দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় নষ্ট হচ্ছে ভারতীয় ঋণের গ্রেস পিরিয়ড
চুক্তি দুর্বলতায় ৭৩৬ কোটি ডলারের ভারতীয় ঋণ সহায়তা লাইন অব ক্রেডিট বা এলওসির ৭৫ শতাংশ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
যে কোনো প্রকল্পের অর্থছাড়ের পরই পুরো এলওসি ঋণের পাঁচ বছেরের গ্রেস পিরিয়ড গণনা শুরু হয়ে যায়।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাথে ভারতের তিনটি এলওসি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রতিটি এলওসির আওতায় অন্তত ১৫ টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো প্রকল্পের অনুমোদন পাওয়া থেকে শুরু করে টেন্ডার চুক্তি বা কন্ট্রাক্টর নিয়োগে ভারতীয় অনুমোদন গ্রহণের জন্য প্রতিটি প্রকল্পকে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়।
কিন্ত নানা জটিলতায় এলওসির বেশির ভাগ প্রকল্পই বাস্তবায়ন পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই গ্রেস পিরিয়ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আর এ কারণে ভারতীয় ঋণ প্রকল্পে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।
গ্রেস পিরিয়ড হল সেই সময়, যখন ঋণ গ্রহীতাকে ঋণের আসল পরিশোধ করতে হয় না।
বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো বিভিন্ন বিদেশি সাহায্য সংস্থা, চীন এবং অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে গ্রেস পিরিয়ড সহকারে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে ঋণ পরিশোধিত হয়।
তবে, এলওসি প্রকল্পগুলোতে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা না পাওয়ার কারণে, প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কয়েকটি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে, গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা লাভের লক্ষ্যে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এলওসির ক্ষেত্রে প্রকল্প ভিত্তিক আলাদা চুক্তি করার বিষয়টি বিবেচনার দাবী করে বাংলাদেশ।
১০ বছর আগে স্বাক্ষরিত এলওসি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট চুক্তি সংশোধনেরও দাবি জানায় সরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) 'ফ্লো অব এক্সটারনাল রিসোর্সেস ইনটু বাংলাদেশ' প্রকাশনার তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ২৯ মার্চ, ভারত থেকে বিটিআরসির জন্য বাস কেনার একটি প্রকল্পে প্রথম এলওসির অর্থ ছাড় দেওয়া হয়। প্রথম এলওসি গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা ছিল ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত।
অপর এক এলওসি প্রকল্পে কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর রেললাইন পুর্নবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ পাঁচ বছরেও শুরু করা যায়নি। এর আগেই, পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে ধীরগতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম এলওসি ঋণের মাত্র ৪০ শতাংশ ঋণের ওপর গ্রেস সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ।
ভারতের সঙ্গে ৮৬২ মিলিয়ন ডলারের প্রথম এলওসি ঋণের চুক্তি সই হয় ২০১০ সালের ৭ আগস্ট। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ৬৩৭ মিলিয়ন ডলার অর্থছাড় হয়েছে, যা মোট ঋণের ৭৪ শতাংশ। প্রথম এলওসির ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে তিন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ এখনও শেষ হয়নি।
তবে ২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিতীয় এলওসি এবং ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের তৃতীয় এলওসির ৮০ শতাংশের বেশি ঋণের গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছে অর্থমন্ত্রণালয় ।
কারণ প্রথম এলওসির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে আট প্রকল্প ছিল ভারত থেকে বাস, রেল পরিবহন ও অন্যান্য পণ্য ক্রয় সংক্রান্ত। অন্য দিকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এলওসির প্রায় সব প্রকল্পই অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত।
প্রথম এলওসির প্রকল্প পর্যালোচনা দেখা গেছে, পণ্য ক্রয় সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থছাড়, অবকাঠামো প্রকল্পের চেয়ে তুলনামূলক দ্রুত হয়।
অবকাঠামো প্রকল্পের ডিপিপি (ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রণয়ন , অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং বাস্তবায়নে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে।
দ্বিতীয় এলওসির আওতায় জেলা পর্যায়ে আইটি/ হাইটেক পার্ক স্থাপন প্রকল্পের প্রথম অর্থ ছাড় হয় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। ফলে, দ্বিতীয় এলওসির গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা থাকবে ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর পযন্ত। তবে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় এলওসির অর্থছাড় মাত্র ৯৪ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের মাত্র ৪.৭২ শতাংশ। এ মুহূর্তে দ্বিতীয় এলওসির অধীনে কোনো প্রকল্প শুরু হলে তিন বছরের কম গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা পাওয়া যাবে ।
দ্বিতীয় এলওসি ঋণের চুক্তি সই হয় ২০১৬ সালের ৯ মার্চ। এর আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে মোট ১৫ প্রকল্প। এর মধ্যে ক্রয় সংক্রান্ত দুইটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। দুটি প্রকল্প চলমান আছে। বাকি প্রকল্পগুলো এখনও বাস্তবায়নে যেতে পারেনি বা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আটকে আছে।
একইভাবে, তৃতীয় এলওসির জন্য ২০১৯ সালের ২১ মে ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার ছাড় দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২১ মে পর্যন্ত গ্রেস সুবিধা থাকবে।
এলওসির আওতায় ১৬ প্রকল্পের বেশির ভাগেরই অনুমোদন প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি। ফলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেতে গ্রেস পিরিয়ড পার হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতের সঙ্গে এলওসি ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, নির্মাণ সামগ্রীসহ প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে আমাদানি করা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া ১ শতাংশ সুদ এবং ০.৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি দিতে হয়।
২০১০ সালের এলওসি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, তারা ধারণা করেছিলেন যে, দুই-এক বছরের মধ্যে অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে তারা মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে পারবেন। কিন্তু, বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় পক্ষেই অনুমোদন লাভের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার কারণে প্রথম এলওসিতে তা সম্ভব হয়নি। প্রথম বারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকল্পের সময় বিষয়টি সমাধান করা যেত বলেও জানান তিনি।
তবে, বিষয়টি অনুধাবন করতে ইআরডি অনেক সময় ব্যয় করে। দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এখনো প্রকল্প সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানের সম্ভাবনা আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি জানান, বাংলাদেশের উচিত ভারতের কাছে এলওসি ঋণের জন্য প্রকল্পভিত্তিক গ্রেস পিরিয়ড দাবি করা।
ইআরডির সচিব ফাতেমা ইয়াসমিন এবং যুগ্ম সচিব ও উইং চিফ (এশিয়া) মোহাম্মদ শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করে রাজি হননি।
তবে অর্থমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে যে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে উচ্চ পর্যায়ে মনটিরিং সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্রেস পিরিয়ডের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়।
একই সাথে গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা লাভের লক্ষ্যে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এলওসির ক্ষেত্রে প্রকল্প ভিত্তিক আলাদা চুক্তি করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানানো হয়।
তবে ভারত জানায় যে, বর্তমানে চলমান তিনটি এলওসির আওতায় প্রকল্প ভিত্তিক আলাদা ঋণচুক্তি করা সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে স্বাক্ষরিত এলওসির ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রেস পিরিয়ড দেওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার পর, এর থেকে সুফল নিয়ে ঋণের আসল পরিশোধ করা। কিন্ত এখানে দেখা যাচ্ছে যে, বাস্তবায়ন পর্যায়ে আসল দিতে হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে ভারতীয় ঋণের প্রকল্পগুলোর জন্য আলাদা আলাদা চুক্তি হওয়া দরকার বলে জানান তিনি। তা না হলে প্রকল্প বাংলাদেশ গ্রেস সুবিধা আদায় করতে ব্যর্থ হবে।
এ বিষয়ে দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।