আইসিইউর জন্য হাহাকার
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় মুমূর্ষু কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ বেডের চাহিদা বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে একটি আইসিইউ বেডের জন্য অপেক্ষমান রোগী তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। কেউ সুস্থ হলে বা মারা গেলে একটি বেড খালি হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে সেটিতে রোগী ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তাই বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে আইসিইউ না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে দেয়া হচ্ছে। বাইরে থেকে আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা কঠিন হয়ে পড়ছে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে অনেক চেষ্টা করে কেউ কেউ বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী ভর্তি করতে পারছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে খরচ অনেক বেশি। সেই খরচ মেটাতে মানসিক ও আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে রোগীর স্বজনেরা।
গত ১৬ দিন আগে কোভিডে আক্রান্ত হন মো. কামরুজ্জামান। পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যবসায়ী শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে গত এক সপ্তাহের বেশি ধানমন্ডির রেনেসাঁ হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ লিমিটেডে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ভর্তি ছিলেন আইসিইউতেও। কিন্তু সম্প্রতি শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে বাসায় চলে গিয়েছিলেন। বুধবার আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আইসিইউয়ের প্রয়োজন হয় তার। আগের হাসপাতালে আইসিইউ সিট খালি না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি। সেখানেও কোন বেড খালি না পেয়ে রোগী নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে বেড খুঁজছেন স্বজনেরা।
সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে বেড ভাড়া, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন ওষুধ ফ্রিতে দেয়া হয়। প্রয়োজনীয় কোন ওষুধের সাপ্লাই না থাকলে সেটি কিনতে হয়। বিপরীতে হাসপাতালভেদে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর একদিনের আইসিইউ ব্যায় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। এর বাইরে ওষুধ বা ইনজেকশন কিনতে আলাদা অর্থ ব্যয় করতে হয়।
ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউয়ের অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট ডা. অনিরুদ্ধ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে একজন রোগী অক্সিজেন থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ ফ্রি পায়। রেমডিসিভির বা অন্য জরুরি কোন ওষুধের সাপ্লাই না থাকলে তা কিনতে হয়। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে তুলনামূলক অনেক কম খরচে চিকিৎসা নিতে পারেন রোগীরা। এখানে যদি দিনে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় বেসরকারি হাসপাতালে সেটি দিনে ৫০ হাজারের বেশি। বেসরকারি হাসপাতালে বেড ভাড়া, অক্সিজেন, ডাক্তারের রাউন্ড, ওষুধ সব আলাদা আলাদা করে বিল করা হয়'।
ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, 'আমাদের হাসপাতালের আইসিইউতে এখন একটি বেডও খালি নেই। আইসিইউতে এখন একটি বেডের বিপরীতে ২০-৩০ জন রোগী অপেক্ষায় থাকেন। এর আগের ওয়েভে পরিস্থিতি এতোটা ভয়াবহ ছিল না। আইসিইউ বেডের অভাবে রোগীরা ওয়ার্ডে মারা যাচ্ছে, আমাদের কিছুই করার থাকছে না'।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুধবারের তথ্য অনুসারে, সারাদেশে ৬০২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি আছে ১৬৯টি বেড। আর ঢাকার কোভিড ডেডিকেটেড সরকারি-বেসরকারি ১৯টি হাসপাতালের ২৮৫টি আইসিইউ এর মধ্যে বেড খালি আছে মাত্র ২০টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে মাত্র ১১টিতে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড খালির তথ্য দিচ্ছে, সেগুলোতেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আসলে কোন বেড খালি নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে চারটি বেড খালি আছে ।
কিন্তু ইউনাইটেড হাসপাতালের যোগাযোগ ও ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ডা. শাগুফা আনোয়ার টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের হাসপাতালে আইসিইউতে কোন বেড খালি নেই। প্রতিনিয়ত জেনারেল বেড ও আইসিইউ বেডের জন্য ভিআইপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সোসাইটি, এমব্যাসির অনুরোধ পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কিছুই করার থাকছে না। সবাইকে আমাদের অপেক্ষায় রাখতে হচ্ছে'।
ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে দিনে একজন রোগীর এক লাখের বেশি টাকা খরচ হয় বলে জানান ডা. শাগুফা আনোয়ার। তিনি বলেন, 'কোভিডের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। হাসপাতালের বেড খরচ সাড়ে আট হাজার টাকা, কিন্তু দিনে দুই-তিনজন ডাক্তারদের রাউন্ড, অক্সিজেন, ওষুধ, ইনজেকশনের ব্যয় অনেক বেশি। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে বিশেষ ধরণের সাইটোসার্ব ডায়ালাইসিস দিতে হয়। এ ডায়ালাইসিস একেকটির খরচ ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, একেকটি ইনজেকশনের দাম ৯২ হাজার টাকা। যদি দামি ওষুধ বা ইনজেকশন না লাগে শুধু অক্সিজেন প্রয়োজন হয় তাহলে আমাদের হাসপাতালে একজন রোগীর দিনে খরচ হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা'।
বেসরকারি হাসাতালের আইসিইউ ব্যয় বেশি হলেও পরিস্থিতির অবনতি বিবেচনায় আইসিইউ বিল কমানো বা সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কোন চুক্তি করার পরিকল্পনা নেই বলে জানান বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মবিন খান।
তিনি বলেন, 'সরকার কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিতে আমাদের হাসপাতালগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউ বেড বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। আমরা আমাদের সামর্থ অনুযায়ী আইসিইউ বেড বাড়ানোর চেষ্টা করছি। খরচ কমানোর বিষয়ে আমাদের কোন পরিকল্পনা নেই'।
তিনি আরো বলেন, 'চাইলেই রাতারাতি অনেক আইসিইউ বেড বাড়ানো সম্ভব নয়, কারণ আইসিইউ পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন, অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়। সংক্রমণের উৎপত্তি বন্ধ করতে না পারলে শুধু হাসপাতালে বেড বাড়িয়ে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে না'।
সংক্রমণ বাড়ায় রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বাড়ানো হয়েছে, তবু পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, 'এ বছরের মার্চে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আরও ১০০টি আইসিইউ বেড সংযুক্ত করেছি। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ বেড বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেট হাসপাতালে ২০০টি আইসিইউ বেড স্থাপনের কাজ চলছে'।
বুধবার স্বাস্থ্য দিবসের এক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, 'সংক্রমণ বাড়ায় সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকে সেবা পাচ্ছেন না। হাসপাতালগুলোতে সাধারণ ও আইসিইউ অনেক বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা কোভিড নিয়ন্ত্রণ করতে পাচ্ছিনা। এ দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সরকারের ১৮ নির্দেশনা ও লকডাউন মানতে হবে। তা হলে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো। কিন্তু আমরা যদি বেপরোয়া হয়ে যাই, আজ যা করবো কাল তার ফল পাবো'।
হেলথ ইন্সুরেন্স
সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য 'হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি ২০১২-২০৩২' প্রণয়ন করেছিল সরকার। ২০১২ সালে প্রণীত এই কৌশলপত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা ছিল তাতে। ২০১৩ সালে ওই প্রকল্প শুরুর কথা থাকলেও তার তিন বছর পর টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় এসএসকে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে সরকার। ২০১৭ সালে ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলাকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়।
এই প্রকল্পের আওতায় তিন উপজেলার ৮১ হাজার দরিদ্র পরিবারকে একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দেওয়া হয়েছে। ওই কার্ড দেখিয়ে ওইসব পরিবারের সদস্যরা ৭৮টি রোগের চিকিৎসা ও ওষুধপথ্য বিনামূল্যে পাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে সরকার বছরে এক হাজার টাকা প্রিমিয়াম দেয়। বিনিময়ে প্রতিটা পরিবার বছরে ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসা সুবিধা পায়। বেসরকারি হাসপাতালে কোন টেস্ট করা হলে সেই ব্যয়ও এই প্রকল্প থেকে পরিশোধ করা হয়। সফলভাবে পাইলটিং শেষে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার কথা থাকলেও সে বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেই।
বীমাখাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবীমা গ্রহীতার সংখ্যা খুবই কম। তবে যাদের স্বাস্থ্যবীমা করা আছে, তারা কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করলে বীমা সুবিধা পাবেন। কোভিডকেন্দ্রিক নতুন নতুন সেবা চালু করতে বীমা কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করছে ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট এন্ড রেগুলেটরি অথরিটি (ইডরা) ও বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স এসোসিয়েশন।
ইডরার চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিদ্যমান হেলথ ইন্সুরেন্স কাভারেজের আওতায় কোভিড আক্রান্তরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তার বীমা সুবিধা পাবেন। তবে কোভিড-১৯কে মাথায় রেখে আলাদা হেলথ ইন্সুরেন্স হওয়া উচিত। শুধু করোনাক্রান্তদের চিকিৎসা কিংবা মৃত্যুই নয়, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকের কিডনি, হার্ট ও স্নায়বিক সমস্যা হচ্ছে। এজন্য কোভিকেন্দ্রিক ইন্সুরেন্স প্রোডাক্ট চালু করতে কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করছি আমরা'।
সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে এখনও কোন অগ্রগতি নেই। এমনকি সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সরকারিভাবে স্বাস্থ্যবীমা করার একটি উদ্যোগ ছিল। এ বিষয়ে কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়ায় তা আটকে আছে'।
বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরাও বীমা কোম্পানিগুলোকে কোভিড সংশ্লিষ্ট নতুন প্রোডাক্ট চালুর ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছি। এখন যাদের স্বাস্থ্যবীমা করা আছে, তারা কোভিড আক্রান্ত হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে বীমা কাভারেজ পাবেন'।
কোভিড আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে তিনি বীমা সুবিধা পাবেন কি-না, জানতে চাইলে জীবন বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহুরুল হক টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এ বিষয়ে একচুয়ারির মতামত চেয়েছি। দেশে একচুয়ারির সংকট থাকায় আমরা অস্ট্রেলিয়ার একজন একচুয়ারির মতামত নিয়ে থাকি, তিনিই আমাদের গাইডলাইন প্রণয়ন করে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন মতামত পাইনি। তার মতামত ছাড়া এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না'।