বন্ধক নিয়ে বেকায়দায় ব্যাংক
১৯৯১ সালে উত্তরা ব্যাংকের মতিঝিল বাণিজ্যিক শাখা থেকে ২৭ কোটি টাকা ঋণ নেয় পলিমার প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ঋণ পরিশোধ না করায় ২০০০ সালে সুদে আসলে ওই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১ কোটি টাকা।
ঋণ চুক্তির সময় ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানটি ২৭ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি ব্যাংকটির কাছে বন্ধক রাখে।
ঋণ পরিশোধ না করায় ২০০০ সালে পলিমার প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড কে খেলাপী ঘোষণা করে ঢাকার একটি অর্থঋণ আদালতে মামলা করে উত্তরা ব্যাংক। ২০০২ সালে এই মামলায় ব্যাংকটি পক্ষে রায় পায় এবং বন্ধক রাখা সম্পত্তি নিলামের আদেশ দেন আদালত।
কয়েক দফা নিলামের নোটিশ দেওয়া হলেও নিলাম ক্রয়ের জন্য কেউ অংশগ্রহণ না করায় ২০০৩ সালে ব্যাংকটির আবেদনের প্রেক্ষিতে পলিমার প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের বন্ধক রাখা সম্পত্তি উত্তরা ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করে সার্টিফিকেট দেন আদালত।
ব্যাংকটির আইন বিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঋণ চুক্তির সময় যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল, সেই পরিমান ঋণের সমমূল্যের সম্পত্তি বন্ধক রেখেছিল পলিমার প্যাকেজিং। কিন্তু সুদে আসলে ৪১ কোটি টাকা পাওনা হলেও, রাজধানীতে পলিমারের চারটি সম্পত্তি ২০০৪ সালে বিক্রয় করে উত্তরা ব্যাংক আদায় করতে পেরেছে ৩১ কোটি টাকা। বাকি দশ কোটি টাকা ব্যাংকটি আদায় করতে পারেনি। ফলে ব্যাংকটি ওই দশ কোটি টাকা আদায়ে ২০০৪ সালে অর্থঋণ আদালতে আরেকটি মামলা করেছে ব্যাংক'।
তিনি বলেন, 'পলিমার প্যাকেজিং ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করে দশ কোটি টাকার মামলাটি স্থগিত করে রেখেছে। রিটে বলা হয়েছে তাদের ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। তিনি বলেন, ফলে এখন পর্যন্ত ওই দশ কোটি টাকা আদায়ের সম্ভাবনা খুব কম'।
তিনি জানান, আবার অনেক সময় সুদের টাকা মাফ করে দেয় ব্যাংক।
শুধু উত্তরা ব্যাংক নয়, ২০১১ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার চারটি অর্থ ঋণ আদালত এরকম ১১ হাজার মামলা চূড়ান্ত নিস্পত্তি করে বিভিন্ন ব্যাংককে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বন্ধক রাখা সম্পত্তি হস্তান্তর করে সার্টিফিকেট দিয়েছে।
ব্যাংক ও কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমেদ ভুঁইয়া টিবিএসকে বলেন, 'নিলামের রায় বা আদেশ হওয়ার পর সাধারণত নিলাম ক্রয়ের জন্য কোনো দরদাতা পাওয়া যায় না। ফলে ব্যাংকগুলো যে ৬০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বন্ধক রাখা সম্পত্তি আদালতের মাধ্যমে দখলে পেয়েছে, তা বিক্রয় করে বা দখলে রেখে ব্যাংকগুলো শুধু মূল ঋণের টাকা তুলতে পেরেছে। বাকি টাকা অনেক সময় আদায় হয় না'।
তিনি বলেন, 'অর্থ ঋণ আইন অনুযায়ী ব্যাংকের দাবীর বাকি টাকা আদায়ের জন্য পুনরায় মামলা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় খেলাপিদের বন্ধক রাখা সম্পত্তির বাইরে অন্য সম্পত্তি নিলামে উঠানোর রায় দেন'।
তিনি বলেন, দেখা যায় বেশীরভাগ সময় পরবর্তীতে দায়ের হওয়া মামলা হাইকোর্টে রিট করে স্থগিত করে খেলাপিরা। দীর্ঘদিনেও সেগুলো নিষ্পত্তি হয়না।
ঢাকার আদালত সূত্রে জানা যায়, গত দশ বছরে চারটি অর্থঋণ আদালতে এরকম প্রায় ৭ হাজার মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়েছে। যেসব মামলার বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আটকানো।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমাদের আইনি প্রক্রিয়া বেশ জটিল। মূল ঋণ ও সুদের দাবীসহ যখন ব্যাংক মামলা করে, ওই মামলার রায়ে ব্যাংকের পুরো দাবী একসাথে আদায়ে আদালত রায় বা আদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে এই জটিলতা কিছুটা কমে আসতো'।
তিনি বলেন, ব্যাংক মূলত মামলা করে পুরো দাবী আদায়ের জন্য, কিন্তু আইন অনুযায়ী ব্যাংকের কাছে রেজিস্ট্রি মূল্যের যে সম্পত্তি বন্ধক থাকে আদালত প্রথম রায়ে শুধু সেটিই নিলামে উঠানোর আদেশ বা রায় দেন।
বন্ধক থাকা সম্পত্তি বিক্রয়ের পর ব্যাংকগুলোকে আবার নতুন করে মামলা করতে হয় দাবীর বাকি টাকা আদায়ের জন্য। সেই মামলা দিনের পর দিন ঝুলে থাকে নানা কারণে। বেশীরভাগ সময় ব্যাংকগুলো এই টাকা আদায় করতে পারার ঘটনা বেশ দুর্লভ।
গত বছর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের খেলাপির তালিকায় নাম ওঠে এইচআরসি গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈদ হোসেন চৌধুরীর। সাঈদ হোসেন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের এইচআরসি শিপিং লাইনসের কাছে সুদসহ ব্যাংকটির মোট পাওনা ১২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
অর্থঋণ আদালত আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী খেলাপি ঋণের টাকা আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি সম্পত্তি একাধিকবার বিক্রয়ে চেষ্টা করেও ক্রেতা পায়নি ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির আইন বিভাগের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ঋণ নেওয়ার জন্য বন্ধক রাখা সম্পত্তির বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৩০ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকের পাওনা ১২১ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৫৪ টাকা। এজন্য এ সম্পত্তি কেউ কিনতে আগ্রহী নন।
ফলে টাকা আদায়ে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে ব্যাংকটি।
এবি ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেয় কেএম আহমেদ নামের এক ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে সুদে আসলে এই ঋণ হয় দুই কোটি টাকা। রাজধানীর ভাটারা এলাকায় ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা একটি বাড়ি ব্যাংকটির কাছে ২০০৩ সালে হস্তান্তর করে ঢাকার অর্থঋণ আদালত।
ব্যাংকটির আইনজীবী মোহাম্মদ নিজামী টিবিএসকে বলেন, 'ওই বাড়িটি ২০০৬ সালে বিক্রয় করে ব্যাংক এক কোটি ৪০ লাখ টাকা উঠাতে সক্ষম হয়েছে। দাবীর বাকি টাকা ব্যাংকটি মওকুফ করে দিয়েছে'।
নিলাম ঠেকাতে হাইকোর্টে
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিলাম ঠেকাতে প্রায় ৫৬০০ রিট দাখিল করে খেলাপিরা। হাইকোর্ট সূত্র জানিয়েছে এসব রিটের মধ্যে বিভিন্ন কারণে ১৩০০ টি নিলাম স্থগিত করে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক টিবিএসকে বলেন, 'নিলাম ঠেকানোর জন্য কোনো রিট হলে সুপ্রিম কোর্টের একটি অলিখিত প্রথা রয়েছে, রিটকারীদের পক্ষে আদেশ না দেয়ার জন্য। ফলে রিট করে তেমন সুফল পায়না খেলাপিরা'।
তিনি বলেন, তবে যেসব নিলাম হাইকোর্ট স্থগিত করেছে তার পিছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। অনেক সময় অর্থঋণ আদালত আইন অনুযায়ী মামলা করার আগেই ব্যাংক বা অর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্ধক থাকা সম্পত্তি নিলামে উঠানো হয়। সেই নিলাম স্থগিত চেয়ে রিট করলে হাইকোর্ট অনেসময় রিটকারীর পক্ষে আদেশ দেন। তবে অর্থঋণ আদালত মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে বন্ধক নিলামে উঠালে বা বন্ধক থাকা সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করলে, তার বিরুদ্ধে রিট কার্যকর নয়।
সিকিউরিটি চেক সংক্রান্ত মামলা
কোম্পানী আইন বিশেষজ্ঞ শাহ মোহাম্মদ আহসানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এক সময় ব্যাংকগুলো শুধু সম্পত্তি বন্ধকের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করত। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে সম্পত্তি বন্ধক নেওয়ার পাশাপাশি সিকিউরিটি চেক নেয় ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে সুবিধা হলো, ব্যাংক যখন দেখে শুধু বন্ধক থাকা সম্পত্তি বিক্রয় করে সুদে-আসলে ব্যাংকের দাবী আদায় সম্ভব নয়, তখন অর্থঋণ আদালতে মামলার পাশাপাশি ব্যাংকের কাছে থাকা সিকিউরিটি চেক ডিজঅনার করে এনআই অ্যাক্ট অনুযায়ী মামলা করে'।
তিনি বলেন, ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলার পাশাপাশি এনআই এক্টে মামলা করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন এক ব্যবসায়ী। সাম্প্রতিক হাইকোর্ট রায় দেন, অর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূল ঋণসহ সুদের দাবী আদায়ে চেক ডিজঅনারের মামলা ও অর্থ ঋণ আদালতের মামলা একইসঙ্গে চলতে কোনো বাধা নেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।
ফলে, সিকিউরিটি চেক ডিজঅনার করে মামলার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো এখন ভালো ফল পাচ্ছে।
এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিআইএসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা,মোহাম্মদ এ. (রুমী) আলী টিবিএসকে বলেন, 'খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলার যে দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে, তা কমাতে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়াও এসব খেলাপিঋণ সংক্রান্ত যেসব মামলা হাইকোর্টে দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন রয়েছে, সেগুলো নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যে অনুরোধ রয়েছে তা বাস্তবায়ন করলে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের পাওনা আদায়ে সুফল পাবে'।