সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের তুলনায় চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব বেশি: কোভিড-১৯ নিয়ে নতুন শঙ্কা
প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে নতুন রোগী শনাক্ত এবং সংক্রমণ হার বাড়ছে। তবে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের তুলনায় বর্তমানে করোনাভাইরাস চিকিৎসার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এতে করে আরো রোগী ও মৃত্যু বাড়বে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করার তাগিদ তাদের।
গত মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৫৫৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গত বছরের ২ জুলাইয়ের পর এটিই ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। সংক্রমণের হার বেড়ে ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্ত সংখ্যা ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৪১।
রোগী সামলাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোগীর চিকিৎসার জন্য ঢাকা শহরে নতুন করে আরো ৬টি হাসপাতাল প্রস্তুত করছে। কিন্তু সংক্রমণ মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেই। সংক্রমণ মোকাবেলায় উপেক্ষিত কোভিড রোগীদের আইসোলেশন-কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশ ঠিকমত পালন করা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনাও অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছেনা।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এম মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সংক্রমণ রোধে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন, হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ও ভ্যাকসিন দিতে হবে। কিন্তু আমাদের হেলথ সেক্টর আইসোলেশন-কোয়ারেন্টাইন ভুলে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে সেটি অনেক ভালো। কারণ এতে মানুষ সচেতন হয়। কিন্তু প্রচারাভিযানের পাশাপাশি সংক্রমণ রোধে আইসোলেশন-কোয়ারেন্টাইন করতে হবে'।
ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, 'সরকার চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত করছে কিন্তু সংক্রমণ রোধে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করছে না। কোয়ারেন্টাইনে দশ টাকা খরচ করলে এক লাখ টাকা বেঁচে যাবে। রোগী কমলে সরকারের আইসিইউ খরচ কমে যাবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কাজ নয় সরকারের সব মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকা ধরে সংক্রমণ রোধে সবাইকে কাজ করতে হবে'।
এখন শুধু যুক্তরাজ্য ফেরত যাত্রীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে। এছাড়া কোভিড-১৯ রোগীদের আইসোলেশন-কোয়ারেন্টাইন এর খোঁজ রাখা হয় না।
ঢাকাস্থ সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মোঃ মঈনুল আহসান টিবিএসকে বলেন, 'এখন আমরা রোগীদের চিকিৎসার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয় সেজন্য হাসপাতালগুলোতে সিট বাড়ানো হচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে আমরা এখন কোন অভিযান চালাচ্ছি না। তবে হাসপাতাল ও বইমেলায় 'নো মাস্ক নো সার্ভিস' চালু আছে'।
করোনা সংক্রমণ আবারো বেড়ে যাওয়ায় সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) ১৪ মার্চ চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেই নির্দেশনার পর কিছু কিছু এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চট্টগ্রামে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সমুদ্র সৈকত, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্রে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট অভিযানের পাশাপাশি মানুষের মাঝে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মঙ্গলবার থেকে গণপরিবহনে যাত্রীদের মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে নগরীর তিনটি প্রবেশপথে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এছাড়া নগরীর কমিউনিটি সেন্টারে ১০০ জনের বেশি জনসমাগম করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, 'করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ২৫০টি শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। নির্দিষ্ট বেসরকারী ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোতে ৬০ থেকে ৭০টি আইসিইউ বেড রাখা হয়েছে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছেনা'।
গত ১৭ মার্চ এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, যেসব জায়গা থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে, সেই জায়গাগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে লাখ লাখ লোককে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাবে না। হাসপাতালে জায়গা হবে না। এতো সিট আমাদের নেই, কোনো দেশেই থাকে না। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানার আহ্বান জানান তিনি।
এখনো সচেতনতা তৈরিতে সীমাবদ্ধ প্রশাসন
'মাস্ক পরার অভ্যাস, করোনামুক্ত বাংলাদেশ' প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গত ২১ মার্চ থেকে দেশব্যাপী পুলিশের বিশেষ সচেতনতা কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এ কর্মসূচীর উদ্বোধনের সময় পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, 'সবাইকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক পরতে হবে, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে, প্রয়োজনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে'।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনগণকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, 'আমরা ঠিক 'বাধ্য' কথাটা বলছি না। আমরা তাদের প্রেষণা ও প্রেরণা দিয়ে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। তাছাড়া মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে কেন? মানুষ নিজের দায়িত্ববোধ থেকে নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য মাস্ক পরবে বলে আশা করছি।'
বড় রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিলসহ জনসমাগম হয় এমন নানা অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয় পুলিশ। করোনার কারণে অনুমতি দেয়া বন্ধ থাকবে কি-না, জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, 'অনুমতি দেয়ার বিষয়টি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। আমরা অনুমতি দিলেও প্রতিটি অনুষ্ঠানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তবে বেপরোয়াভাবে মাস্ক ছাড়া ঘোরাফেরা করতে থাকলে করোনা পরিস্থিতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে'।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, এরই মধ্যে ডিএমপির উদ্যোগে পুলিশ সদস্য ও সাধারণ জনগণের মাধে মাস্ক বিতরণ শুরু হয়েছে। গত রবিবার থেকে রাস্তায় নজরদারিও শুরু হয়েছে।
এদিকে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মতিঝিল সার্কেলের দায়িত্বে থাকা মাহনাজ হোসেন ফারিবা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিনি গত সপ্তাহ থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় জনগণকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
'আপাতত আমরা কাউকে মাস্ক ছাড়া পেলে ২০০ টাকা জরিমানা করছি, সে টাকা দিয়ে তাদের মাস্ক কিনে দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে অস্বচ্ছল ও দরিদ্র শ্রমজীবীদের বিনামূলে মাস্ক দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে প্রশাসন কঠোর হবে'।