সুপারি উৎপাদন কমেছে নোয়াখালীতে
নোয়াখালীর মাটি সুপারি চাষের উপযোগী হওয়ায় প্রাচীনকাল থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে সুপারির চাষ হয়ে থাকে। এই এলাকার মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবন-জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ছোট এই ফসলটি। প্রতি মৌসুমে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকার সুপারি। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে।
কাঁচা, ভেজা ও শুকনো- তিন ভাবে বিক্রি হয় এ সুপারি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে জেলার ৯টি উপজেলার ১০৮৫ হেক্টর জমিতে সুপারির আবাদ হয়েছিল। সুপারি উৎপাদন হয়েছে ৫৫০০ মেট্রিক টন। পর্যাপ্ত পরিবেশ ও চাষী সংখ্যা কমে যাওয়ায় গত দুই মৌসুমের তুলনায় উৎপাদন কমেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে গত বছর প্রায় ১১০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৫৮৫০ মেট্রিক টন। এর আগের বছর যা ছিল ১১২৫ হেক্টর জমিতে ৬০০০ মেট্রিক টন সুপারি।
সরেজমিন সুপারির বাজার ঘুরে জানা গেছে, জেলার প্রায় ৯টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে সুপারির চাষ করছে অন্তত দুই শতাধিক কৃষক। একেক জনের রয়েছে ৩-৪টি করে বাগান। গড়ে একটি বাগানে দেড় থেকে দুই হাজারের উপরে সুপারি গাছ থাকে। সুপারি উৎপাদনে জেলার সদর উপজেলার বিনোদপুর, দাদপুর, উত্তর গোরিপুর, হাকিমপুর, জামান নগর, নতুনহাট, দাসেরহাট, কালাদরাপ, মুন্সি তালুক, রব বাজার, বাংলাবাজার, খলিপারহাট উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও জেলার হাতিয়া, সুবর্ণচর, কবিরহাট, চাটখিলের খিলপাড়া, সোনাইমুড়ীর আমিশাপাড়া, কোম্পানীগঞ্জের চরএলাহি, চরফকিরা, বেগমগঞ্জের একলাশপুর, ছয়ানি, রাজগঞ্জ, সেনবাগের কাবিলপুর, মোহাম্মদপুর অন্যতম। সুপারি ক্রয় বিক্রির জন্য চৌমুহনী, দত্তেরহাট, গোরিপুর, চাটখিল, বসুরহাট, সোনাইমুড়ী বাজারে পাইকার রয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে খুচরা বিক্রেতারা এসব পাইকারি বাজারে এনে সুপারি বিক্রি করে থাকেন।
সদর উপজেলার কালাদরাপ ইউনিয়নের কৃষক আবুল কাশেম বলেন, 'আমার সুপারি বাগানে প্রায় ২৫শ গাছ রয়েছে। যা থেকে প্রতি মৌসুমে ৪ হাজার পন (প্রতি পনে ৮০ পিস) সুপারি উৎপাদন হয়। হাটে প্রতি পন সুপারি ১৮০-২২০ টাকা করে বিক্রি করি। প্রতিটি সুপারি গাছ থেকে ৮-১০ বছর ফলন পাওয়া যায়। যেটাকে আমরা আঞ্চলিক প্রবাদে 'এক ছেলের রুজি' বলে থাকি'।
সদর উপজেলার গোরিপুর বাজারের পাইকার পিয়াস উদ্দিন বলেন, 'সুপারির পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি আমার নিজের ছোট সুপারি বাগান রয়েছে। যাতে প্রায় ৫-৬ শতাধিক গাছ আছে। চলতি মৌসুমে ১ হাজার পন সুপারি উৎপাদন হয়েছে। বাগানে এখনো ১০ পন সুপারি আছে। প্রতি পন কাঁচা ২২০ থেকে ২৫০ টাকা করে বিক্রি করা হয়। এলাকায় ইব্রাহিম পাটোয়ারী, আবুল কালাম মাস্টার, কাশেম মিয়াসহ অন্তত ১৫ জনের সুপারির বাগান রয়েছে। তাদের প্রতিটি বাগানে ২-৩ হাজার করে সুপারি গাছ আছে'।
একই বাজারের একজন পাইকার জানান, মূলত সুপারির মৌসুম অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে। সপ্তাহে ২ দিন গোরিপুর বাজারে হাট বসে। প্রতি বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি পন ১৮০-২৩০ টাকা করে কেনা হয়। মাসে ৪ হাটে ৩ হাজার পন সুপারি তিনি ক্রয় করেন। গত মৌসুমে ১৩৮ কান (প্রতি কানে ১৬ পন সুপারি) তিনি ক্রয় এবং বিক্রি করেছেন। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত তিনি ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সুপারি কিনেছেন। গত বছরে বিক্রি ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে কেনার পর সুপারি ছোট-বড় আলাদা করে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চট্টগ্রামের বারিয়ারহাট, হাজীরহাট ও সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন স্থানের আড়ৎ-রপ্তানিকারকদের কাছে নিয়ে তারা বিক্রি করেন। এছাড়াও মৌসুম শেষে যে সুপারিগুলো থেকে যায় সেগুলো পানিতে ভিজিয়ে (মজাই করে) বিভিন্ন দোকানে খুচরা বিক্রি করা হয়। এরমধ্যে কিছু সুপারি শুকিয়ে ৪০০-৫০০ টাকা করে প্রতি কেজি বিক্রি করা হয়।
তিনি আরও জানান, চট্টগ্রামে সুপারিগুলো পাঠাতে বস্তা (৪০ পন) প্রতি ১৪০ টাকা করে খরচ হয়। এছাড়াও প্রতি পন সুপারিতে আড়তদার ও রপ্তানিকারকদের ৩-৫ টাকা হারে কমিশন দিতে হয়। রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে এ সুপারি ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে বলেও জানান এ পাইকার।
চৌমুহনী বাজারের ব্যাংক রোডের পাইকার মেসার্স সুদর্শন সাহার ম্যানেজার কমল সাহা জানান, 'জেলার কয়েকটি পাইকার বাজারে সুপারির ভালো বেচাকেনা হলেও জেলার অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র চৌমুহনীতে সুপারির সরবরাহ কম এ মৌসুমে। চৌমুহনীর ব্যাংক রোডে সতিশ সাহা, জাহাঙ্গীর স্টোর, কাশেম মিয়া, আলম স্টোর, হকার্স মাকের্টে নজির মিয়াসহ আরও দুই জন পাইকার রয়েছেন'।
শনি ও মঙ্গলবার বাজারটিতে হাট বসলেও সুপারির বেচাকেনা কমে গেছে অনেকটাই। আগে প্রতিদিন ১৫-২০ বস্তা করে সুপারি ক্রয় হলেও এখন তা নেমে এসেছে ৩-৪ বস্তায়। বেগমগঞ্জ উপজেলায় সুপারির উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারের এ পরিস্থিতি বলে দাবী করেন তিনি।
চৌমুহনী বাজারের সুপারির অন্য পাইকারদের সঙ্গে কথা বললে তারাও জানান, নতুন নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে প্রতিবছর। এতে ঘরের জায়গা করতে বিভিন্ন এলাকায় কাটা পড়ছে সুপারির বাগান। এছাড়া এ ব্যবসায় নতুন প্রজন্মের আগ্রহও কম। এ কারণেও বাগান বিলুপ্ত হচ্ছে।
চৌমুহনী বাজারে সরবরাহ কমে যাওযার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, জেলার সদর উপজেলার পশ্চিম অঞ্চল থেকে সুপারি না আসা। ওইসব অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রামমুখী হওয়ায় এই বাজারে সুপারির সরবরাহ কমে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি বিপণন বাজার কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম তুষার জানান, 'বর্তমান মৌসুমে জেলার প্রতিটি বাজারে সুপারি প্রতি কেজি ৩৩০ টাকা থেকে ৩৫০টাকা হারে বিক্রি করা হচ্ছে। এ মূল্য প্রতি সপ্তাহে কিছুটা উঠা নামা করে'।
জেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আইয়ুব মাহমুদ জানান, 'নোয়াখালীর মাটি এবং আবহাওয়া কৃষি উপযোগী হওয়ায় এখানে সুপারির চাষ ভালো হয়। জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় কম-বেশি সুপারির উৎপাদন হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে সুপারির চাষের সাথে জড়িয়ে আছেন কয়েক শত কৃষক। এ মৌসুমে ১০৮৫ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৫৫০০ মেট্রিক টন সুপারি। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকার ও রপ্তানিকারকগণ নোয়াখালী থেকে সুপারি সংগ্রহ করেন'।