পাকিস্তানে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার মাদ্রাসার যাত্রা শুরু
বড় করে সফেদ ঘোমটা টেনে রানী খান (৩৪) পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করছেন। একা নন, তার সঙ্গে আরও অনেকে মেঝেতে বসে তিলাওয়াতে অংশ নিয়েছেন। এটি পাকিস্তানে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের জন্য স্থাপিত মাদ্রাসার ভেতরের দৃশ্য।
রানী খান সম্পূর্ণ নিজের সঞ্চয়ে এটি গড়ে তুলেছেন।
পাকিস্তানে উগ্র মৌলবাদীর সংখ্যা অনেক। সেখানে ট্রান্সজেন্ডাররা বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা মসজিদে নামাজ পড়ার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও ট্রান্সজেন্ডারদের সামাজিকভাবে পাকিস্তানে একঘরে করে রাখা হয়। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় লিঙ্গের একজন সদস্য হয়েও যেভাবে রানী নিজেদের জন্য মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন, তা এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
এ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সিমরান খান বলেন, 'আমি যখন কুরআন তিলাওয়াতে বসি, মনে অত্যন্ত প্রশান্তি অনুভব করি।'
আরেকজন (১৯) শিক্ষার্থী বলেন, 'অপমানের জীবন থেকে এখানে ঢের ভালো আছি।'
রানী খান (৩৪) বলেন, 'বেশিরভাগ পরিবার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে গ্রহণ করে না। বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নিরুপায় হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষ অন্যায় কাজে বাধ্য হয়।'
'এমনকি এক সময় আমিও তেমনই ছিলাম,' স্বীকারোক্তি দেন তিনি।
কান্না চেপে রানী স্মরণ করেন, কীভাবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার নিজের পরিবার তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। বেঁচে থাকার তাগিদে রানীকে তখন ভিক্ষা করতে হয়েছে।
১৭ বছর বয়সে একটি ট্রান্সজেন্ডার দলের সঙ্গে যুক্ত হন রানী। বিয়ের মতো বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নেচে বেড়াতেন তারা। কিন্তু রানী স্বপ্ন দেখছিলেন অন্য কিছুর। তাকে উৎসাহ যোগান আরেকজন হতভাগ্য ট্রান্সজেন্ডার বন্ধু এবং দলের সদস্য। তিনি রানীকে অনুরোধ করেন, এ সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করতে।
গত অক্টোবরে রানী দুই রুমের এই মাদ্রাসা খোলেন। তার আগে বিভিন্ন মাদ্রাসায় যাতায়াত করে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন, আবার কখনো ঘরেই নিজে নিজে নিয়েছেন কুরআনের শিক্ষা।
তার এই মাদ্রাসায় এখন ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের যে কেউ এসে নামাজ পড়তে, ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করতে এবং অতীত কৃতকর্মের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুতাপ প্রকাশ করতে পারে।
রানী বলেন, 'শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি কুরআনের পথ বেছে নিয়েছি। আমি আমার বর্তমান ও পরকাল- উভয় জীবন সুন্দর করতে চাই।'
রানী জানান, এ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে এই মাদ্রাসার জন্য তিনি কোনো সহায়তা পাননি; তবে কয়েকজন কর্মকর্তা এখানকার শিক্ষার্থীদের চাকরি খুঁজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে রানী কিছু অনুদান পেয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীদের সেলাই এবং সূচিকর্ম শেখাচ্ছেন, যেন এখানকার তৈরিকৃত পোশাক বিক্রয়ের মাধ্যমে মাদ্রাসার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা যায়।
পাকিস্তানের সরকার ২০১৮ সালে 'তৃতীয় লিঙ্গ' সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্য দিয়ে তারা ভোট প্রদানের মতো মৌলিক অধিকার লাভ করে এবং সরকারি নথিতে লিঙ্গ নির্বাচনের সুযোগ পায়।
তবু এখনো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পাকিস্তানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবেই জীবনযাপন করে। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়; ভিক্ষাবৃত্তি, নাচের মতো পেশা অবলম্বন করতে হয়। অনেকে আবার যৌনকর্মীর কাজ করে।
ইসলামাবাদের ডেপুটি কমিশনার হামজা শাফকাত বলেন, 'মাদ্রাসাটি ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষকে সমাজের মূলধারায় একীভূত হতে সহায়তা করবে।'
তিনি বলেন, 'আমি আশাবাদী, এ প্রতিষ্ঠানের মডেল অন্যান্য শহরেও স্থাপন করা হলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।'
গত বছর ঢাকায়ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রথম মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। পাকিস্তানের করাচিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের আরেকটি দল গির্জা স্থাপন করে।
২০১৭ সালের আদমশুমারি পরিসংখ্যান মতে, পাকিস্তানে ১০ হাজার ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। তবে ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মীদের মতে, দেশটিতে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যের সংখ্যা তিন লাখের বেশি।
- সূত্র: রয়টার্স