ভাইরাসের পুনরুত্থানে বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা
গত বছর মার্চে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থার উপর নেমে আসে কড়াঘাত।
দীর্ঘ এক বছর পর মহামারির প্রকোপ কমে আসার লক্ষণ দেখা যায়। সেই সাথে ইতিবাচক আশাবাদ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
কিন্তু ভাইরাসের পুনরুত্থানে সে আশাও দীর্ঘস্থায়ী হল না। করোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের কারণে প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যক সংক্রমণ ও মৃত্যুহার প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশ।
সরকার একই সাথে সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতি রক্ষার মাধ্যমে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করলেও জরুরি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা তাদের কঠিন লকডাউন প্রণয়নে বাধ্য করেছে।
উদ্যোক্তারা আবারও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিনাশ আরও কতদূর বিস্তার লাভ করবে তা কেউ জানেন না।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান জানান, "ভাইরাস দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচির ব্যাপক সাফল্যে আমরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আমরা অনেক আগেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম।"
"জীবন বনাম জীবিকার দ্বন্দ্ব আবারও এক কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে," বলেন তিনি।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) বর্তমান সভাপতি আবুল কাশেম খান আরও জানান, "২০২০ সাল থেকে শুরু হওয়া চাহিদার পতন এখন একটি বড় উদ্বেগের কারণ। জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার কারণে যেটুকু চাহিদা আছে, তার যোগান দেওয়াও এখন আরেকটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
গত বছরের লকডাউনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক দফা লকডাউনের প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শেয়ার বিনিয়োগকারীরা।
২০২০ সালের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ঢাকা ও চট্টগ্রাম পুঁজিবাজারে ধস নামে। বাড়তি ক্ষতি এড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আলাদাভাবে প্রতিটি শেয়ারের ফ্লোর প্রাইজ (সর্বনিম্ন মূল্যস্তর) নির্ধারণ করে।
২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে নিম্ন ইন্টারেস্ট রেট বা সুদহারের মাধ্যমে বাজার আগের রূপে ফিরে আসে, সেই সাথে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিতও মিলে।
তবে, ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে শেয়ার বাজারের লেনদেন সাম্প্রতিক নিম্নাহারেরও নিচে নেমে আসে।
লকডাউনের ঘোষণার ফলে গত রবিবার লেনদেন বেড়ে মুহূর্তেই চাঙ্গা হয়ে উঠে পুঁজিবাজার। ৫ এপ্রিল থেকে আংশিক লকডাউনের বিষয়টি বিনিয়োগকারীরা জানার পর, পরবর্তী তিন সেশনে বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়।
তবে, বৃহস্পতিবার সংক্রমণ হার বাড়তে থাকার পাশাপাশি কঠোর লকডাউন ঘোষণায় বাজার পুনরায় নিম্নমুখী হতে শুরু করে। শুক্রবার ঘোষিত 'কঠোর' এই লকডাউন ১৪ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
এখন পর্যন্ত দূরপাল্লার বাস ছাড়া সকল পরিবহন চলাচল অব্যাহত আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানাগুলোও পুরোদমে সচল আছে। আংশিক কর্মীদের উপস্থিতিতে অফিসগুলো পরিচালিত হচ্ছে। সীমিত সময়ের জন্য সকল খুচরা দোকানপাট খোলা আছে।
১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হলে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সতর্কবার্তা:
গত বছরের ৬৬ দিনের লকডাউনের রেশ ব্যবসায়ীরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। হাজারো মানুষের চাকরিচ্যুতি, লাখো মানুষের উপার্জন হ্রাসসহ হাজার হাজার কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দিয়েছিল সেই লকডাউন। অধিকাংশ বৃহদাকার করপোরেট প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশেও নেমে এসেছিল কড়াঘাত।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেকচারারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি এবং বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফেকচারারস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, "মহামারির পুনরুত্থানে বাণিজ্য ব্যবস্থা নতুন করে ধাক্কা খাবে। বিষয়টি অনেকটা সেরে ওঠা ক্ষততে নতুন করে আঘাতের মতো।"
শহীদুল্লাহ আরও জানান ২০২০ সালের লকডাউনে সিমেন্ট এবং স্টিল মিলগুলো গড়ে তাদের কার্যক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কাজে লাগাতে পেরেছিল। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গত বছরের শেষ নাগাদ তা বেড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
তবে নির্মাণ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনো আনুষ্ঠানিক বিধিনিষেধ না থাকলেও গত সপ্তাহে নতুন প্রতিবন্ধকার ফলে সিমেন্ট কারখানার কার্যক্ষমতার ব্যবহার তাৎক্ষণিকভাবেই গড়ে ৬০ শতাংশে নেমে আসে বলে জানান তিনি।
শহীদুল্লাহ আরও জানান, আরেকটি পূর্ণাঙ্গ লকডাউন দেওয়া হলে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। পরপর দুবছর ক্রমাগত ধাক্কায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অটোমোবাইল, টেক্সটাইল, চা এবং আর্থিক খাতের সাথে যুক্ত উত্তরা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মতিউর রহমান জানান, "গতবার, মূলত কর্মীদের দৃঢ়তা এবং সরকারি প্রণোদনা সহায়তার কারণে অধিকাংশ উদ্যোক্তা কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমাগত ধাক্কার দুশ্চিন্তা আমাদের খাদের কিনারায় ঠেলে দিচ্ছে।"
চাহিদার পুনরুদ্ধার কিছু প্রতিষ্ঠানকে বছর শেষে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করেছে।
সরবরাহে ব্যাঘাত:
শুধু চাহিদার ঘাটতিই নয়, মহামারির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাতেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ, ২০২০ সালের জুনে মোটরসাইকেল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাসিক বিক্রি রেকর্ড হার অর্জন করলেও খাতটিতে পুনরায় ছন্দপতন ঘটে। ভারতের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক সরবরাহে ফিরতে দেরী করায় স্থানীয় নির্মাণ কারখানাগুলো কাঁচামাল এবং পার্টস সংকটে পড়ে।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলারস অ্যান্ড ম্যানুফেকচারারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর আরও জানান, "এবারের লকডাউন যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় আমরা সেই প্রার্থনাই করছি।"
এবছরের মার্চ মাসে, মোটরসাইকেল প্রতিষ্ঠানগুলো ৬০ হাজার ইউনিটের বেশি বিক্রি করতে সমর্থ হয়। গত বছরের মার্চের তুলনায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ।
২০২০ সালে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হেলথ ড্রিংক ব্র্যান্ড হরলিক্সের বিক্রয় হ্রাস পায়। তবে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে নয়, বরং লকডাউন শেষ হলেও পণ্যটির অসম্পূর্ণ কাঁচামালের ঘাটতির কারণে সংকটের সৃষ্টি হয় বলে জানান ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেডের পরিচালক মাসুদ খান। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনকে অধিগ্রহণ করে।
স্থানীয় হরলিক্স প্ল্যান্টের পরিবেশনার দায়িত্বে আছে ভারতীয় আঞ্চলিক প্ল্যান্ট। ভারত দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন তুলে ফেলার পরও সংক্রমণের কারণে প্ল্যান্টটির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পুনরায় কারখানা ও বিতরণ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবারও স্বাভাবিক গতি হারাতে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ধসের মুখে টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প খাত:
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, "২০২০ সালের উৎপাদন, বিক্রি ও লাভের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলো দেশের টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে, ক্রমাগত আঘাতে নিম্ন প্রফিট মার্জিনের ব্যবসাগুলো ধসে পড়বে।"
পোশাক রপ্তানিকারকরা গড় কার্যক্ষমতা প্রয়োগের দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ক্রয়াদেশগুলো ঠিকমতো আসত। তবে সম্ভবত সেই দিনও শেষ হতে চলেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অন্যদিকে, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা এপ্রিল ও মে মাসে পহেলা বৈশাখ ও ঈদ-ঊল-ফিতরকে কেন্দ্র করে বেচাকেনার বৃহৎ মৌসুমের অপেক্ষায় ছিলেন। এবার এই ব্যবসায়ীরা সবথেকে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছেন। ২০২০ সালের ক্ষয়ক্ষতির জন্যও তারা কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি।
যানজট এবং মানুষের অতিরিক্ত ভিড় এড়াতে ব্যাংক, অফিস এবং খুচরা দোকান চালু রাখার সময়সীমা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন মোহাম্মদ আলী খোকন।
ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান জানান, "জীবন ও অর্থনীতি রক্ষা এখন পরস্পর বিপরীতমুখী ধারণা। তবে, আমাদের দুই দিকই সামাল দিতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "প্রত্যেকের দায়িত্বশীল আচরণ দেশকে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থা এবং সবথেকে জরুরি মানুষকে খরচে উৎসাহিত করতে সরকারের উচিত আর্থিক উদ্দীপনার ব্যবস্থা করা।"
৫৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান আরএফএল গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক আরএন পল জানান, "আপনি কঠোর ভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জীবিত থাকলে, এই (লকডাউন) পরিস্থিতি সবথেকে বাজে বিষয় হবে না।"
"কিন্তু, অর্থনীতিকে লোকসানের মুখে ফেলে টিকে থাকা সম্ভব না, বিশেষত সরকার যখন চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে অবগত," বলেন তিনি।