গগন-রতনের বাড়ির কথা যে কারণে জানা দরকার
গগন-রতনের ছাউনি দেওয়া বাড়িটায় তখনো শহুরে জীবনের ব্যস্ততার ছোঁয়া লাগেনি। ১৯৫৩ সালে তৈরি করা 'শামসুদ্দিন কুঞ্জ' নামের বাড়িটি ঢাকার উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জের কলাতলী এলাকায় অবস্থিত। লোহার শিটের ছাউনি দেওয়া বাড়িটার আশেপাশে রয়েছে প্রচুর গাছপালা।
তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনগুলোতে এই বাড়িতে ছিল অন্য রকম এক পরিবেশ। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের পদচারণায় তখন মুখরিত থাকত বাড়িটি।
২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পর অনেক নেতা আশ্রয় নিয়েছিলেন এই বাড়িতে। আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর এ বাড়িতেই এলাকার তরুণরা এসে জড়ো হন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য।
এক মঙ্গলবারের বিকেলে যখন টিবিএস প্রতিনিধি প্রাঙ্গণে পা রাখলেন, বিকেলের সূর্যের আলোর নিচে তখন শান্তভাবে ঝিমুচ্ছে বাড়িটি। পাখির কিচিরমিচির ছাড়া অন্য কোনো সাড়া-শব্দও শোনা গেল না সেখানে।
বর্তমানে এই বাড়িতে থাকেন বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগনের স্ত্রী ইয়াকূত আরা আহমেদ।
১৯৭১ সালে ইয়াকূত আরা আহমেদ ছিলেন ২৪ বছর বয়সী এক নারী, আর এখন তার বয়স ৭২ বছর। দেয়ালে ঝোলানো দুটি ছবি আজও সেই পুরনো দিনের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।
ছবি দুটির মধ্যে একটি ছবি সাদা-কালো ও বাঁধানো, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরামকেদারায় বসে তার সামনে বসা দুই ছাত্রনেতা-তোফায়েল আহমেদ ও বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগনের কথা শুনছেন।
'বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ বিদ্রোহ করে ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু পলাতক ক্যাপ্টেনের একটা জায়গা দরকার ছিল লুকিয়ে থাকার জন্য। আর তার জন্য একটা বাড়িই ছিল তখন, সেটা এই গগন-রতনের বাড়ি। বঙ্গবন্ধু নিজে বেগকে নির্দেশ দেন এই বাড়িতে আশ্রয় নিতে,' বললেন ইয়াকূত আরা আহমেদ।
যদিও ক্যাপ্টেন বেগ এখানে আশ্রয়ের জন্যে এসেছিলেন, কিন্তু চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা তার স্বভাবে ছিল না। ৮ মার্চ থেকে তিনি এ বাড়িতে থাকতে শুরু করেন এবং এই অঞ্চলের তরুণদের সারাদিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।
ব্রিটিশ আমল থেকেই এ বাড়ির মালিক ছিলেন শামসুদ্দীন আহমেদ। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশরাজ তাকে 'খান সাহেব' উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন।
আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ (তোতা মিয়া), আরফান উদ্দিন আহমেদ রতন, বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগন ও হেলাল উদ্দিন আহমেদ মাখন নামে তার চার সন্তান ছিল। একমাত্র তোতা মিয়া বাদে বাকি তিন সন্তানই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গগন ছিলেন ছাত্রলীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। পরে তাকে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চের সেই কালরাতে ইয়াকূত আরা ঢাকায় ছিলেন। পরের দিন তিনি মাতুয়াইলে তার পিতৃগৃহে ছুটে যান নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়। এরই মধ্যে বহু নেতাকর্মী ঢাকা ছাড়েন এবং কেরানীগঞ্জে তার স্বামী গগনের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, এ এস এম আব্দুর রব, সেরাজুল আলম খান ও নূরে আলম সিদ্দিকীর মতো বিশিষ্ট নেতারা ২৫শে মার্চের পর থেকে এ বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, জানালেন তৎকালীন ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু।
মন্টুর কাছ থেকে আরও জানা গেল, ২৫শে মার্চের পর এখানে এসে আশ্রয় নেওয়া নেতারা পরে সবাই ভারতে চলে যান।
১৯৭১ সালে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট নূরে আলম সিদ্দিকী জানান, 'আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, যদি কোনো ক্র্যাকডাউন হয়, আমরা কলাতলীতে গগনের বাড়িতে সবাই একত্রিত হব। গগন ছিল আমাদেরই দলের লোক। গগন অথবা রতন, যেকোনো একজন তখন আইনি সভার সদস্য ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'কলাতলীতে পৌঁছানোর পর আমি, মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি), সেরাজুল আলম খান ভাই, শাহনেওয়াজ সিরাজ, এ এস এম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ আরও কিছু নেতাকে দেখতে পেলাম।'
মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় গগনকে ঢাকা জেলা অঞ্চলে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বানানো হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা-১১ আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।
তারা কোনো ভাই-ই আজ বেঁচে নেই। বাড়ির সামনে নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানেই শায়িত সকলে।