লকডাউনে গাজীপুরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কারখানাগুলো, উপেক্ষিত পরিবহন ব্যবস্থা
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সর্বাত্মক লকডাউনে খোলা রাখা হয়েছে গাজীপুরের বেশিরভাগ শিল্প কারখানা। এসব কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তবে কারখানায় আসা যাওয়ার জন্য নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থার কথা থাকলেও তা রয়েছে উপেক্ষিত। মালিকপক্ষ বলছে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে কারখানা পরিচালনা করছেন তারা। আর কর্মরত শ্রমিকরাও তাদের জন্য নেয়া এসব ব্যবস্থা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করছেন। শ্রমিকদের সুরক্ষায় শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএ এর পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
জানা গেছে, শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে তিন হাজারের বেশি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করছেন লাখ লাখ শ্রমিক। সর্বাত্মক লকডাউনে সরকারের ১৩ দফা নির্দেশনা অনুযায়ী চান্দনা চৌরাস্তা, জয়দেবপুর, টঙ্গী, পোড়াবাড়ি, সালনাসহ জেলার শুরুত্বপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় শ্রমিকদের মাস্কপড়া, শরীর জীবাণুমুক্তকরণ, হাত ধোয়াসহ প্রত্যেক শ্রমিকের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা নেয়ার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রিকশা, অটো রিকশা ও পায়ে হেঁটে কারখানায় আসছেন শ্রমিকরা।
কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা বলছেন, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় শরীরের তাপমাত্রা মাপা, হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক দূরত্বের জন্য মালিকপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছেন। জীবন ও জীবিকার জন্য কারখানায় কাজ করতে চান তারা।
সাদমা ফ্যাশনে কর্মরত তানিয়া বলেন, 'করোনার সময়ে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করছি। আমরা চাই এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে। এটা আমাদের জন্যই ভাল। আমরা যদি আমাদের স্বাস্থ্যের নিয়মগুলো মেনে চলি তবে আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা না। আমাদের যদি কাজ না থাকে, উপার্জন না থাকে তবে আমরা না খেয়ে মারা যাব'।
আরেকজন শ্রমিক তুষার জানান, 'আমরা চাই কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে। রোজার মাস চলছে, সামনে আসছে ঈদ। এখন আমরা কাজ না করলে বেতন বোনাস কীভাবে পাব!'
কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছেন, সরকার এবং বিজিএমইএ এর নির্দেশনা মেনে কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে সকল ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে মালিকপক্ষ। গত লকডাউনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে করোনা মোকাবিলায় এবার কারখানা পরিচালনা করছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে সাদমা গ্রুপের পরিচালক সোহেল রানা বলেন, 'করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ঠেকাতে কারখানায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জীবন এবং জীবিকা বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। কারখানায় প্রবেশের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের তাপমাত্রা মাপা, তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে প্রবেশ করানো, জীবানুমুক্তকরণ ও হাতধোয়াসহ আক্রান্ত হলে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চারটি হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে, কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাব। এভাবে আমরা শ্রমিকদের সার্বক্ষণিক নজরে রেখেছি যাতে সুষ্ঠুভাবে কারখানা পরিচালনা করতে পারি'।
মৌচাক নীট কম্পোজিট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা বুঝতে পেরেছি কীভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কীভাবে শ্রমিকদের সচেতন করা যায়। এজন্য প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং হচ্ছে, তারাও আগের তুলনায় সচেতন রয়েছে। গত লকডাউনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার আমাদের কারখানা পরিচালনা করা তুলনামুলক সহজ। এজন্য সহজে আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিজেরা করতে পারছি'।
শ্রমিক সুরক্ষাসহ কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বিজিএমইএ এর পক্ষে ১২টি টিম কাজ করছে জানিয়ে বিজিএমইএ পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমরা চাই শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখতে। এজন্য এই ১২টি টিম প্রত্যেকটি কারখানায় প্রয়োজনীয় মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করবে। কোন কারখানা স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে'।
নিজস্ব পরিবহনে শ্রমিকদের আনা নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমাদের শ্রমিকদের ৮০ ভাগ কারখানার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করেন। তারা পায়ে হেঁটেই কারখানায় আসতে পারছেন। আর অফিসার, মার্চেন্টাইজার, স্টাফ যারা আছেন তারা নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় কারখানায় আসছেন। কোন শ্রমিক বা কর্মী গণপরিবহন ব্যবহার করে কারখানায় যাবে না'।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুশান্ত সরকার বলেন, 'গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার জন্য জোন ভিত্তিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্প পুলিশ ছাড়াও জেলা প্রশাসন, কলকারখানা অধিদপ্তর, মেট্টোপলিটন পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। কোন কারখানার মালিক যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানেন তবে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করব'।
জেলা শিল্প পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গাজীপুরে ২ হাজার ৭২টি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এদের মধ্যে বিজিএমইএ এর আওতাভুক্ত ৮৩০টি, বিকেএমইএ এর ১৩৮, বিটিএমইএ এর ১২২ এবং অন্যান্য কারখানা রয়েছে ৯৮২টি। শুধুমাত্র সিটি এলাকায় অবস্থিত কারখানায় কাজ করছেন অন্তত ২২ লাখ শ্রমিক। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে এসব শ্রমিকরা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।