকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে এখান থেকেই ইনসুলিনের মতো যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথ সুগম হয়।
১৯২১ সালের শীতকালে বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক জেমস বি কলিপকে বোর্ডে যুক্ত করা হলে গবেষণায় অগ্রগতি দেখা দেয়। জেমস বি কলিপ মানুষের মাঝে ইনসুলিন প্রয়োগের আগে তা বিশুদ্ধকরণের দায়িত্ব নেন।
সহসাই গবেষণার সাফল্যের খবর ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদনের প্রতিযোগিতা। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীরা নতুন এই চমক জাগানো ইনসুলিন নিতে টরোন্টোতে ভিড় জমান।
১৯২২ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রায় অচেতন অবস্থায় ১৪ বছর বয়সী বালক লিওনার্ড টমসনকে টরোন্টো জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। টমসনের দেহে ইনসুলিন প্রবেশ করানোর মাধ্যমে তিনি ইতিহাসে ইনসুলিন গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তিতে পরিণত হন। প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে আসেন টমসন।
প্রথম ইনসুলিন গ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে একজন ছিলেন পাঁচ বছর বয়সী টেডি রাইডার। তিনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আরও ৭১ বছর বেঁচে ছিলেন। পরের বছরই বল ফিরে পেয়ে ছয় বছর বয়সী রাইডার বেন্টিংকে লিখেন, 'আমি এখন নাদুসনুদুস এক ছেলে এবং ঠিকঠাক বোধ করি। আমি এখন গাছে চড়তেও পারি।'
তবে এলসি নিডহ্যাম ছিলেন শিশুদের মধ্যে প্রথম ইনসুলিন গ্রহণকারী। প্রথম ডোজ ইনসুলিন গ্রহণের পরেই এলসি ডায়াবেটিক কোমা থেকে ফিরে আসেন। ১৯২২ সালের অক্টোবরে তিনি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পরের বছর জানুয়ারিতেই স্কুলে যাওয়া শুরু করেন।
পরের বছর ফেব্রুয়ারি, ডাক্তার ফ্রেডরিক বেন্টিং ও জৈব রসায়নবিদ জন ম্যাকলিওড গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে তারা অ্যালকোহল জাতীয় অগ্ন্যাশয় নির্যাস থেকে মানব দেহের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তার বিবরণ তুলে ধরেন।
ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে ডায়াবেটিস রোগীদের কোনো আশাই ছিল না। এমনকি কঠোর ডায়েট মেনে চললেও তারা তিন থেকে চার বছরের বেশি বাঁচতে পারতেন না।
তবে ডায়াবেটিস রগীদের দেহে ইনসুলিনের প্রভাব অলৌকিক কিছু ছিল না। তরুণ সার্জন বিল বিগেলো প্রথম পর্যায়ের ইনসুলিন ট্রায়ালগুলো দেখেছেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'কোমায় থাকার মতো রোগীরা নাটকীয়ভাবে সুস্থ হয়ে উঠতেন। সাক্ষাৎ মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে আসতেন তারা।'
বড় পরিসরে ইনসুলিন উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এলি লিলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গরু ও শূকর থেকে ইনসুলিন উৎপাদনের মাধ্যমে তারা বহু মানুষের কাছে এই জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পৌঁছে দেন।
১৯২২ সালের গ্রীষ্মকালে লিলির ইনসুলিন প্ল্যান্টে দিনের ২৪ ঘণ্টাই জাদুকরি এই তরলের উৎপাদন চলত।
এক সাক্ষাৎকারে লিলি উল্লেখ করেন, একজন সাধারণ ব্যক্তি সিগারেটের পেছনে কিংবা গ্যাসোলিন সরবরাহে দৈনিক যত টাকা খরচ করেন, ইনসুলিন এখন তারচেয়েও কম খরচে পাওয়া যাবে।
১৯২৩ সালে বেন্টিং ও ম্যাকলিওড যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩৪ সালে বেন্টিং নাইট উপাধিতে ভূষিত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান বেন্টিং। তার সর্বশেষ নায়কোচিত কাজটি ছিল পাইলটের জখম ড্রেস করা।
আধুনিক ইনসুলিন মূলত সিনথেটিক। এখন আর গরু কিংবা শূকরের অগ্ন্যাশয় ব্যবহৃত হয় না। ব্যাকটেরিয়া ও ইস্টের সাহায্যে এখন চাহিদা অনুযায়ী ইনসুলিন সরবরাহ করা সম্ভব।
বেন্টিংকে ইনসুলিন প্যাটেন্টের জন্য ফার্মাসিউটিকাল প্রতিষ্ঠানগুলো এক মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষের জন্য ১৯২৩ সালে, ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোকে মাত্র এক ডলারে ইনসুলিনের স্বত্ব প্রদান করেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠান কোনো নির্দিষ্ট দেশে ইনসুলিন সরবরাহ করে থাকে। অর্থাৎ, কম-বেশি তারা মনোপলির মাধ্যমে বাজার দখল করে রেখেছে। একইসঙ্গে মূল্যও নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী নির্ধারণ করতে পারে।
চীন ও ভারতের মতো কিছু দেশে স্থানীয়ভাবে ইনসুলিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থাকায় এর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে মানের দিক থেকে আপস করার আশংকা থাকে, যার কারণে জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ইনসুলিন উৎপাদনে এগিয়ে না আসার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। তবে সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, চিরকালীন প্যান্টেন্ট রক্ষা। প্যাটেন্ট অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো আবিষ্কার সম্পর্কিত স্বত্বাধিকার প্রদান করা হয়। হিউমালগ, ল্যানটাস ও অন্যান্য পুরনো প্রজন্মের ইনসুলিনের এখন কোনো প্যাটেন্ট নেই। এগুলো মূলত প্রাণীনির্ভর ইনসুলিন।
ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো প্যাটেন্টের সুবিধা নিয়ে বাজার দখল করে রেখেছে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারদরের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং দশকের পর দশক ধরে চড়া মূল্য বজায় থাকে।
সাম্প্রতিক আই-ম্যাক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ল্যানটাস উৎপাদক সানোফিও এর ব্যতিক্রম নয়। সানোফি শুধুমাত্র ল্যানটাসের জন্যই ৭৪টি প্যাটেন্ট আবেদন করেছে। এর মানে, সানোফি ৩৭ বছরের জন্য প্রতিযোগিতাহীন একক বাজার ভোগ নিশ্চিত করে ফেলেছে। ফলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্যাটেন্ট আবেদন এবং পরবর্তীকালে উৎপাদনের কোনো সুযোগই থাকছে না।
সামনের বছরগুলোতে ইনসুলিন আবিষ্কারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিবস কেন্দ্র করে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রচারণার সুযোগ রয়েছে। ঐতিহাসিক এই দিন ও ঘটনাগুলো বহু ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর জীবন সহজ করে তুললেও আমাদের মনে রাখা উচিত, জীবনরক্ষাকারী ইনসুলিন এখনো বহু মানুষের নাগালের বাইরে।