এশিয়ার কুখ্যাত ঘাতক ‘দ্য সারপেন্ট’কে ধরার কৃতিত্ব যার
১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ; ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপ্পেনবার্গ এসেছিলেন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের একটি হাসপাতালের মর্গে। মর্গের ভেতর শবদেহের কটু গন্ধে দাঁড়িয়ে গা গুলিয়ে উঠলেও কিছু করার ছিল না তার। নেদারল্যান্ডের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
তার সামনেই পুড়ে যাওয়া দুটি মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চিড়ে আবার সার্জিক্যাল কেবল দিয়ে সেলাই করে রাখা। সঙ্গে আসা ডেনটিস্ট পরীক্ষা করে জানালেন, এরা দুজনই নিখোঁজ ডাচ পর্যটক। মৃতদের একজন নারী। মর্গের প্যাথলজিস্ট নিপ্পেনবার্গকে জানান, ওই নারীর মাথায় ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। আর তার পুরুষ সঙ্গীকে গলা টিপে অজ্ঞান করে খুনি। তারপর জীবন্ত অবস্থাতেই তাদের দেহে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
৩০ বছরের কূটনৈতিক ক্যারিয়ারে একে সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্ত বলে উল্লেখ করেন নিপ্পেনবার্গ। সেদিনই তিনি নির্মম ওই খুনিকে বিচারের মুখোমুখি করার অঙ্গীকার করেন এবং তারপর এক দশক ধরে চেষ্টার পর সফলও হন।
'লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন এ সংকল্প করি, তখন জানতাম নিজ দায়িত্বের সীমা লঙ্ঘন করছি। কিন্তু ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি,' চলতি বছরের শুরুতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান হারম্যান।
পরে তিনি জানতে পারেন, খুনি ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলার চার্লস শোভরাজ, যে পরবর্তীকালে অন্তত এক ডজন পশ্চিমা নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছিল।
১৯ শতকের ঊষালগ্নে কুখ্যাত এক খুনির নিষ্ঠুরতায় কেঁপে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী লন্ডন। একের পর এক নারীর পৈশাচিক খুন, আর প্রতিবার আইনের নাগালের বাইরে থাকা খুনির নাম গণমাধ্যম দেয়- জ্যাক দ্য রিপার। ইতিহাসের কুখ্যাত এই সিরিয়াল কিলারের নাগাল শেষ পর্যন্ত পায়নি লন্ডন পুলিশ। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকে রিপারের মতোই ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার চার্লস শোভরাজ আতঙ্কের নতুন ত্রাস সৃষ্টি করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে।
জন্ম ভিয়েতনামে হলেও ফরাসি নাগরিক ছিল শোভরাজ। বেছে বেছে খুন করত পশ্চিমা পর্যটকদের। নেপাল, ভারত ও থাইল্যান্ড জুড়ে ছিল তার বিচরণ।
এশিয়ার অনেক দেশে আইনের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াত সুদর্শন এ হত্যাকারী। শিকারকে মাদক সেবন করিয়ে অচেতন করে, তাদের লুট করে অবশেষে হত্যা করত সে। নিপ্পেনবার্গ শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করেন।
নিপ্পেনবার্গ জানান, হিপ্পি সংস্কৃতির অনুসারী পশ্চিমা নাগরিকরা বৌদ্ধ ও হিন্দু আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ঘেরা ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ডের মতো দেশে ভ্রমণ করতে পছন্দ করতেন। আধ্যাত্মিক রোমাঞ্চপ্রেমী এসব মানুষকেই তার লক্ষ্য বানাত শোভরাজ। তাই হিপ্পি ট্রেইল'খ্যাত অঞ্চল ছিল তার বিচরণ ক্ষেত্র।
সম্প্রতি নিপ্পেনবার্গের দেওয়া বর্ণনাকে কেন্দ্র করে বিবিসি ও নেটফ্লিক্স যৌথভাবে নির্মাণ করেছে 'দ্য সার্পেন্ট' ড্রামা সিরিজ। আগামী এপ্রিলে এটি মুক্তি দেবে স্ট্রিমিং সার্ভিসটি।
১৯৭৫ সালে দুজন পর্যটককে হত্যার দায়ে বর্তমানে নেপালের জেলে আজীবন কারাবাস ভোগ করছে শোভরাজ। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আনা অনেক খুনের অভিযোগ আজও প্রমাণ করা যায়নি। নিপ্পেনবার্গের মতে, এসব খুনের কিনারা না হলে শোভরাজের কেসটি অমীমাংসিত রয়ে যাবে।
কূটনীতিক হয়েও সিরিয়াল কিলারকে অনুসরণের সেই চাঞ্চল্যকর অভিজ্ঞতা জানান নিপ্পেনবার্গ। দেন খুনির হদিশ পেতে সাহায্য করার মতো কিছু তথ্য সূত্রের বর্ণণা।
ভাগ্যক্রমে পাওয়া চিঠি:
সময়টা ১৯৭৬ সাল। ব্যাংকক তখন আজকের আধুনিক মহানগরে রূপ নেয়নি। ছিল না দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম পাতাল রেল বা ফ্লাইওভার কেন্দ্রিক উড়াল রেলের ব্যবস্থা। সড়কে তীব্র যানজটের ভিড়ে চলাফেরাই দায়। বার্তা আদানপ্রদানের ডিজিটাল যুগও নয় তখন। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে ল্যান্ডফোন বা চিঠি ছিল সেরা উপায়। আজকের তুলনায় অনেকগুণ বিচ্ছিন্ন সে যুগে কোনো ভিন দেশি পর্যটক এশিয়ার দূরতম কোনো অঞ্চলে হঠাৎ হারিয়ে গেলে তার খোঁজ পাওয়া যেত না কয়েক সপ্তাহ বা ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মাস।
ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি এভাবে হারিয়ে যাওয়া দুই ডাচ পর্যটকের সন্ধান চেয়ে নেদারল্যান্ড থেকে একটি চিঠি পান নিপ্পেনবার্গ। চিঠির লেখক জানান, তিনি তার বোন ও বোনের স্বামীকে খুঁজে পেতে দূতাবাসের সহায়তা চান। হেনরিকাস বিনতাঞ্জা ও কর্নেলিয়া হেমকার নামের ওই দম্পতি এশিয়ায় আসার পর প্রতি সপ্তাহে তাদের পরিবারের কাছে চিঠি লিখতেন। কিন্তু গত ছয় সপ্তাহ ধরে তাদের কাছ থেকে কোনো চিঠি আসেনি।
আত্মীয়দের সন্ধান চেয়ে লেখা ওই চিঠি যখন নিপ্পেনবার্গের হাতে আসে, তিনি তখন ৩১ বছরের যুবক। কনিষ্ঠ কূটনীতিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন ব্যাংককের ডাচ দূতাবাসে। 'চিঠিটি পেয়ে ভাবছিলাম, বেশ অদ্ভূত ঘটনা তো!' নিয়মিত দুজন চিঠি লেখক হঠাৎ কেন একসঙ্গে লেখা বন্ধ করে দিলেন- তা ভেবেই বিস্মিত হন তিনি।
ওই চিঠির কয়েক সপ্তাহ আগে ব্যাংকক থেকে ৫০ মাইল দূরে ওয়াথায়া এলাকায় রাস্তার ধারে পাওয়া যায় পুড়ে প্রায় কয়লা হয়ে যাওয়া দুটি মৃতদেহ। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের নিখোঁজ দুজন অস্ট্রেলীয় পর্যটক হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য তাদের দুজনকেই জীবিত ও বহাল তবিয়তে পাওয়া যায়। প্রশাসন বুঝতে পারে তাদের ভুল, কিন্তু মৃতদেহ দুটি কাদের- তা শনাক্ত করার কোনো উপায় ছিল না।
নিপ্পেনবার্গ ঘটনাটি জানতেন। চিঠি পাওয়ার পর তিনি আন্দাজ করলেন, এরা হারিয়ে যাওয়া সেই ডাচ দম্পতি হতে পারেন।
তবে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহের পরিচয় নির্ণয় করা সহজ নয়। সে সময় এ কাজের সেরা উপায় ছিল মৃতের ডেন্টাল রেকর্ড পরীক্ষা। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমে নিখোঁজ দম্পতির দন্ত চিকিৎসার রেকর্ড জোগাড় করলেন নিপ্পেনবার্গ। তারপর ব্যাংককে কর্মরত এক ডাচ ডেনটিস্টকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন রওনা হয়েছিলেন মর্গের দিকে। নিহতদের পরীক্ষা করে সেই ডেনটিস্ট অতীত রেকর্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল খুঁজে পান।
হতভাগ্যদের পরিচয় তো জানা গেল, কিন্তু বিকৃত শবদেহ দুটির দৃশ্য মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলেন না নিপ্পেনবার্গ। তখনই তার মনে পড়েছিল কিছুদিন আগে বেলজিয়াম দূতাবাসে কর্মরত বন্ধু পল সিমনসের কাছ থেকে শোনা এক ঘটনা। সিমনস তাকে বলেছিলেন, সন্দেহভাজন এক ফরাসি রত্ন ব্যবসায়ীর কথা। অ্যালান গাউতিয়ার নামক ওই ব্যক্তির ব্যাংককের অ্যাপার্টমেন্টে মেলে নিখোঁজ অনেক পশ্চিমা নাগরিকের পাসপোর্ট। সন্দেহ করা হচ্ছিল, এসব মানুষ খুন হয়েছেন। পাসপোর্টগুলোর দুটি ছিল ডাচ নাগরিকদের। তবে সিমনস তার তথ্যসূত্র প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন।
নিপ্পেনবার্গ ভেবেছিলেন, তার বন্ধুটি আজগুবি কাহিনী শোনাচ্ছেন। কারণ, সূত্র উল্লেখ না করায় তার কথা শোনাচ্ছিল রোমাঞ্চকর গল্পের মতোই।
তবে পরে তারা দুজনেই জানতে পারেন, অ্যালান গাউতিয়ার ছিল চার্লস শোভরাজের ব্যবহার করা অনেকগুলো ছদ্মনামের একটি। আইনের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো ফরাসি চোর, প্রতারক ও খুনি শোভরাজ রত্ন ব্যবসায়ী সেজে পর্যটকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতো, তারপর মাদক সেবন করিয়ে লুট করত হতভাগ্যদের। অভিবাসন আইনের শিথিলতার সুযোগ নিয়ে প্রায়ই সে ভিকটিমের নাম ও পাসপোর্ট ব্যবহার করে ঘুরে বেড়াত এশিয়ার এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
কুটিল সরীসৃপের অনুসন্ধান:
মর্গ থেকে ফিরে আসার পরের দিন সিমনসকে ফোন করেন নিপ্পেনবার্গ এবং ওই রত্ন ব্যবসায়ীর সম্পর্কে কোথা থেকে জেনেছেন, তা স্পষ্ট করে বলার দাবি করেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে বন্ধুর অনুরোধে সম্মত হন সিমনস। নিপ্পেনবার্গকে তিনি নাদিন গিয়ারস নামে এক ফরাসি নারীর কথা জানান।
নাদিন শোভরাজের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনেই থাকতেন, এবং তার মাধ্যমেই অনেক মক্কেলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে শোভরাজের।
নিপ্পেনবার্গ ঠিকানা নিয়ে নাদিনের সঙ্গে দেখা করেন। ওই নারী তাকে জানান, এর আগেও অ্যালান গাউতিয়ারের (শোভরাজ) সঙ্গে অনেকে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তার কাছে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পাসপোর্ট আছে দেখে অনেকেই নিজেরা খুন হওয়ার ভয়ে পালিয়ে যান।
খুন হওয়া ডাচ দম্পতির ছবি নাদিনকে দেখান নিপ্পেনবার্গ। নাদিন জানান, তিনি এই দম্পতিকে শোভরাজের কাছে আসতে দেখেছেন।
এ কথা জানামাত্র থাই কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন নিপ্পেনবার্গ। কিন্তু একইসঙ্গে চালাতে থাকেন নিজস্ব অনুসন্ধান।
১৯৭৬ সালের ১১ মার্চ সকালে নিপ্পেনবার্গ জানতে পারেন, কানাডার কুইবেকের বাসিন্দা বান্ধবী মারি আন্দ্রে লেকলার্কের সঙ্গে ইউরোপ যাওয়ার পরিকল্পনা করছে শোভরাজ। তার বান্ধবীর ডাকনাম ছিল মনিক, ব্যাংককেই তার সঙ্গে ছদ্মবেশি শোভরাজের পরিচয়। সন্দেহভাজন খুনি পালানোর সংবাদ দেওয়ার পর সেদিন বিকেলেই তাদের অ্যাপার্টমেন্টে হানা দেয় থাই পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা শোভরাজকে নিয়ে যায়।
যদিও শোভরাজের আসল নাম-পরিচয় কেউ জানত না।
পরবর্তীকালে শোভরাজের আত্মজীবনী লেখক সাংবাদিক জুটি রিচার্ড নেভিল ও জুলি ক্লার্ক জানান, সে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। শোভরাজ আরেক ভিকটিমের পাসপোর্টে নিজের ছবি লাগিয়ে নিজেকে মার্কিন নাগরিক হিসেবে দাবি করে; পরে পুলিশ তাকে ছেড়েও দেয়।
এর পরের রাতে শোভরাজের সঙ্গে একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকা এক বন্ধু নাদিনকে বাড়িতে দাওয়াত দেন। ভীত নাদিন সে কথা টেলিফোনে নিপ্পেনবার্গকে জানান। খুনির আস্তানায় গেলে নাদিনের জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন তরুণ কূটনীতিক। আবার, নাদিন না গেলে পুলিশি অভিযানের জন্যে তাকেই সন্দেহ করবে শোভরাজ।
ওই মুহূর্তে নিজের উৎকন্ঠা তুলে ধরে বলেন, 'এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ মুহূর্তগুলোর একটি।' তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর নাদিনকে বলেন, 'আমি সত্যিই দুঃখিত, কিন্তু আপনাকে সেখানে যেতে হবে।'
সেদিন রাতে শোভরাজের বাড়িতে সত্যিই যান নাদিন। শোভরাজের ওই সহযোগীর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে বেশকিছু পাসপোর্ট আকারের ছবি নিজের অন্তর্বাসের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আসেন। এসব ছবির সাহায্যে ভিকটিমদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক তথ্য জানতে পারেন নিপ্পেনবার্গ।
পরদিন সকালে বান্ধবী লেকলার্কের সঙ্গে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড ছেড়ে চলে যায় শোভরাজ। আইনের মুঠোর মধ্যে এসেও ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা এটাই তার প্রথম বা শেষবার নয়। বিষধর সাপের মতো এই ধূর্ত চরিত্রের জন্যেই সে 'দ্য সার্পেন্ট' নামে কুখ্যাতি পায়।
শোভরাজের আস্তনায়:
শোভরাজের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় থাই পুলিশের ওপর নাখোশ ছিলেন নেদারল্যান্ডের কর্মকর্তারা। তারা এজন্য পুলিশি তৎপরতার অভাবকে দায়ী করেন। নিপ্পেনবার্গ শোভরাজের বিষয়ে খোঁজখবরে জড়িত জেনে তাকে টানা তিন সপ্তাহের ছুটি দেন ডাচ রাষ্ট্রদূত।
ছুটিতে যাওয়ার আগে নিপ্পেনবার্গ ও তার স্ত্রী এঞ্জেলা তাদের সংগৃহীত সব তথ্য আর নথি ব্যাংককে অবস্থিত সবগুলো দেশের দূতাবাসে পাঠান।
ছুটি থেকে ফেরার পর তৎকালীন কানাডীয় রাষ্ট্রদূত নিপ্পেনবার্গকে ডেকে পাঠান। তিনি জানান, কানাডীয় পুলিশ লেকলার্কের বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তারা জানিয়েছেন, তাদের মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গেছে। কিন্তু জরুরি যোগাযোগের জন্য রেখে গেছে ফ্রান্সের মার্সেই শহরের এক ঠিকানা। ফরাসি পুলিশ খোঁজ নিয়ে দেখে, সেটি ছিল শোভরাজের মায়ের ঠিকানা।
লেকলার্কের প্রেমিকের আসল পরিচয় এতদিনে জানতে পারে সবাই। চতুর এই লোকের আসল নাম চার্লস শোভরাজ।
ওই মাসে নাদিন আবার নিপ্পেনবার্গকে ফোন করে জানান, শোভরাজের অ্যাপার্টমেন্ট মালিক ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিতে চান, এবং তার সব মালপত্র ফেলে দিতে চান। গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় একদল সহযোগীসহ সেখানে উপস্থিত হন এ কূটনীতিক।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'তার বাসাটি ছিল কুরুচিকর জিনিসে ভর্তি আর ভীষণ নোংরা। আমরা ৫ কেজি নানা রকম ওষুধ এবং কার্টনভর্তি লেক্সেটিভ নামের একটি তরল মাদকের সন্ধান পাই। আরও পাওয়া যায়, নিহত ডাচ নারী হেমকারের কোট ও হ্যান্ডব্যাগ।'
এরপর ১৯৭৬ সালের ৫ মে ডাচ রাষ্ট্রদূত এসব কথা গণমাধ্যমকে জানান। কয়েকদিন পরই 'ওয়েব অব ডেথ' বা 'মৃত্যুর ফাঁদ' শিরোনামে প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন ছাপায় বহুল পঠিত স্থানীয় দৈনিক ব্যাংকক পোস্ট।
সংবাদ প্রকাশের পরই টনক নড়ে থাই কর্মকর্তাদের। তারা শোভরাজকে গ্রেপ্তারের জন্যে ইন্টারপোল মারফত নোটিশ জারি করায়। ওই সংবাদের প্রেক্ষিতেই একই বছরের ৫ জুলাই শোভরাজকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশ।
ভারতেও কিছু খুন করে শোভরাজ। তার বিরুদ্ধে বারানসীতে একজন ইসরায়েলি নাগরিক ও আরেকজন ফরাসি পর্যটককে হত্যার অভিযোগ আনে স্থানীয় পুলিশ। মাদক খাইয়ে অচেতন করে লুট করে আরেকদল ফরাসি পর্যটককে।
খুনের মামলায় তার শাস্তি হলেও পরবর্তীকালে আপিলের প্রেক্ষিতে সাজা রদ করা হয়। তবে পর্যটক দলকে লুট করার অকাট্য প্রমাণ পাওয়ায় শোভরাজকে দিল্লির কুখ্যাত তিহার জেলে ১২ বছর কারাবাসের আদেশ দেন আদালত।
অবশ্য কারাগারে নিষ্ক্রিয় ছিল না শোভরাজের শয়তানি বুদ্ধি। সেখানে সে কারা কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে বিশেষ সুবিধা ভোগ করত। ১৯৮৬ সালের ১৭ মার্চ জেল থেকে সে পালিয়েও যায়।
শোভরাজ পালিয়ে যাওয়ার পর তার এক শুভাকাঙ্ক্ষি বন্ধু নিপ্পেনবার্গকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এরপর ২০০৩ সালে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে শোভরাজকে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। ১৯৭৫ সালে এক পর্যটক হত্যার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। কিন্তু ছিল পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাব। পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে প্রথমবার নেপালে বেড়াতে আসার দাবি করে সে।
নিপ্পেনবার্গ ততদিনে নিউজিল্যান্ডে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। এক বন্ধু মারফত শোভরাজের গ্রেপ্তারের কথা জানতে পেরে, নিজের গ্যারাজ খুঁজে শোভরাজের অপরাধ সম্পর্কিত ছয়টি বাক্সভর্তি নথিপত্র পান। এরমধ্যে একটি নথিতে ছিল ১৯৭৬ সালে দেওয়া তার প্রেমিকা লেকলার্কের জবানবন্দি। নেপালে শোভরাজের সঙ্গে কাটানো সময়ের বিস্তৃত বর্ণনা ছিল সেখানে।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি নথিপত্র মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই- এর কাছে পাঠান। এফবিআই অনুসন্ধানে শোভরাজের বিরুদ্ধে হত্যার প্রমাণ মেলে। ফলে ২০০৪ সালে মার্কিন পর্যটক কনি জো ব্রোঞ্জিককে হত্যার ঘটনায় শোভরাজকে আজীবন কারাবাসের আদেশ দেন নেপালের আদালত।
তারপরও নিজেকে সব কৃতিত্ব দিতে নারাজ নিপ্পেনবার্গ। তিনি বলেন, 'নেপালে তার বিচার হওয়ার পেছনে আমার সরাসরি ভূমিকা আছে- এমন দাবি করাটা বাড়াবাড়ি হবে। তবে আমার তৎপরতার কারণে নেপালের পুলিশ কোথায় অনুসন্ধান করতে হবে- সে সম্পর্কে জানতে পেরেছিল।'
- সূত্র: সিএনএন