করোনা সংক্রমণের এক ভয়ংকর সপ্তাহ
দেশে প্রতিদিন করোনাভাইরাসে শনাক্তের নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। গত বছরের জুন-জুলাই মাসে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফার্স্ট ওয়েভ ছিল। সে সময়ও সংক্রমণ এত দ্রুত বাড়েনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এবার সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয় বাড়বে।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ৫৬ তম সপ্তাহ চলছে। এই সপ্তাহের প্রথম ছয়দিনে (২৮ মার্চ-২ এ্রপ্রিল) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩২,৭৮৮ জন, যা এখন পর্যন্ত এক সপ্তাহের কম সময়ে সর্বোচ্চ শনাক্ত। এ সময় প্রতিদিন গড়ে ৪৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই (সংক্রমণের ১৭ তম সপ্তাহ) পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল। সে সময় এক সপ্তাহে ২৫,৭০১ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ওই সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে নাগরিকদের অনেকের মাঝেই কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই যথাযথ নিয়ম মেনে মাস্ক পরছেন না। আবার কেউ কেউ মাস্ক পরলেও, শারীরিক দূরত্বের ব্যাপারে গাফিলতি সবার।
কোভিড-১৯ এর উদ্বেগজনক সংক্রমণের মধ্যেই গতকাল শুক্রবার ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৫টি কেন্দ্রে এমবিবিএস কোর্সের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় । সারা দেশে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আবেদন করেছিলেন।
এসময় প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিশাল ভিড় দেখা গেছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি বিভিন্ন খাতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও কোভিড নিয়ন্ত্রণে তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে ইতিমধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বাসে অর্ধেকসংখ্যক যাত্রী নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ যাত্রীরা সমবেত হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে করতে রাস্তায় নেমে আসছে, বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে রাখছে। যা তাদের কোভিড আক্রান্তের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ঠেকানো যাচ্ছে না সংক্রমণ
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমতে শুরু করে। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণ অনেক কমে গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণ হার ৩% এর নিচে নেমে এসেছিল। কোভিড ডেডিকেটেড বিভিন্ন হাসপাতালে নন-কোভিড রোগী ভর্তির পরিকল্পনা করছিলো সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে মার্চ মাস থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। ১০ মার্চ থেকে দিনে এক হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হওয়া শুরু হয়, এখন দৈনিক শনাক্ত ৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
এদিকে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৮৩০ জনের শরীরে। এটিই একদিনে সর্বাধিক শনাক্তের ঘটনা। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪।
অন্যদিকে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৯ হাজার ১৫৫।
গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণের হার ছিল ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ ও মৃত্যুহার ছিল ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অথচ এর আগের দিন বৃহস্পতিবারও সংক্রমণের হার ছিল ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ টিবিএসকে বলেন, 'মার্চের ১০ তারিখের পর থেকে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। এর আগে আমাদের হাসপাতালে দিনে ৬০-৭০ জন রোগী ভর্তি থাকত। এখন তা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আমাদের ৩২৯টি সাধারণ বেড ও ২৯টি আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই। প্রতিদিন রোগী ভর্তির জন্য প্রচুর আবেদন পাচ্ছি। এখন হাসপাতালে সিট বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জোর দিতে হবে'।
হাসপাতালগুলোতে বেড সংকট
রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালে আইসিইউ বেডের পাশাপাশি সাধারণ বেড সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালে একটি সিটের জন্য রোগীদের হাহাকার বাড়ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, 'প্রতিদিন বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সংক্রমণ বৃদ্ধিতে বেড়েছে মৃত্যুও। হাসপাতালে শয্যা বাড়িয়ে করোনা সামলানো যাবে না। এজন্য রোগ প্রতিরোধ করতে হবে, আর যেন মানুষ আক্রান্ত না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে'।
সংক্রমণের ধরনে পরিবর্তন
দেশে করোনা সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভে পরিবর্তন এসেছে সংক্রমণের ধরনে। একদিকে রোগী দ্রুত বাড়ছে আবার আক্রান্ত হওয়ার পরপরই রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবারের ওয়েভের আরেকটি পরিবর্তন হলো এখন অনেক তরুণ রোগী আইসিইউতে ভর্তি হচ্ছে।
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের (আইসিইউ) প্রধান ডা. মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'করোনার নতুন ওয়েভে সতর্কতামূলক পরিবর্তনটা হলো আগে রোগী আক্রান্ত হওয়ার ৮-১২ দিনের মধ্যে খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু এখন পজেটিভ হওয়ার দুই-তিন দিনের মধ্যেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আইসিইউতে অনেক খারাপ পর্যায়ের রোগীরা আসছে'।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, 'এবারের ভাইরাসের সংক্রমণের সামর্থ বেশি এবং দ্রুত রোগীর অবস্থা খারাপ করে ফেলে। সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে, এখন শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্রমণের ঢেউ নিচে নামানো যাবে না। আরো দেড় মাস আগে যদি স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দেয়া হত তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতি হত না। এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এই ৫টি শহরে ১৪ দিনের কারফিউ জারি করে সারাদেশ থেকে আক্রান্তদের আইসোলেটেড করতে হবে'।