কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ায় আবারও লোকসানের পথে হোটেল মালিকরা
মহামারির আঘাতে দীর্ঘ কয়েক মাস বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পর গত কয়েক মাস পর্যটকের সংখ্যা বাড়তে থাকায় স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিলেন দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে হোটেল মালিকরা। কিন্তু আবারও সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে আবারও বিপাকে পড়েছেন তারা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতসহ সব বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
হোটেল মালিকরা বলছেন, ইতোমধ্যেই গত বৃহস্পতিবারের এ ঘোষণার প্রভাব পড়েছে হোটেলগুলোর ওপর, অনেকেই আগাম বুকিং বাতিল করছেন।
গত কয়েক দিনে কর্তৃপক্ষ কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এবং চাটগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রও বন্ধ ঘোষণা করেছে। বন বিভাগ সুন্দরবনসহ বিভাগের আওতাধীন পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে।
স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী, বন্ধ থাকাকালীন কক্সবাজারে যে কোনো ধরনের গণ জমায়েত ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে হোটেলগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক অতিথি সহকারে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।
কক্সবাজারের বেশিরভাগ তারকা হোটেলগুলো বিগত কয়েক মাসে মহামারির পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম হলেও বর্তমানে তা ২০-৩০ শতাংশের বেশি নয়।
কক্সবাজারের জলতরঙ্গ পাঁচ তারকা হোটেলের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং প্রধান নিজাম উদ্দিন আল সুমন গত শুক্রবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এবছরের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে হোটেলের ধারণ ক্ষমতার ৮০ শতাংশ অতিথি ছিল আমাদের। তবে আবারও কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করার পর গত সপ্তাহ থেকে আমাদের ৫০ শতাংশ বুকিং বাতিল হয়ে যায়, গ্রাহকদের আগাম বুকিং এর অর্থ ফেরত দিচ্ছি আমরা,"
"আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে যাদের আসার কথা ছিল, তারা তাদের বুকিং এর সময় পরিবর্তন করছেন। আজ ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক অতিথি আছে আমাদের হোটেলে," বলেন তিনি।
"সাধারণ রমজান মাসে পর্যটকের সংখ্যা কমে আসে, কিন্তু ইদের সময় তা বেড়ে যায়। তবে ইদের ছুটির সময়ের বুকিং এখনো বাতিল করেননি গ্রাহকরা," যোগ করেন তিনি।
রয়্যাল টিউলিপ সী পার্ল বিচ রিসোর্টের ডিউটি ম্যানেজার বাপ্পি শুক্রবার টিবিএস-কে জানান, তাদের হোটেলের মাত্র ৩০ শতাংশ রুমে অতিথি আছে, অনেকেই তাদের বুকিং বাতিল করছেন।
কক্সবাজারের আরেকটি পাঁচ তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইজে ২০০ টি রুম আছে। গত ২৯ মার্চ হোটেলটির মাত্র ৩৫টি রুমে অতিথি ছিল, যা ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১৭.৫ শতাংশ।
"ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক অতিথি ছিলেন। কোভিড-১৯ সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করার পর আমরা করপোরেট ও ব্যক্তিগত সব ধরনের বুকিং হারাতে থাকি। এখনো এই ধারা অব্যাহত আছে," বলেন ওশান প্যারাডাইজের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু।
তিনি জানান, হোটেল প্রাঙ্গনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হোটেল মালিকরা প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মীকে ছুটিতে পাঠিয়েছেন।
"৭০-৭৫ শতাংশ ধারণ ক্ষমতা নিয়ে বিগত কয়েক মাসে ভালোই ব্যবসা করছিল তারকা হোটেলগুলো। কোভিড-১৯ সংক্রমণের নতুন ওয়েভের প্রভাব পড়ছে আবারও," যোগ করেন তিনি।
গত ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারিকৃত নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, হোটেল ও রেস্টুরেন্টের ধারণ ক্ষমতার ৫০ শতাংশ খালি রাখতে হবে। এছাড়া, পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে গণ জমায়েত বন্ধের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
বন্ধ কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে চলতি মাসে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকার প্রায় ১৩০টি হোটেল ও মোটেল অতিথি সংকটে পড়ে।
এরমধ্যেই পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন ২ সপ্তাহের জন্য কুয়াকাটার পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করে। ১-১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ নির্দেশনা জারি থাকবে।
নির্দেশনা অনুযায়ী, কুয়াকাটার সব আবাসিক হোটেল ও মোটেল আগাম বুকিং বাতিল করেছে। সব খাবারের দোকানও বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
"আমরা ইতোমধ্যেই সব হোটেল মালিকদের সরকারি ঘোষণার ব্যাপারে জানিয়েছি। অনেক পর্যটক ইতোমধ্যে কুয়াকাটা থেকে চলে গেছেন, সব আগাম বুকিংও বাতিল করা হয়েছে," বলেন কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব শরিফ।
পর্যটন হলিডে'র একজন কর্মী ভবেশ কর গত বুধবার টিবিএস-কে বলেন, "আজ আমাদের ৭৩টি রুমের মাত্র দুটি রুমে অতিথি আছে। গত বছরের জুলাইতে পুনরায় হোটেল খোলার পর নিয়মিত ২৫-৩০টি রুমে অতিথি ছিলেন।"
পার্বত্য অঞ্চলের হোটেল মালিদের ওপর কোভিড-১৯ এর নতুন ওয়েভের প্রভাব
গত বছরের ২১ আগস্ট বান্দরবানের, ২২ আগস্ট রাঙামাটির ও ১ সেপ্টেম্বর রাঙামাটির সাজেক ভ্যালির হোটেলগুলো পুনরায় খুলে দেওয়া হয়।
এসব পর্যটন কেন্দ্রের জেলা প্রশাসন আবারও পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে।
রাঙামাটি জেলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান টিবিএস-কে জানান, ১ এপ্রিল থেকে দুই সপ্তাহের জন্য জেলার সব পর্যটন কেন্দ্র বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন তারা। এই সময়ে হোটেল ও রিসোর্টগুলোতে কোনো অতিথির থাকার অনুমতি নেই বলেও জানান তিনি।
বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।
"গত সপ্তাহ থেকে কোভিড-১৯ এর নতুন ওয়েভের প্রভাব পড়েছে। বিগত দুই দিনে ধারণ ক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ অতিথি ছিলেন," গত ৩০ মার্চ টিবিএস-কে বলেন বান্দরবানের হিল ভিউ হোটেলের ম্যানেজার।
বিগত দুই মাসে হোটেলটির ধারণ ক্ষমতার ৭০-৮০ শতাংশই পূর্ণ থাকতো বলে জানান তিনি।
পর্যটন মোটেল খাগড়াছড়ির একজন কর্মকর্তা মং চি চৌধুরী বলেন, "গত বছরের সেপ্টেম্বরে পুনরায় হোটেল খোলার পর মহামারির আগের সময়েরও চেয়েও বেশি অতিথি পাই আমরা। কিন্তু গত মঙ্গলবার ধারণ ক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশ পূর্ণ ছিল,"
সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মঈন উদ্দিন খান টিবিএসকে বলেন, পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন বন্ধ রাখার সম্ভাবনা আছে। তবে এখনো তারা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
উপপ্রধান বন সংরক্ষক গোবিন্দ রায় জানান, তারা এবিষয়ে বন অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করছেন।
ঢাকার তারকা হোটেলগুলোতে মহামামারির পূর্ববর্তী অবস্থা ফিরে আসেনি
ঢাকার তারকা হোটেলগুলো ধারণ ক্ষমতার ৩০ শতাংশের বেশি পূর্ণ ছিল না। আগামী দিনগুলোতে এ হার আরও কমে আসবে এমনটাই আশঙ্কা হোটেল মালিকদের।
তারা জানান, ফ্লাইট সংকট ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক অতিথি পাচ্ছিলেন না তারা।
ঢাকা ওয়েস্টিনের পরিচালক (রেভেনিউ স্ট্র্যাটেজি) জানেআলম শাওন গত মঙ্গলবার বলেন, "গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ধারণ ক্ষমতার ৩০ শতাংশ পূর্ণ থাকতো আমাদের। মহামারির আগের সময়ের তুলনায় তা অনেক কম। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সামনের দিনগুলোতে এ হার আরও কমে আসবে।"
র্যাডিসন ব্লু ঢাকার পরিচালক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) শরফুদ্দিন নেওয়াজও একই ধরনের মন্তব্য করেন।