ভারতের শ্মশানগুলোতে লাশের স্তূপ, সারা রাত জ্বলছে চিতা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের চাপ সামলাতে পারছে না ভারতের নয়াদিল্লির শ্মশানগুলো। সারা রাত ধরে জ্বলতে থাকা চিতার আগুন যেন স্বজনদের কান্না আর আহাজারিকে ছাপিয়ে উঠেছে।
ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গ আঘাত হানার ফলে এত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, শ্মশানের কর্মীরা নতুন করে চিতা সাজাবার আগেই তৈরি হচ্ছে লাশের আরও স্তূপ।
নয়াদিল্লির সীমাপুরি শ্মশানের প্রধান কর্মকর্তা জিতেন্দর সিং শুন্টি জানালেন, মহামারির আগে তারা দৈনিক এই শ্মশানে আট থেকে দশটি মৃতদেহ দাহ করতেন। কিন্তু এখন প্রতিদিন তাদের ১০০-১২০টি মৃতদেহ দাহ করতে হচ্ছে।
মৃতদেহ জমা হওয়ার মাত্রা এতটাই বেশি, সীমাপুরি শ্মশান কর্তৃপক্ষকে তাদের পার্কিং লট পর্যন্ত জায়গা বর্ধিত করতে হয়েছে। ডজন ডজন কর্মী সেখানে ইট ও চুন-বালি মিশিয়ে নতুন চিতা সাজাবার বেদী তৈরিতে ব্যস্ত।
শ্মশানের ধারণক্ষমতার তুলনায় লাশের সংখ্যা এত বেশি, স্বজনদের এখন লাশ দাহ করার জন্য আগে টিকিট নিয়ে লাইন ধরে হচ্ছে।
দিল্লিতে এত বেশিবার চিতার আগুন জ্বলেছে, তাদের এখন কাঠের মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার নয়াদিল্লির মেয়র জয় প্রকাশ এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে চিঠি দিয়েছেন, যেন বন বিভাগকে বলা হয় শহরে আরও কাঠ সরবরাহ করতে।
এরই মধ্যে, পরিবারগুলোকে স্বজনদের লাশ দাহ করার কাঠের জন্য টাকা দিতে হচ্ছে। শ্মশানগুলোতে জায়গা না থাকায় অনেকেই বাধ্য হয়ে টাকা দিচ্ছেন।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবনে মৃত্যুর পর দাহ করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা বিশ্বাস করেন, পুনর্জন্ম লাভের জন্য অবশ্যই মৃতদেহ দাহ করে বিনাশ করতে হবে।
ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক বারখা দত্তের বাবা এ সপ্তাহে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন; কারণ তাকে ত্রুটিযুক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
বুধবার বারখা বলেন, 'আমরা যখন তাকে দাহ করতে গেলাম, শ্মশানে কোনো জায়গা ছিল না। কিছু পরিবারের মধ্যে এ নিয়ে প্রায় হাতাহাতি লেগে গিয়েছিল। আমার বাবাকে দাহ করার জন্য শেষ পর্যন্ত আমাকে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল।'
কিন্তু এরপরও বারখা দত্ত নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন এই ভেবে, যেসব পরিবারের কারও মৃতদেহ দাহ করা প্রয়োজন, কিন্তু তার বদলে লাশ মাটিতে পড়ে আছে, তারা তার চেয়েও কষ্টে রয়েছেন।
অনিঃশেষ মিছিল
বৃহস্পতিবার ভারত নতুন করে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার করোনা আক্রান্তের বিশ্বরেকর্ড করেছে। এদের মধ্যে মারা গিয়েছেন ৩ হাজার ৬০০ জন।
উত্তর দিল্লি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন মেয়রের কাছ থেকে জানা যায়, দিল্লি গত সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন ৬০০ শতাধিক লাশ দাহ করে আসছে। কিন্তু এই সংখ্যা কর্তৃপক্ষের হিসাব দেওয়া শহরের মৃতের সংখ্যার দ্বিগুণ। তাই ধারণা করা হচ্ছে, মৃতের সংখ্যা রিপোর্ট করায় একটি বড় ধরনের সমস্যা থাকতে পারে।
দিল্লির নিগাম্বোধ ঘাট শ্মশানের কর্মকর্তা সুমন কুমার গুপ্ত জানান, তারা সকাল থেকে লাশ দাহ করা করা শুরু করেন এবং একের পর এক লাশ আসতেই থাকে।
শ্মশানে কাজ করতে থাকা কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের জন্যও প্রতিনিয়ত শত শত লাশ দাহ করা এবং স্বজনদের আহাজারির সাক্ষ্য হওয়া একটি মানসিক চাপ তৈরি করেছে। সীমাপুরি শ্মশানে দেখা যায়, কিছু স্বেচ্ছাসেবী তাদের কাজ শুরু করার আগে দেয়ালে হেলান দিয়ে সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নতুন করে চিতার বেদি তৈরি ও দাহ করার ফাঁকে ফাঁকে শ্মশানের প্রধানকর্তা শুন্টি চেষ্টা করেন স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার।
তিনি বলেন, 'আমরা গত পাঁচ ঘণ্টায় ৫৫টি লাশ দাহ করেছি এবং দিনশেষে তা ১০০-তে পৌঁছবে। আমি ভীষণ ক্লান্ত, কিন্তু এখন বিশ্রামের সময় নয়। এখন আমার দেশের বিপদে কাজ করার সময়, মানবতার খাতিরে কাজ করার সময়।'
শুন্টি জানালেন, তার কাজের সবচেয়ে কঠিন দিকটি হলো তরুণদের মারা যেতে দেখা। তিনি কয়েকটি পরিবারকে দেখেছেন যারা পরিবারের খুবই ছোট সদস্যদের হারিয়েছেন।
ভারত সরকারের কোভিড-১৯ টাস্ক ফোর্স ডেটা থেকে জানা যায়, তরুণরাও ভাইরাসের প্রথম তরঙ্গ থেকেই আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ, মেডিকেলকর্মী ও শ্মশানকর্মীরা জানান, নতুন তরঙ্গের আঘাতের ফলেই তরুণরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
'আমরা ব্যর্থ'
এই মুহূর্তে ভারত সরকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হোঁচট খাচ্ছে। বহু শহর ও রাজ্যে নতুন নতুন বিধিনিষেধ ও কারফিউ আরোপ করা হয়েছে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কয়ক'শ অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট স্থাপনসহ এক লাখ পোর্টেবল অক্সিজেন কনসেনট্রেটর কেনার জন্য অনুমোদন দিয়েছেন।
মঙ্গলবার থেকে ভারতে আন্তর্জাতিক সহায়তা এসে পৌঁছানো আরম্ভ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতকে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটর, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে।
কিন্তু এসব সরবরাহ বণ্টনের জন্য সময় প্রয়োজন এবং অক্সিজেন প্ল্যান্ট বানানোও সময়সাপেক্ষ। নয়াদিল্লির মতো যেসব শহরে সংক্রমণের মাত্রা ভয়াবহ, সেখানে তাৎক্ষণিক সহায়তার লোকবল কম। অর্থাৎ সহায়তা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে লাশের স্তূপ আরও বড় হতে থাকবে।
অসহায়ত্ব, রাগ ও হতাশা থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ভারতীয়দের ক্ষোভ বেড়েই চলেছে, বিশেষত যারা প্রতিদিন কাছের মানুষদের মৃত্যু দেখছেন। এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ দিল্লিতে অক্সিজেন, শয্যা, ভেন্টিলেটর, প্লাজমা ইনজেকশন- সবকিছুরই চরম অভাব দেখা দিয়েছে।
শুন্টি বলেন, 'আমি একইসঙ্গে চরম রাগ ও অপরাধবোধের মধ্যে রয়েছি। কারণ এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। যারা এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করার কথা, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েই উধাও হয়ে গেছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের ১৮টি অ্যাম্বুলেন্সের বহর রয়েছে যা খুবই সীমাবদ্ধ। আমাদের প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫৫টি লাশ তুলতে হচ্ছে। কিন্তু আমার ক্ষোভ এই জায়গায়, যাদের এই কাজ করার কথা তারা কিছুই করছেন না; ফলে স্বেচ্ছাসেবকদের এই কাজ করতে হচ্ছে।'
যেসব পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছে, তারাও যে নিজেরা বিপদমুক্ত রয়েছে- তা নয়।
কলাম লেখক বারখা দত্ত বলেন, 'একটা রাষ্ট্রের অবহেলা, খামখেয়ালি ও বধিরতার শিকার হয়ে জনগণ প্রতারিত অনুভব করছে বলে আমি একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ক্ষোভ জানাচ্ছি। আমরা সব জায়গায় ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক সবাই ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের একটি ব্যর্থ সরকার রয়েছে যারা মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গের সংক্রমণ প্রতিরোধের কোনো পরিকল্পনাই করেনি।'
তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের দিকে ইঙ্গিত করেন, যিনি দাবি করেছেন ২০২০ সালের করোনাভাইরাস সংকটের তুলনায় ভারত এখন ভাইরাসটি মোকাবিলায় ভালো অবস্থানে রয়েছে।
নিজের মা-বাবা দুজনকে হারিয়ে অনাথ হয়ে যাওয়া দত্ত ক্ষোভ ও হতাশায় এখন অনেকটাই নির্বাক।
দত্ত বলেন, "আমার বাবার মৃত্যুর আগে শেষ কথা ছিল, 'আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।' আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বাবাকে বাঁচানোর, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এখন আমার আর কেউই নেই।"
-
সূত্র: সিএনএন