প্রবৃদ্ধি নয়, বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য মোকাবিলা
দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কত রাখতে হবে, সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে আগামী অর্থবছরে বাজেট করোনায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা ও মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রণয়ন হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
এর জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তার পরিধি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বাড়ানো, নতুন করে করারোপ না করা, ধনীদের কর বাড়িয়ে দরিদ্রদের ছাড় দেয়াসহ বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে বেসরকারি 'থিংক ট্যাংক'টি।
বৃহস্পতিবার এক ভার্চ্যুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডি বলেছে, সরকার ৩৫ লাখ পরিবারকে যে পরিমাণ নগদ সহায়তা দিচ্ছে, সেটি আরও বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে পরিবারের সংখ্যা ও নগদ সহায়তার পরিধিও বাড়ানো দরকার।
আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। আর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে সেবা নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, কর্মসংস্থান তৈরিতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
বাজেট জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ভর হওয়া উচিত নয় জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'আমাদের এখানে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই জিডিপি যদি কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারে, রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারে, তাহলে এই প্রবৃদ্ধির কোনো অর্থই হয় না। পৃথিবীর অনেকে দেশেই প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে। তাতে সেসব দেশের কোনো সমস্যা হয়নি'।
সভায় মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'সরকার গরিব মানুষকে নতুন করে নগদ সহায়তা দিতে যাচ্ছে। সত্যিকারের গরিব মানুষ যাতে এ সহায়তা পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, প্রণোদনার চেয়ে নগদ সহায়তা বেশি উপকারী। এ টাকায় চাহিদা তৈরি হয়। অর্থনীতি চাঙা হয়। তাই নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে গরিব মানুষের সংখ্যা এবং এর পরিধিও বাড়ানো উচিত'। বছরে দুই থেকে তিনবার গরিব মানুষকে নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
সিপিডি বলেছে, করোনার কারণে অর্থনীতির যে পরিবেশ, তাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যেন বাস্তবসম্মত হয়। স্বাস্থ্য সেবাসংক্রান্ত যেসব উপকরণ রয়েছে, সেসব আমদানিতে কর পরিহারের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
কোভিডের কারণে সংস্কার কার্যক্রম যাতে পিছিয়ে না যায়, সেদিকে নজর দেয়ার কথাও বলা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। স্বাস্থ্য খাতে যারা ফ্রন্টলাইনে আছেন, তারা এখনো প্রণোদনার টাকা পাননি। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব প্রণোদনার টাকা ছাড়ের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
চারটি খাত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
করোনার কারণে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতা ও উদ্যোক্তাদের বিপদের কথা চিন্তা করে চারটি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছে সিপিডি।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'এই মুহূর্তে সব থেকে খারাপ পারফর্ম করা একটা বিভাগ হলো স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য খাতে যে ধরনের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, বেশি দামে পণ্য কেনার খবরগুলো আমাদের কাছে খুবই দুঃখজনক মনে হয়েছে। আমাদের যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে, যেন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়'।
তিনি বলেন, কোভিড চিকিৎসার ক্ষেত্রে যে ধরনের বাজেট বরাদ্দ দরকার তার ক্ষেত্রে সরকার যেন কোনও ধরনের কুণ্ঠাবোধ না করে। নতুন ইউনিটের ক্ষেত্রে, আইসিইউ, অক্সিজেনের ক্ষেত্রে সরকারকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
দারিদ্র্যের হার ২০ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'নতুন দারিদ্র্যে মানুষকে খাদ্য যোগান দেয়া অত্যন্ত জরুরি। বাজেটে তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার'।
এর বাইরে ক্ষুদ্র ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা ও কর্মসংস্থান বাড়ে এমন প্রকল্প নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
ধনীদের কর হার বৃদ্ধির প্রস্তাব
করোনাকালীন সময়ে দরিদ্রদের সহায়তার জন্য তাদের ওপর করের খড়গ না বাড়িয়ে ধনীদের করহার বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সিপিডি।
বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, 'ধনীদের আয়কর গত বছর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এটাকে আবার ৩০ শতাংশ ফিরিয়ে নেয়া উচিত। সামষ্টিক অর্থনীতি ও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এটা সামঞ্জস্য। বিভিন্ন দেশ এখন এটা করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ধনীদের কর হার বাড়িয়ে দিয়েছে'।
ধনীদের ওপর করবৃদ্ধি ও করফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'উন্নত দেশে বড় অংশই আসে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর থেকে। বিপরীতে আমাদের দেশে ভ্যাট বা পরোক্ষ কর থেকে রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ আহরিত হয়। এটি এক ধরণের অন্যায্যতা। আয়করের আওতা বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষের জীবন যাত্রার সঙ্গে যুক্ত এমন পণ্যে ভ্যাট কমানো দরকার'।
বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ
বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত বলে মনে করছে সিপিডি। তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, 'গত অর্থবছরে অপ্রদর্শিত অর্থ কিংবা কালো টাকা সাদা করার কথা বলে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে বাংলাদেশের বের হয়ে আসা উচিত। এটি কর আহরণের যে নীতিকাঠামো তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও এ বছর ভালো একটি অঙ্ক এ খাত থেকে এসেছে। তারপরও আমরা মনে করি এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসা উচিত'।
তিনি বলেন, 'যারা টিআইএন ও বিআইএনের বিপরীতে রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না তাদের বাধ্য করা বা করের আওতায় আনাটা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বাংলাদেশে কালো টাকা ও অর্থ পাচারের যে সংস্কৃতি রয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোকাবিলার প্রতি মনোযোগী হতে হবে'।
এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'চলতি অর্থ বছরে এ খাত থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। যেটা খুব বড় অঙ্ক বলে মনে হয় না। বরং আমরা মনে করি যারা নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাদেরকে এটি নিরুৎসাহিত করছে'।
ইন্টারনেটের সম্পূরক শুল্ক ও উৎস কর প্রত্যাহার
ইন্টারনেটের সম্পূরক শুল্ক ও উৎস কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'ইন্টারনেটের ব্যবহার এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটা শুধু ধনীরা ব্যবহার করেন এখন আর এমনটা নেই। অনেক সাধারণ মানুষকে শিক্ষার কাজে বা অন্য কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে। যে ধরনের করকাঠামো এখানে আছে, আমরা মনে করি এটা সহায়ক অবস্থায় নেই। আমরা সুপারিশ করছি সম্পূরক শুল্ক যে ১৫ শতাংশ আছে তা প্রত্যাহার করা। সেই সঙ্গে ১ শতাংশ যে উৎস কর রাখা হয়েছে তাও প্রত্যাহার করা।এখন শুধুমাত্র যে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে সেটাকে রেখে, এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত'।
ঋণের ওপর জোর
বাজেট ঘাটতি মেটানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের ওপর জোর দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, 'ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। আমরা অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা বলছি, সে ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতি যদি বেশি হয়, তাহলে ব্যাংক থেকে টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ না করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ এখন বেসরকারি খাতে চাহিদা কম'।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণের পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্যের দিকে মনোযোগী হতে হবে বলে জানিয়েছেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'এই সময়ে ট্যাক্স না বাড়িয়ে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। মানুষকে নগদ সহায়তাসহ কর্মমুখী প্রকল্প গ্রহণে অর্থের প্রয়োজন হবে। এজন্য বৈদেশিক সাহায্য নেয়া যেতে পারে'।
কর নয় এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি
করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ব্যবসায়ীদের ওপর নতুন করে করারোপ না করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। করোনার মধ্যে বিভিন্ন খাতে ব্যবসায়ীদের দেয়া ফিসক্যাল সুবিধা এবারও অব্যাহত রাখা দরকার বলে মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
আগামী বাজেটে কর কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব না করা। এরপর করের ক্ষেত্রে যাদের সুবিধা দেয়া হয় তা নির্দিষ্ট করা, কর ফাঁকি রোধ করা ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঠামোগত সংস্কার করা।
কাঠামোগত সংস্কার বলতে দক্ষ জনবল বাড়ানো এবং ট্যাক্স আহরণ পদ্ধতিতে অটোমেশনসহ এনবিআরের পরিবর্তন বলে মনে করছেন তিনি।
তাছাড়া স্বাস্থ্য খাতে যেসব অব্যাহতি/ছাড় দেয়া হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হবে বলে মনে করছেন তৌফিকুল ইসলাম।