ভারত মহাসাগরে টুনা শিকার কেন্দ্র করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নব্য-উপনিবেশবাদ’
ভারতীয় মহাসাগরে হলুদ পাখনা টুনার শিকার কমাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবিত পদক্ষেপকে 'ভণ্ডামি এবং নব্য উপনিবেশবাদ' হিসেবে দেখছে উপকূলবর্তী উন্নয়নশীল দেশসমূহ। নিজ অঞ্চলের সীমানার বাইরে গিয়ে সংকটাপন্ন টুনা মাছের বৃহত্তম শিকারি হয়েও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপর্যাপ্ত পদক্ষেপের কারণে ক্ষেপে আছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো।
আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের ব্লুফিন টুনার থেকে আকারে ছোট হলেও, ইয়েলোফিন বা হলুদ পাখনার টুনা সমুদ্রের দ্রুততম এবং শক্তিশালী শিকারি প্রাণিদের একটি। হলুদ পাখনার টুনা আহি টুনা নামেও পরিচিত। মাত্রাতিরিক্ত শিকারের ফলে ভারত মহাসাগরে টুনা মাছের এই প্রজাতিটির অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন। এমনকি, টেসকো, কো-অপ এবং প্রিন্সেসের মত সুপার মার্কেট এবং ব্র্যান্ডগুলোও এখন টুনা মাছের সংরক্ষণের জন্য পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীদের সাথে গলা মেলাচ্ছেন। চার বিলিয়ন ডলারের মৎস্য বাণিজ্য পুনরায় চাঙ্গা করতে প্রতিষ্ঠানগুলো মৎস্য শিকার নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে।
তবে ভারত মহাসাগর মূলত আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার সীমান্তবর্তী হলেও, অঞ্চলটিতে হলুদ পাখনা টুনার একক বৃহত্তম শিকারি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মূলত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্পেন এবং ফ্রান্স দেশটির সীমানা থেকে হাজার মাইল দূরবর্তী সমুদ্র অঞ্চলে মৎস্য শিকার পরিচালনা করে থাকে। ২০১৯ সালে দেশগুলো ৭০ হাজার টন ইয়েলোফিন টুনা মাছ ধরে। এমনকি ভারতীয় মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশ ইরান (৫৮ হাজার টন), শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের (৪৪ হাজার টন) চাইতেও এই হার অনেক বেশি।
বর্তমানে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে উপকূলবর্তী উন্নয়নশীল দেশগুলোর দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উপকূলস্থ দেশগুলোর অর্থনীতি সরাসরি ভারতীয় মহাসাগরের উপর নির্ভরশীল। সেশেলসের সাবেক একজন মৎস্য কর্মকর্তা নির্মল শাহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে 'ভণ্ডামি এবং নব্য উপনিবেশবাদে'র অভিযোগ তুলেন। অন্যদিকে, হলুদ টুনার জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবকে মালদ্বীপ 'জঘন্যভাবে অপর্যাপ্ত' বলে মন্তব্য করে।
ইউরোপীর ইউনিয়নের জাহাজগুলো মূলত ফিশ এগ্রিগেটিং ডিভাইসের (ফ্যাডস) মূল ব্যবহারকারী। মাছ ধরতে ব্যবহৃত ভাসমান এই বস্তুর মাধ্যমে ছায়া সৃষ্টি করে দলবদ্ধ মাছদের আকর্ষণ করা হয়। ফ্যাডসের কাছাকাছি জাল ছড়িয়ে সহজেই বৃহৎ পরিসরে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা হয়। এমনকি পোনামাছগুলোও রেহাই পায় না।
আগামী সপ্তাহে হতে যাওয়া ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) জরুরি সভাকে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। টুনা ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক সংগঠনটির ৩৩ অংশীদারের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মালদ্বীপ দু-পক্ষই মাছ শিকার কমিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব রেখেছে।
তবে, উন্নত দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে থাকলেও মালদ্বীপই সবথেকে কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তাব রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। এমনকি, ফ্যাডস ব্যবহার কমানোর বিষয়েও কোন বক্তব্য উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে, সমালোচনার মুখে ইউরোপীয় এক কর্মকর্তা জানান, তারা মৎস্য শিকার হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সমর্থন জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবকে 'উচ্চাভিলাষী হলেও বাস্তববাদী' বলে উল্লেখ করেন ঐ কর্মকর্তা।
তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মালদ্বীপের প্রস্তাবে ফ্যাডস ব্যবহার সম্পর্কিত প্রস্তাব না থাকলেও কেনিয়া এবং শ্রীলঙ্কা পৃথক প্রস্তাবে বিষয়টির উল্লেখ করে।
কেনিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৎস্য বিভাগের সহকারী পরিচালক স্টিফেন ডেগওয়া মন্তব্য করেন, "কেনিয়া, মালদ্বীপ এবং উপকূলবর্তী দেশগুলো কেবলমাত্র ভারতীয় মহাসাগরেই মাছ শিকার করতে পারে। সুতরাং, মাছের পরিমাণ কমে গেলে মূলত আমাদেরই দুর্ভোগ পোহাতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।"
"ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বিদেশি নৌকাগুলো অন্য কোনও সাগরে পাড়ি জমাবে। কিন্তু আমরা কোথাও যেতেও পারব না। মৎস্যহীন সমুদ্রে আমাদের আটকা পড়ে থাকতে হবে," বলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান