‘জীবন বাঁচাতে এরচেয়ে বেশি কী করা সম্ভব?’ স্বাস্থ্যকর্মীদের পীড়া দেয় যে প্রশ্ন
মহামারির দিনগুলোতে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, সংকটাপন্ন রোগী এবং হাসপাতালের উপচে পড়া ভিড় ড. আব্দুল্লাহ আসেফ আখন্দের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। ড. আব্দুল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় ভয় হলো নিজের রোগীকে মৃত ঘোষণা করা।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় সপ্তাহখানেক আগে বাংলাদেশে যখন সংক্রমণ এবং মৃতের সংখ্যা শীর্ষে পৌঁছে, তখন তিনি প্রতিদিন প্রায় সাত থেকে আটজন রোগীকে মারা যেতে দেখেন।
রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালের আইসিইউ রেজিস্টার ড. আব্দুল্লাহ বলেন, 'নিবিড় পরিচর্যায় আমার দীর্ঘ ছয় বছরের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি কখনোই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে না।'
তবে তিনি একা নন। অধিকাংশ সম্মুখসারির যোদ্ধার কাঁধেই বিশাল একটি দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো- সীমিত চিকিৎসা সামগ্রী ও লোকবল নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো। পুরো বিষয়টি এই স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপের সৃষ্টি করেছে। সমস্যাটি বৃদ্ধি পায় যখন তারা মহামারি আরও দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকার বিষয়টি অনুধাবন করেন।
'মেন্টাল হেলথ অব ফিজিশিয়ানস ডিউরিং কোভিড-১৯ আউটব্রেক ইন বাংলাদেশ: আ ওয়েব-বেসড ক্রস-সেকশনাল সার্ভে' শীর্ষক পিয়ার পর্যালোচনাযুক্ত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় সমস্যাটির গভীরে আলোকপাত করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত এই গবেষণায় ১১৪ জন চিকিৎসক অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্বেগ এবং হতাশার উপস্থিতি পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৩২.৫ শতাংশ এবং ৩৪.২ শতাংশ চিকিৎসকের মাঝে। অন্যান্য বৈশ্বিক মহামারি উদ্ভূত পরিস্থিতির তুলনায় এই হার বেশ উচ্চ।
পূর্ববর্তী গবেষণার উল্লেখ করে নিবন্ধে আরও বলা হয়, এ ধরনের বিশাল পরিসরের মহামারি থেকে সৃষ্ট হতাশা এবং উদ্বেগের মতো মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাজীবী হওয়ায় তাদের মানসিকভাবে স্থিতিশীল ধারণা করা হয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'আমাদের বুঝতে হবে, তারাও মানুষ এবং তারাও মহামারির মতো পরিস্থিতির শিকার।'
মুগদা হাসপাতালের সহকারী সার্জন মিজানুর রহমান বলেন, 'এমন দিনও ছিল যখন আমাদের একটি আইসিইউ শয্যার জন্য ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী অপেক্ষা করতেন। বিষয়টি বেশ দুঃখজনক ছিল যে, আমরা তাদের জায়গা দিতে পারতাম না। আমাদের কাছে তো কোনো ফাঁকা জায়গাই ছিল না।'
তিনি জানান, প্রতিবার একজন রোগীকে হারানোর পর একটি প্রশ্নই তাকে পীড়া দেয়। প্রশ্নটি হলো- 'আমাদের পক্ষে এরচেয়ে বেশি আর কী করা সম্ভব ছিল?'
জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ছোটাছুটি করা স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক যন্ত্রণা অপ্রকাশ্য ও অব্যক্তই থেকে যায়। তবে যখন দায়িত্বরত অবস্থায় নিজেদের ভেতর কাউকে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে দেখেন, তখন সামলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪৫ জন চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন।
মাস পেরিয়ে বছর জুড়ে বাড়তে থাকা এই চাপ এবং মানসিক পীড়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসকরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বশেষ গত ২ মে দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন রেসিডেন্ট চিকিৎসক বিপর্যস্ত অবস্থায় আত্নহত্যা করেন।
মানসিকভাবে সহায়তার ব্যবস্থা করা হলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়ানো যেত বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের পরিচালক মোহাম্মদ এনায়েত হুসেইন শেখ জানান, চিকিৎসক ও নার্সের কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে তিনি স্বীকার করেন, কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা জরুরি।
এনায়েত হুসেইন বলেন, 'কেবলমাত্র কোভিড সংকটকালে নয়, আমি মনে করি চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য সবসময় মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা রাখা উচিত। স্বাস্থ্যসেবা খাতে মানসিক চাপের বিষয়টি অনেক। জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা যখন দেশের বাইরে খেলতে যান, তখন তাদের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা থাকেন। তাহলে কেন স্বাস্থ্যসেবাদানকারী পেশাজীবীরা এই সেবা পাচ্ছেন না- এমনকি যখন অনেকে দায়িত্ব পালন করতে পরিবার থেকে আলাদা থাকেন?'
পরিবারের সাথে যেসব চিকিৎসক থাকেন, তারা হাসপাতাল থেকে ঘরে ভাইরাস নিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে দিন কাটান।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআর,বির সাথে যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগ গত বছর স্ট্রেস ব্যবস্থাপনার ওপর একটি কর্মশালার আয়োজন করে।
অধ্যাপক কামাল উদ্দীন বলেন, 'আমরা দেখতে পাই, সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে ঘুরেফিরে পরিবারকে সংক্রমিত করার উদ্বেগ বেশি কাজ করছে।'
ক্যানসার আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবা এবং সদ্যজাত সন্তানের কথা ভেবে ড. আব্দুল্লাহ আসেফ আখন্দ গত জুন মাস থেকে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। গত বছর ঈদের সময় তিনি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন। এবারও ব্যতিক্রম হবে না বলেই ধারণা তার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, 'মনে হয় না এই ঈদে আমি আমার প্রথম সন্তানের সাথে সময় কাটাতে পারব।'
ড. আব্দুল্লাহর সাত সদস্যের আইসিইউ দলটি ইমপালস হাসপাতালের ৫৬ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছে। প্রথম ঢেউয়ের পর বিভিন্ন সময়ে দলটির পাঁচ সদস্য বায়ুবাহিত এই ভাইরাসে সংক্রমিত হন। কোভিড পজিটিভ হওয়ার পরই তারা বাড়ি ফিরে যেতেন। কেননা, তাদের ভেতর দ্রুত সুস্থ হয়ে পুনরায় হাসপাতালের দায়িত্ব গ্রহণের তাড়া ছিল।
২০২০ সালের শেষের দিকে ড. আব্দুল্লাহর কোভিড আক্রান্ত একজন সহকর্মীর অসুস্থতা মারাত্মক রূপ ধারণ করে। ভাইরাসের কারণে তার ফুসফুসের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তখন আমাদের কাজের ভার দ্বিগুণ হয়ে যায়। যাতায়াতের সময় বাঁচাতে আমি হাসপাতালে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কাজে ফেরার আগে শুধু নিরিবিলি একটা ঘর খুঁজে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে নিতাম।'
চিকিৎসকদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘ কর্মঘণ্টার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের অবস্থান এবং চিকিৎসকদের বৈবাহিক অবস্থার সাথে মানসিক উদ্বেগের সম্পর্ক আছে। বিবাহিত চিকিৎসকরা সাধারণত উদ্বেগে কম ভুগেন। মূলত সঙ্গীর কাছ থেকে মানসিক সমর্থন পাওয়ার কারণেই তা ঘটে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
ক্লিনিকাল মনোবিদ কামাল উদ্দীন বলেন, 'আমাদের মহামারির সময়কালকেও বিবেচনায় আনতে হবে। প্রায় ১৪ মাস ধরে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলেছেন।'
তিনি আরও জানান, দুঃখজনকভাবে আমাদের চিকিৎসক এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা অনুভব করেন, তাদের পরিশ্রমের বিষয়টি অস্বীকৃতই থেকে যাচ্ছে। সরকার কিংবা সমাজ কোথাও তারা যথাযথ স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।
গত বছর স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের আগে চিকিৎসা বহির্ভূত খাতের নাগরিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়। সম্মুখসারির চিকিৎসক ও নার্সরা কেন মনোবল হারিয়ে অবলম্বনহীন বোধ করেছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ঘটনাটির উল্লেখ করেন মনোবিদ কামাল উদ্দীন।
তবে ইতোপূর্বে যাই হোক না কেন, স্বাস্থ্যখাতের পেশাজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বিবেচনায় আনতে বর্তমানে কাউন্সেলিং সহায়তা প্রদান অপরিহার্য।
পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে সংকোচের অবসান ঘটানোর জন্যও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, "মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলরের কাছে যাওয়া মানেই 'মাথা খারাপ হওয়া'- এ ধরনের নেতিবাচক ধারণা দূর করতে সচেতনতামূলক প্রচারণার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন।"